আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে চট্টগ্রামের ১৬ টি সংসদীয় আসনের প্রতিযোগী প্রার্থীদের কথা শুনেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা। এ সময় আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের প্রার্থীরা রিটার্নিং কর্মকর্তাদের জানান, নির্বাচনের মাঠে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। তবে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তো দূরের কথা নির্বাচনী এলাকায় ৩০ তারিখ (ডিসেম্বর) পর্যন্ত তাদের টিকে থাকাই কঠিন।
Advertisement
সোমবার (১৭ ডিসেম্বর) দুপুরে চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের প্রার্থীদের সঙ্গে পৃথকভাবে মতবিনিময় করেন দুই রিটার্নিং অফিসার বিভাগীয় কমিশনার মো. আব্দুল মান্নান এবং জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন।
এর মধ্যে জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন তার নিজ কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে চট্টগ্রাম-১, চট্টগ্রাম-২, চট্টগ্রাম-৩, চট্টগ্রাম-৬, চট্টগ্রাম-৭, চট্টগ্রাম-১২, চট্টগ্রাম-১৩, চট্টগ্রাম-১৪, চট্টগ্রাম-১৫ ও চট্টগ্রাম-১৬ আসনের প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে চট্টগ্রাম-৪, চট্টগ্রাম-৫, চট্টগ্রাম-৮, চট্টগ্রাম-৯, চট্টগ্রাম-১০ এবং চট্টগ্রাম-১১ আসনের প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা ও বিভাগীয় কমিশনার মো. আব্দুল মান্নান।
Advertisement
মতবিনিময় সভায় চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং) আসনের বিএনপির প্রার্থী আবদুল্লাহ আল নোমান অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে ঘরে থাকতে পারিনি। আমার স্থারব-অস্থাবর সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে আমার নির্বাচনী এলাকার নেতাকর্মীরাও ঘরে থাকতে পারছেন না। ১৬ ডিসেম্বর প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে বিজয় দিবসের র্যালি আয়োজন করেছিলাম। সেই র্যালিতে হামলা হয়েছে। আমি জীবনঝুঁকিতে ছিলাম। আমাকে কর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধার করেছে।’
‘আমাকে গুলি করার জন্য উদ্যত হয়েছিল। পত্রিকায় এসেছে কি না জানি না, তবে আমার কাছে ছবি আছে। নির্বাচনী এলাকায় আমার পোস্টার-ব্যানার তুলে ফেলে দেয়া হচ্ছে। শুধু আওয়ামী লীগের কর্মীরা করছে সেটা বলছি না, পুলিশও ধানের শীষের পোস্টার-ব্যানার দেখলে ফেলে দিচ্ছে। নির্বাচন করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। মানুষের মধ্যে শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ছে। পুলিশে একটু অদল-বদল করেন। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাঠান,’-বলেন আবদুল্লাহ আল নোমান।
অপরদিকে চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর) আসনে মহাজোট মনোনীত প্রার্থী এম এ লতিফ এমপির পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক অহীদ সিরাজ চৌধুরী স্বপন।
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের মাঠে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। চট্টগ্রাম-১১ আসনে নির্বাচন আচরণবিধি কোনোভাবেই লঙ্ঘন হয়নি এবং হবে না বলে প্রশাসন ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন এম এ লতিফ।’
Advertisement
পরে চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনের বিএনপির প্রার্থী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এই মুহূর্তে এমন একটা ভয়ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মধ্যে প্রশ্ন, ভোট দেয়া যাবে কি না ? বিএনপির নেতাকর্মীদের হুমকি দেয়া হচ্ছে- এলাকা ছেড়ে চলে যাও। গায়েবি মামলা দেয়া হচ্ছে। ৩০ তারিখের (ডিসেম্বর) আগেই যেন সব বিচার শেষ করে ফেলা হবে!’
প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা কেন পার্টির হচ্ছেন? আমরা তো আপনাদের সম্মান করি, আপনাদের বিশ্বাস করি। আপনারা কেন রাজনৈতিক দলের পক্ষ নেবেন? দয়া করে গ্রেফতার অভিযানটা বন্ধ করুন।’
এ সময় ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে প্রার্থীর সব প্রতিনিধির সামনে ব্যালট বাক্স ভোটারের সংখ্যা অনুযায়ী গণনা করে নেয়ার প্রস্তাব করেন আমীর খসরু।
চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী) আসনের বিএনপি প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি কারাগারে থাকায় তার পক্ষে বক্তব্য দেন অ্যাডভোকেট বদরুল আনোয়ার। তিনি ইভিএমের পাশাপাশি ব্যালট পেপারও রাখার অনুরোধ জানান। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এই আসনে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোটার নিরক্ষর ও বস্তিবাসী।
অপরদিকে এ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, ‘বিএনপির প্রার্থীরা ভোটারদের মধ্যে ভয়ভীতি থাকার কথা বলছেন। আমার নির্বাচনী এলাকায় তো আমি ভোটারদের মধ্যে কোনো ভয়ভীতি দেখছি না। এলাকায় সব প্রার্থীর পোস্টার আছে। ইভিএম নিয়ে অপপ্রচার হচ্ছে। বিশেষ করে নারীদের বলা হচ্ছে, ইভিএম নাকি খুব কঠিন। এটাতে ভোট দিলে নাকি একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রার্থীই শুধু জিতবেন। এই অপপ্রচার বন্ধে নির্বাচন কমিশনকে পদক্ষেপ নিতে হবে।’
এ সময় চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী) আসনের এক স্বতন্ত্র প্রার্থী ইভিএমের ব্যবহার সম্পর্কে যথেষ্ট ট্রেনিং দেয়ার জন্য বিভাগীয় কমিশনারের কাছে অনুরোধ করেন।
চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসনের বিএনপির প্রার্থী আবু সুফিয়ান বলেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকা চান্দগাঁওয়ের পাঁচটি ওয়ার্ডে নারকীয় তাণ্ডব চলছে। প্রতিদিন রাতে পুলিশ যাচ্ছে। বাড়িঘরে হামলা হচ্ছে, নেতাকর্মীদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। আমরা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই।’
অপরদিকে, নৌকা মার্কার মহাজোট প্রার্থী মঈনউদ্দিন খান বাদল বলেন, ‘মতের ভিন্নতা নিয়েই তো আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনে এসেছি। তারা বলবে নির্বাচনের পরিবেশ নেই। আমরা বলব, আছে। তারা বলবে, মানুষের মধ্যে ভয়ভীতি আছে। আমরা বলব, নেই। প্রার্থীর সঙ্গে প্রার্থীর এই মতভিন্নতা না থাকলে আমরা পরস্পরের বিরুদ্ধে নির্বাচন করছি কেন? আমার নির্বাচনী এলাকায় সুষ্ঠু পরিবেশ বিরাজমান।’
তবে চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসনের ইসলামিক ফ্রন্ট প্রার্থী সিহাব উদ্দীন মো. আবদুস সামাদ বলেন, ‘জনগণের মাঝে অজানা উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।’
চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) আসনে ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মো. ইব্রাহীম বলেন, ‘এলাকায় পোস্টার লাগাতে না দেয়া, পা ভেঙে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। কর্মীরা যাতে আতঙ্কে না থাকে সেদিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। মামলা-হামলা-ধমকের কারণে নেতাকর্মীদের মাঠে পাচ্ছি না। অভিযোগ করতে গিয়ে আমার থানার ওসিকে স্টেশনে পাওয়া যায় না। তিনি মন্ত্রীর সঙ্গে ব্যস্ত থাকেন।’
ওই আসনের খেলাফত আন্দোলনের মিনার প্রতীকের প্রার্থী মাঈনুদ্দিন রুহী বলেন, ‘সারাদিন ভোট দেয়ার পর রাতে যাতে ফলাফল পাল্টে না যায়, সেটার ব্যবস্থা করতে হবে।’
তবে বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনের এনামুল হক এনাম জানান, ‘তিনি এলাকায় কোনো বাধা পাচ্ছেন না। নির্বিঘ্নে প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারছেন।’
প্রার্থীদের অভিযোগ শুনে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিকারের আশ্বাস দিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান বলেন, ‘অতীতের ১০টি সংসদ নির্বাচনের চেয়ে একাদশ সংসদ নির্বাচন অনেক বেশি আলোচিত। সব দলের অংশগ্রহণের কারণে সব শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। উৎসবমুখর পরিবেশ আমরা বজায় রাখতে চাই। রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একচোখা আচরণ নয়, সবার প্রতি সমান আচরণ করতে চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময়ে অনেক কথা উঠে এসেছে। অনেকে অনেক অভিযোগও করেছেন। সব কথা, সব অভিযোগ আমরা গুরুত্বসহকারে নোট নিয়েছি। নির্বাচনী প্রচারণায় যাতে কারও সমস্যা না হয়, সবার প্রতি যাতে সমান আচরণ করা হয় তা নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করব। সবাই মিলে একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দেব।’
আবু আজাদ/জেডএ/পিআর