সমাজে স্বাধীনভাবে চলাচলের জন্য নারীদের ভীতি দূর করেছে ইয়াসমিন আন্দোলন। শুধু তাই নয়, যেকোনো অনুষ্ঠানে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা হয় ইয়াসমিনকে নিয়ে সেই আন্দোলনের কথা। আর ইয়াসমিনের কারণেই নারীর প্রতি লোলুপ দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে খারাপদের। এমনই মতামত দিনাজপুরের সর্বস্তরের মানুষের। স্কুল-কলেজের ছাত্রীরা বলছে, তাদের চলাচলে আর কেউ বাধা সৃষ্টি করছে না। বখাটেদের মনে ইয়াসমিনকে ঘিরে সেই আন্দোলন এখনো গেঁথে রয়েছে। এভাবেই চলতে থাকলে কোনো নারী, পুরুষ কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হবে না। তাই আমাদের কাছে ইয়াসমিনের আন্দোলন একটি আর্দশশিক আন্দোলন। কারণ এই আন্দোলন সমাজের অনেক অসংগতি ভেঙে দিয়েছে।আগামী ২৪ আগস্ট ইয়াসমিন ট্র্যাজেডির ২০ বছর পূর্ণ হবে। মেয়ের আন্দোলনের সফলতা নিয়ে সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন ইয়াসমিনের মা ফরিদা বেগম।তিনি বলেন, আমার মেয়ের সঙ্গে যে অন্যায় হয়েছে, তার শাস্তিও অন্যায়কারীরা পেয়েছে। অন্যায়কারীদের শাস্তি দিতে দিনাজপুরের মানুষ যে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে তা সারাবিশ্বের মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। পুলিশের ফাঁসি হয় এমন কথা আমি আগে কোনো দিন শুনিনি। কিন্তু এই এলাকার মানুষ একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ করায় আমার মতো গরীবের মেয়ের ধর্ষণ ও হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। দোষী তিন পুলিশকে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে কার্যকর করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, দিনাজপুরের মানুষ মা বোনের ইজ্জদ রক্ষায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে পারে। এই ঘটনা মানুষের মনে এখনো নারা দেয় দারুণ ভাবে। এখনো মানুষ প্রতিবাদী প্রতীক হিসেবে ইয়াসমিন ট্রাজেডিকে তুলে ধরে। অথচ এই আন্দোলনের অনেক দাবি এখনো অপূর্ণ রয়ে গেছে। ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার বিচারে তিন পুলিশের ফাঁসি হলেও মৌলিক দাবিগুলো রয়েছে পূরণ না হওয়ার তালিকায়।এ ব্যাপারে কথা হয় ইয়াসমিন আন্দোলনের প্রথম প্রতিবাদকারী ও আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দিনাজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপালের সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ওই সময়ের গণঅভ্যূথান অন্ততপক্ষে সমগ্র বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছিল মর্যাদা রক্ষার জন্য দিনাজপুর পারে এবং মর্যাদা রক্ষায় দিনাজপুরের মানুষ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে প্রন্তুত। তিনি বলেন, এটা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের আন্দোলন ছিলনা। এ আন্দোলন ছিল সমগ্র দিনাজপুরবাসীর। যার কারণে তদানিন্তন সরকার বাধ্য হয়েছিল জনতার দাবি মেনে নিতে। যদিও তারা দাবিগুলো বাস্তবায়ন করেনি। ৮ দফা দাবি মেনে নিয়ে তৎকালীন সরকার প্রধানের বিশেষ প্রতিনিধি এসে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়।তিনি আরো বলেন, এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ শিক্ষা নিয়েছে বোনের, মায়ের সম্ভ্রম কিভাবে রক্ষা করতে হয়। আমরা সমগ্র বিশ্বে একটি উদাহরণ।আন্দোলনের সফলতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে সংসদ সদস্য গোপাল জাগো নিউজকে বলেন, আমরা সফল। এই আন্দোলন একটি মাইল ফলক। আমরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি একজন গৃহপরিচারিকার জন্যও কিভাবে রুখে দাড়াতে হয়।ইয়াসমিন আন্দোলন নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা হয় দিনাজপুর পৌরসভার ১,২,৩ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা আসনের কাউন্সিলর ও ইয়াসমিনের প্রতিবেশী রোকেয়া বেগম লাইজুর। তিনি বলেন, দিনাজপুরের শান্তিপ্রিয় সহজ-সরল মানুষগুলো সারাবিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয়। আমরা এখন মাথা উঁচু করে বলতে পারি আমরা ইয়সমিনের জেলার মানুষ। তিনি আরো বলেন, ইয়াসমিনের মা বড় অসহায়। দাবি অনুয়ায়ী তার মা ফরিদা বেগমকে সরকার যদি একটা চাকরি দিয়ে দেয় তাগলে পরিবারটি ভালোভাবে বাঁচতে পারে।দিনাজপুর সরকারি মহিলা কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী মেহেনাজ মুন্নির কাছে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ২০ বছর আগে ইয়াসমিন নামে এক গৃহপরিচারিকাকে ধর্ষণের পর হত্যা করার কারণে দিনাজপুরের মানুষ আন্দোলন করে জানিয়ে দিয়েছিল যে আমরা প্রতিবাদী। প্রয়োজনে জেগে উঠতে জানি। তিনি বলেন, এই ঘটনার পর থেকে আমরা মেয়েরা কিছুটা হলেও স্বাধীনভাবে দিন-রাত যেকোনো সময় বাড়ি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে চলাচল করতে পারি। তাছাড়া ধর্ষণ ও হত্যার কারণে বিশ্বের কথাও বিচারে পুলিশের ফাঁসি হয়েছে আমার জানা নেই। দিনাজপুরের মানুষের গর্ব মাতৃভাষার জন্য যেমন বাঙালি জাতি ছাড়া বিশ্বে কোনো জাতি প্রাণ দেয়নি। আর এই প্রতিবাদের প্রতীকের নাম ইয়াসমীন। ইয়াসমীন আন্দোলনে জীবণের ঝুঁকি নিয়ে দাপিয়ে বেড়ান নারী নেত্রী ও মহিলা বহুমুখী শিক্ষা কেন্দ্রের (এমবিএসকে) নির্বাহী প্রধান রেজিয়া হোসেন। এই আন্দোলন সংগ্রামের ২০ বছর পর তিনি বলেন, আমি ইয়াসমিনের মাকে সার্বক্ষণিক সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়েছি। নিরাপত্তার জন্য গোপন স্থানে লুকিয়ে রেখেছি। ইয়াসমিনকে সনাক্ত করতে তার মাকে সঙ্গে নিয়ে কখনো থানায়, কখনো হাসপাতালে, কখনো মর্গে কখনো আবার গোরস্থানে ছুটেছি। এ কারণে আমাকে বিভিন্ন সময় জীবননাশের হুমকি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এ ধরনের হুমকিতে তারা দিনাজপুরের মানুষকে দমাতে পারেনি।রেজিয়া হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, শত ভাগ সফলতা হয়তো আসেনি। কিন্তু পুলিশ অন্তত বুঝেছে, আইন তাদের হাতে হলেও ছাড় পাওয়া যায়না। আর অফিস আদালতে এই ঘটনার পর থেকে নারীদের সম্পর্কে প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের দৃর্ষ্টি ভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে। আগের মতো আর নির্যাতিত হতে হয়না।এ নিয়ে কথা হয় দিনাজপুরের অসংখ্য বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে। তারা বলেন, এরকম আরো অসংখ্য সংগ্রাম, আন্দোলন ও প্রতিবাদ হওয়া উচিত। যাতে করে রক্ষকরা যেন ভক্ষকের ভূমিকায় অবর্তীন হওয়ার সাহস না করে। মা-বোনেরা যেন নির্বিঘ্নে সব কিছু করতে পারে।সেদিন যা ঘটেছিল : ১৯৯৫ সালের ২৪ আগষ্ট ভোরে ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁওগামী হাছনা এন্টারপ্রাইজ নৈশকোচ-এর সুপার ভাইজার তরুণী ইয়াসমিনকে দিনাজপুরের দশমাইল মোড়ে নামিয়ে দেয় এবং এক চায়ের দোকানদারকে বলে সকাল হলে তরুণীটিকে যেন দিনাজপুর শহরগামী বাসে উঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু, কিছুক্ষণ পরই সেখানে পৌঁছে নৈশ্যটহল পুলিশের একটি পিকআপভ্যান। পুলিশ সদস্যরা চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে থাকা তরুণী ইয়াসমিনকে নানা প্রশ্ন করে এক পর্যায়ে দিনাজপুর শহরে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে জোরপূর্বক পুলিশভ্যানে তুলে নেয়। এরপর তারা দশমাইল সংলগ্ন সাধনা আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইয়াসমিনকে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ রাস্তার পাশে ফেলে রেখে চলে যায়। এ ঘটনায় দিনাজপুরের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদ-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ থেকে দোষীদের শাস্তির দাবি করা হয়। ২৬ আগস্ট রাতে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী জনতা কোতয়ালি থানা ঘেরাও করে। ২৭ আগস্ট সকাল থেকে প্রতিবাদী মানুষেরা শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। দুপুর ১২টার দিকে কয়েক হাজার জনতা বিক্ষোভ মিছিল সহকারে দোষীদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবিতে জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি প্রদান করতে যায়। এ সময় পুলিশ বিনা উস্কানিতে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে ৭ জনকে হত্যা করে। আহত হয় প্রায় ৩ শতাধিক মানুষ। শহরের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। শহরে নামানো হয় বিডিআর। দিনাজপুর থেকে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটি ৩টি আদালতে ১২৩ দিন বিচার কাজ শেষে ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট রংপুরের জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল মতিন মামলার রায় ঘোষণা করেন। মামলার রায়ে আসামি পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মঈনুল, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার ও পুলিশের পিকআপ ভ্যানচালক অমৃত লাল বর্ম্মনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ বিধান ‘৯৫-এর ৬ (৪) ধারায় ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুর আদেশ দেন। আলামত নষ্ট, সত্য গোপন ও অসহযোগিতার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এএসআই মঈনুলকে আরো ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দন্ডিত করা হয়। অপর দিকে দণ্ডবিধির ২০১/৩৪ ধারায় আলামত নষ্ট, সত্য গোপন, অসহযোগিতার অভিযোগে অভিযুক্ত আসামি দিনাজপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার আব্দুল মোতালেব, ডা. মহসীন, এসআই মাহতাব, এসআই স্বপন চক্রবর্তী, এএসআই মতিয়ার, এসআই জাহাঙ্গীর-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত তাদের খালাস দেন।চাঞ্চল্যকর ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয় ৮ বছর পর অর্থাৎ ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। মামলার অন্যতম আসামি এএসআই মইনুল হক, পিতা-জসিমউদ্দীন, গ্রাম-বিশ্রামপাড়া, উপজেলা-পলাশবাড়ী, জেলা-গাইবান্ধা ও কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার, পিতা-এস.এম খতিবুর রহমান, গ্রাম-চন্দনখানা, উপজেলা-ডোমার, জেলা-নীলফামারীকে রংপুর জেলা কারাগারের অভ্যন্তরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ওই সালের ১ সেপ্টেম্বর রাত ১২টা ১মিনিটে। অপর আসামি পিকআপভ্যান চালক অমৃত লাল বর্মন, পিতা-লক্ষীকান্ত বর্মন, গ্রাম-রাজপুর, উপজেলা-সদর, জেলা-নীলফামারীকে রংপুর জেলা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয় ওই সালে ২৯ সেপ্টেম্বর মধ্যরাত ১২টা ১মিনিটে। এরপর থেকে প্রতিবছর দিনাজপুরে সর্বদলীয়ভাবে দিবসটিকে পালনের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। প্রতিবারের ন্যায় এবারও কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, ২৪ আগস্ট দিনাজপুর শহরের প্রতিটি ভবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাচ ধারণ ও শোক র্যালি। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পৃথক পৃথক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। নিহত ইয়াসমিনের মা শরীফা বেগম ২৪ আগস্ট তার বাড়িতে ফকির, মিসকিনদের মাঝে খাদ্য বিতরণ ও দোয়া খায়ের-এর আয়োজন করেছেন।এমএএস/এমএস
Advertisement