মতামত

নাম কী, জেনে রাখবো, দেখে নেবো, খামোশ; গণতন্ত্রের নতুন অভিধান!

আমরা নিজেদের গণতন্ত্রী বলে দাবি করি; কিন্তু গণতন্ত্রের মূল কথা যেটি বহুমত-ভিন্নমত, তার প্রতি আমাদের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই। ভিন্নমতেই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। বহুমতেই গণতন্ত্রের এগিয়ে চলা বিকাশ।

Advertisement

গণতন্ত্রে মত থাকবে, দ্বিমত থাকবে; যুক্তি থাকবে, পাল্টা যুক্তি থাকবে। কিন্তু আসলে নেই। আমরা মুখে বলি গণতন্ত্র, কিন্তু কার্যত বিশ্বাস করি প্রতিহিংসায়। ফেসবুকে কেউ কিছু লিখলে, তার সাথে আমার ভিন্নমত থাকলে, যুক্তি দিয়ে ভিন্নমতটা তুলে ধরার কথা। কিন্তু কারো যুক্তি পছন্দ না হলে যুক্তি-টুক্তি আমরা ভুলে যাই; ভান্ডারে যত গালি আর যত হুমকি আছে; সব উগড়ে দেই।

আমরা ক্ষমতায় গেলে জিব ছিঁড়ে ফেলবো, মেরে ফেলবো, দেশছাড়া করবো; এই হলো আমাদের কল্পনা। যেন কোনো দল ক্ষমতায় আসবেই এইসব প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে। অবশ্য প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে তো আর কেউ বসে নেই।

আপনি প্রতিপক্ষ দলের, আপনাকে আমার পছন্দ নয়; ব্যস আপনার প্রচারণায় বা গাড়িবহরে হামলা করে দিলাম। এখন একপক্ষের জোর বেশি, তারা বেশি হামলা করছে। আরেকপক্ষ অপেক্ষা করছি, এ ধরনের হামলার শক্তি অর্জনের। জোর যার মুল্লুক তার।

Advertisement

বিএনপি ক্ষমতায় এলে প্রথম দিনেই এক লাখ লোক মারা যাবে; আওয়ামী লীগ নেতারা এমন একটা আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরির চেষ্টা করছিলেন। সারাক্ষণ তারা কর্মীদের বলছেন, ক্ষমতায় আসতে না পারলে সব ধ্বংস হয়ে যাবে, পালাবার পথ পাবে না।

নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ এমন কিছু করেছে, যাতে তারা ভয় পাচ্ছে, পালাবার পথ খুঁজছে। এই সময় যেন আওয়ামী লীগের ত্রাণকর্তা হয়ে মাঠে নামলেন ড. কামাল হোসেন। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন প্রক্রিয়ায় ড. কামাল হোসেনসহ ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বারবার বলছিলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলে বিএনপি নয়, ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতায় আসবে।

ঐক্যফ্রন্ট প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। তাই আওয়ামী লীগের ভয় নেই। কথা শুনে মনে হতেই পারে, আওয়ামী লীগের জন্য একটা সেফ এক্সিট নিশ্চিত করতেই মাঠে নেমেছে ঐক্যফ্রন্ট। তবে ড. কামালের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়াটা আমার দারুণ লেগেছে।

এমনিতে বাংলাদেশে দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ-বিএনপি সারাক্ষণ যুদ্ধংদেহী মনোভাবে থাকে। দুই পক্ষের দাঁতের নিচেই প্রতিহিংসার বিষ। এই যখন অবস্থা, তখন দুই দলের মাঝখানে একটা ভালো 'শক অ্যাবজর্ভার' দরকার ছিল। যিনি বা যারা দুই পক্ষের ধাক্কাধাক্কি, মারামারিতে একটা মধ্যস্ততা করতে পারবেন।

Advertisement

আওয়ামী লীগ-বিএনপি এমন দুই মেরুর দল যে দেশী-বিদেশী, জাতিসংঘ-যুক্তরাষ্ট্র কেউই তাদের এক টেবিলে বসাতে পারেনি, সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। সেখানে ড. কামাল যেন জাদু দেখালেন। তার দেয়া সংলাপের চিঠিতে প্রায় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখালেন প্রধানমন্ত্রী।

সংলাপ হলো। পুরোটা না হলেও বরফ অনেকটাই গললো। সব দল নির্বাচনে এলো। এখনও নির্বাচনী পরিবেশ ঠিক হয়নি, প্রতিদিন হামলা-মামলা-ধরপাকড় চলছে। তবু সব দল যে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, তার কৃতিত্ব অনেকটাই ড. কামাল হোসেনের।

তারা বারবার বলছেন, কোনো দলকে ক্ষমতায় আনতে বা কাউকে ক্ষমতা থেকে হটাতে নয়, তাদের সংগ্রাম গণতন্ত্রের জন্য। মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। শুনে আমরা আমরা আশ্বস্ত হয়েছিলাম, যাক, দেশে এখনও ড. কামালের মত গণতন্ত্রী আছেন। তাহলে আমরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারি।

কিন্তু ভরসার জায়গাটা ড. কামাল তছনছ করে দিলেন এক লহমায়। বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে বেরোনোর পথে সাংবাদিকরা ড. কামালকে ঘিরে ধরেন। ঘিরে ধরাটাই স্বাভাবিক। তিনি সরকার বিরোধী বৃহত্তর জোটের নেতা। তার কাছে সাংবাদিকদের অনেক প্রশ্ন।

বুদ্ধিজীবী দিবসে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটাই করেছেন সাংবাদিকরা। জামায়াতের ব্যাপারে ঐক্যফ্রন্টের অবস্থান কী? তাতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন দেশের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। জ্বলে ওঠার কারণটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কারণ এই প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই। তবে তিনি চুপ করে থাকতে পারতেন, এড়িয়ে যেতে পারতেন, নো কমেন্টস বলতে পারতেন। কিন্তু তিনি যা করলেন, তাতে নিমেষেই উড়ে গণতন্ত্রের মুখোশ, চুপসে গেল আমাদের আশার বেলুন।

ঐক্যফ্রন্ট গঠন প্রক্রিয়ায় অনেকবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছেন ড. কামাল হোসেন। প্রত্যেকবারই বিপুলসংখ্যক সাংবাদিকের উপস্থিতি দেখে আত্মতৃপ্তির সুরে বলেছেন, আপনাদের উপস্থিতিই প্রমাণ করে আমাদের লড়াইটা কত গুরুত্বপূর্ণ।

সাংবাদিকদের প্রশংসা করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলতেন ড. কামাল। কিন্তু যেই তার অপছন্দের প্রশ্ন এলো, অমনি তিনি আবির্ভূত হলেন স্বরূপে। বিএনপি বা আওয়ামী লীগের কোনো নেতা বা কোনো রাস্তার মাস্তানও সাংবাদিকদের এভাবে হুমকি দেয় না।

তোমার নাম কী, কোন পত্রিকায়, জেনে নিলাম, দেখে নেবো; এটা স্পষ্টতই হুমকি। তার মানে ড. কামাল হোসেনরা ক্ষমতায় সাংবাদিকদের খবর আছে, তাদের দেখে নেবেন। অনেকে বলছেন, সাংবাদিকরা তাকে উত্ত্যক্ত করেছে। প্রথম কথা হলো, সাংবাদিকরা যে প্রশ্ন করেছে, তা ন্যায্য। জবাব না পাওয়া পর্যন্ত, এই প্রশ্ন তারা করতেই থাকবে। তাতে আপনি উত্ত্যক্ত হয়ে উত্তপ্ত আচরণ করলে তো আমাদের কিছু করার নেই।

ড. কামাল সারাক্ষণ মুখে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলবেন, আর তাকে কেউ অপছন্দের প্রশ্ন করলে 'খামোশ' বলে মুখ বন্ধ করে দিতে চাইবেন; এটা স্পষ্ট স্ববিরোধিতা। সবাইকে সবার কথা বলতে দিতে হবে। সাংবাদিকদের ধমক দেয়ার পর, হুমকি দেয়ার পর, খামোশ বলার পর ড. কামালের আর গণতন্ত্রের বুলি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা মানায় না। ড. কামাল গণতন্ত্রের অভিধানে নতুন কিছু শব্দ যুক্ত করলেন।

ড. কামাল হোসেন অগণতান্ত্রিক আচরণ করার কয়েক মিনিটের মধ্যে তিনি নিজেও অগণতান্ত্রিক আচরণের শিকার হয়েছেন। বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার পরপরই আওয়ামী লীগ সমর্থকরা তার গাড়িবহরে হামলা চালিয়েছে। ড. কামালের আচরণ যেমন নিন্দনীয়, তেমনি তার গাড়ি বহরে হামলাও নিন্দনীয়।

ড. কামাল হোসেনের গাড়িবহরে হামলার তীব্র নিন্দা জানাই। যারা এ হামলার সাথে জড়িত অবিলম্বে তাদের খুঁজে বের করে গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছি। মতের সাথে না মিললেই যদি হামলা করেন, তাহলে আর নির্বাচনের দরকার কি? সবকিছু গায়ের জোরে দখল করে ফেললেই হয়। যদি আন্তরিকভাবে ভালো নির্বাচন, তাহলে ভিন্নমতের ওপর সব ধরনের হামলা বন্ধ করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে কঠোর হাতে সব দমন করতে হবে।

খামোশ' যেমন গণতন্ত্রের ভাষা নয়, তেমনি হামলাও গণতন্ত্রের ভাষা হতে পারে না। 

এইচআর/জেআইএম