সরকার, বাগান কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে একটি যৌক্তিক, ন্যায্য এবং অন্যান্য খাতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মজুরি কাঠামো ঘোষণা করার পাশাপাশি প্রতি দুই বছর পরপর তা হালনাগাদ করার সুপারিশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
Advertisement
‘চা বাগানের কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকদের অধিকার: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানায় টিআইবি।
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টায় রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস ভবনের টিআইবির প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক (গবেষণা ও পলিসি) মোহাম্মদ রফিকুল হাসান, গবেষণা তত্ত্বাবধান ও সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. ওয়াহিদ আলম।
Advertisement
টিআইবি তাদের এ গবেষণায় শুধুমাত্র প্রথাগত শ্রমিকদেরই অর্থাৎ চা বাগানে স্থায়ীভাবে বাগান কর্তৃপক্ষের দেয়া বাসস্থানে বসবাস করে, যাদের জীবনের সাথে সম্পৃক্ত প্রায় সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও মজুরি বাগান কর্তৃক দেয়া হয় এবং যারা মূলত সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটি জেলায় বসবাসকারী শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করেছে। সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা পরিকল্পনা ও প্রতিবেদন প্রকাশ করেন প্রোগ্রাম ম্যানেজার দীপু রায়।
গবেষণায় দেখা যায়, চা বাগানের শ্রমিকদের সর্বশেষ চুক্তিতে দৈনিক মজুরি মাত্র ১০২ টাকা ধরা হয়েছে যা দেশের অন্য খাতের শ্রমিকদের তুলনায় অনেক কম। আবার ক্যাশ প্লাকিং, নির্ধারিত টার্গেটের অতিরিক্ত পাতা তোলা ও অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার জন্য শ্রম আইন অনুযায়ী মূল মজুরির দ্বিগুণ মজুরি দেয়ার নিয়ম থাকলেও কোনো বাগানেই তা দেয়া হয় না।
চুক্তি অনুযায়ী কোনো শ্রমিক বিগত বছরে কমপক্ষে ২৫০ দিন কাজ করলেই কেবল ১০০ শতাংশ বোনাস পাবে অন্যথায় কম উপস্থিতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন হারে বোনাস কাটা হয়। বাগান কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের অনুপস্থিত দেখিয়ে শ্রমিকদের উৎসব ভাতা কম দেয়।
গবেষণা অনুযায়ী, চা বাগানে চাকরি স্থায়ীকরণের ক্ষেত্রে শ্রম আইন অনুযায়ী একজন শ্রমিক তিন মাস সন্তোষজনক শিক্ষানবিশকাল পার করে স্থায়ী হবার কথা থাকলেও ৬৪টি বাগানেই স্থায়ী করা হচ্ছে না। অনেক বাগানে অসুস্থতাজনিত ছুটি নিতে গেলে বাগানের চিকিৎসা কেন্দ্রের দায়িত্বরত ব্যক্তির কাছ থেকে অসুস্থতাজনিত প্রতিবেদন নিতে হয় যা কষ্টসাধ্য ও অমানবিক। মাতৃত্বকালীন ছুটির ক্ষেত্রে গত পাঁচ বছরে ১০ শতাংশ নারী শ্রমিক ছুটি পাননি।
Advertisement
গবেষণায় দেখা যায়, শ্রম বিধিমালায় প্রত্যেক চা বাগানের কাজের জায়গায় পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার পানি সরবরাহের সুব্যবস্থা থাকার কথা থাকলেও কোনো বাগানেই স্থায়ী ব্যবস্থা যেমন নলকূপ বা কুয়ার ব্যবস্থা নেই। নেই পর্যাপ্ত শৌচাগারের ব্যবস্থা। শ্রমিকদের বিশ্রামের জন্য বিশ্রামাগার থাকার বাধ্যবাধকতা থাকলেও বেশিরভাগ বাগানেই বিশ্রামাগার নেই।
গবেষণায় দেখা যায়, শ্রম বিধিমালায় বাগান মালিক কর্তৃক প্রতিটি শ্রমিক ও তার পরিবারের বসবাসের জন্য বিনামূল্যে বাসগৃহের ব্যবস্থা করার কথা থাকলেও বিটিবির তথ্য অনুযায়ী ৩২ হাজার ২৯৯ জন স্থায়ী শ্রমিক ও অন্য অস্থায়ী শ্রমিকদের জন্য আলাদা কোনো আবাসন বরাদ্দ করা হয়নি।
গবেষণা অনুযায়ী, বিধিমালায় শ্রমিকদের সন্তানদের বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার কথা থাকলেও মাত্র ২৪টি বাগানে বাগান কর্তৃপক্ষের স্কুল রয়েছে, ৪০টি বাগানে বাগান কর্তৃপক্ষের নিজস্ব কোনো স্কুল নেই এবং ৬টি বাগানে কোনো স্কুলই নেই। শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য প্রত্যেক বাগানে হাসপাতাল বা ডিসপেনসারি প্রতিষ্ঠা করার নিয়ম থাকলেও জরিপকৃত ৬৪টি বাগানের মধ্যে ১১টি বাগানে চিকিৎসা কেন্দ্র বা ডিসপেনসারি নাই।
সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, চা শিল্প খাতে সরকার, মালিক সংগঠন ও চা শ্রমিক ইউনিয়নের নানা উদ্যোগে মজুরিসহ অন্যান্য বেশ কিছু বিষয়ে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে কর্মরত যেকোনো শ্রমিকের তুলনায় এখনো চা শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন। তারা তাদের ন্যায্য মৌলিক অধিকারগুলোও পর্যাপ্ত পরিমাণে পাচ্ছেন না।
গবেষণায় চা শ্রমিকদের জন্য কিছু ইতিবাচক দিক হলো, কোনো শ্রমিক অবসরে গেলে কিংবা স্বেচ্ছায় চাকরি ছাড়লে তার পরিবারের একজন অস্থায়ী শ্রমিককে স্থায়ী হিসেবে চাকরি দেয়া; বাগানের হাসপাতাল কিংবা ডিসপেনসারি থেকে কর্মরত স্থায়ী শ্রমিক ও তাদের পোষ্যদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়া; অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের সাপ্তাহিক অবসর ভাতা প্রদান; স্থায়ী শ্রমিকদের মজুরির ৭.৫ শতাংশ হিসেবে ভবিষ্যৎ তহবিল দেয়া; ২০ দিন অসুস্থতাজনিত ছুটি দেয়া- যা শ্রম আইনে ১৪ দিন এবং ১৪ দিন উৎসব ছুটি দেয়া- যা শ্রম আইনে ১১ দিন; ২ টাকা কেজি দরে রেশন দেয়া।
টিআইবির পেশকৃত ৮ দফা সুপারিশ
১. সরকার, বাগান কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিকদের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে একটি যৌক্তিক, ন্যায্য এবং অন্যান্য খাতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা এবং প্রতি দুই বছর পরপর তা বাজার দর অনুযায়ী হালনাগাদ করা;
২. বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে সরকার থেকে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ ও পর্যাপ্ত উদ্যোগ গ্রহণ করে সার্বজনীন শিক্ষার সরকারি নীতি অনুযায়ী চা শ্রমিকের সন্তানের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা;
৩. শ্রম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে স্থাপিত হাসপাতালের অবকাঠামোর পরিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিতসহ আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা চালু করা;
৪. বাগান পরিচালিত বিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির আওতায় আনা;
৫. শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ীকরণ, মজুরি, নিয়োগপত্র প্রদান, সার্ভিস বুক সংরক্ষণ, গ্রুপবীমা, গ্র্যাচুইটি, কল্যাণ তহবিল, শিক্ষা, চিকিৎসা, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার, খাবার পানি ও শিশু সদনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে শ্রম আইন, শ্রম বিধিমালা ও সমঝোতা চুক্তির কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করা;
৬. উত্তোলনকৃত পাতার ওজন কম দেখানো বন্ধ করতে উভয়মুখী প্রদর্শনী ব্যবস্থাসহ ডিজিটাল মেশিন ব্যবহার নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
৭. ভবিষ্যৎ তহবিল অফিসের সকল কার্যক্রম ডিজিটালাইজেশন করা। অবসরপ্রাপ্তদের তিন মাসের মধ্যে ভবিষ্য তহবিলের টাকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা।
৮. বাগানগুলোতে শ্রমিকদের সুযোগ সুবিধা ও কাজের পরিবেশ নিশ্চিতকরণে উপ-মহাপরিদর্শক, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের কার্যকর পরিদর্শন বাড়ানো ও আইনের ব্যত্যয়ের ক্ষেত্রে কার্যকরী ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
জেইউ/বিএ