মতামত

আপিল নিষ্পত্তিতে ইসির ভূমিকা এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড

মনোনয়পত্র বাতিলের হিড়িকে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন নানা তুলেছেন। ছোটো-বড় নানা কারণেই বিভিন্ন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে। যৌক্তিক ও আইনসিদ্ধ কারণে মনোনয়ন বাতিল করার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের রয়েছে।

Advertisement

কিন্তু বিএনপি’র অভিযোগ ছিল দেখে দেখে শুধু তাদের প্রার্থীদের মনোনয়নই বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু কোন দলের কতজনের মনোনয়ন বাতিল করা হলো সেটি মূল বিষয় নয়। মূল বিষয়টি হলো মনোনয়ন বাতিল করার গ্রাউন্ড বা কারণগুলো যৌক্তিক ও অভিন্ন (ইউনিফর্ম) কিনা। কত টাকার বিল খেলাপি সেটি বড় কথা নয়, বড় কথা হলো বিল খেলাপি হলে মনোনয়ন বাতিল করা হবে কিনা।

মনোনয়ন বাতিলে কমিশনের সমন্বয়হীনতার কিছু বাস্তব কারণ রয়েছে। মূলত কিছু রিটার্নিং কর্মকর্তার মনোনয়নপত্র বাতিলের ক্ষেত্রে অপরিণামদর্শীতা ও হোমওয়ার্কের অভাবেই এমন ঘটনা ঘটেছে। সেগুলো এখানে আলোচনা না করেই বলা যেতে পারে যে কমিশন প্রার্থীদের আপিলের ভিত্তিতে অনেক মনোনয়নপত্র গ্রহণ করার ফলে তাদের সে সমন্বয়হীনতা অনেকটাই ঘুচে গেছে। কিন্তু তারপরও কমিশন কিছু রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেয়ার বিষয়টি পুনঃবিবেচনা (রিভিউ) করতেই পারে।

নির্বাচন কমিশনে মোট আপিল জমা পড়েছিল ৫৪৩টি। এর মধ্যে প্রার্থীতা ফিরে পেয়েছেন ২০৪ জন যাদের মধ্যে বেশির ভাগই বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্টের। ফিরে পাওয়া প্রার্থীদের মধ্যে অনেকে আবার হেভিওয়েট বা আলোচিত প্রার্থী। এদের মধ্যে অনেকে আবার আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বীও। কমিশন নিরপেক্ষ না হলে এসব হেভিওয়েটদের মনোনয়ন ফেরত দিত না। আপিল নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে এটি তারই প্রমাণ।

Advertisement

এক্ষেত্রে তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ নেই। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও কমিশনে ন্যায়বিচার পেয়েছেন বলেই মন্তব্য করেছেন। তাই বলা যেতে পারে, প্রথম দিকে নির্বাচন কমিশনের কাজে কিছু সমন্বয়হীনতা থাকলেও আপিল নিষ্পত্তিতে পেশাদারিত্ব দেখিয়ে তারা প্রাথমিক ধাক্কাটি ঠিকই সামলে নিতে পেরেছে। এটি কমিশনের একটি সাফল্য।

ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে নির্বাচনে মাঠের লড়াই। এ লড়াইয়ে নির্বাচনের জন্য সমতল মাঠ সৃষ্টি করা কমিশনের দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলতে বাধ্য করা কমিশনের একটি বড় কাজ। সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা কমিশনের জন্য হয়তো সহজ কাজ নয়। কিন্তু আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রশ্নে সবার বিরুদ্ধে সমান প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে কমিশনকে এগিয়ে আসতে হবে। আশা করি, কমিশন মনোনয়পত্রের আপিল নিষ্পত্তিতে যেমন সাফল্য দেখিয়েছে আচরণবিধি প্রতিপালনেও একই সাফল্য দেখাতে পারবে।

আচরণবিধি পালন করতে রাজনৈতিক দল তথা প্রার্থীদেরকে বাধ্য করা কমিশনের এখতিয়ারে মধ্যে পড়ে। আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তে কমিশনকে আরও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কমিশন আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করার জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এ কমিটিকে অভিযোগ তদন্ত ও নিষ্পত্তিকরণে পেশাদারিত্ব প্রদর্শন করতে হবে।

এসব অভিযোগের ব্যাপারে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে তাদের এগিয়ে আসতে হবে। একাজে কমিশনের লোকবল ও লজিস্টিকের অভাব রয়েছে আমরা জানি। এক্ষেত্রে সরকার ও বিচার বিভাগের সাথে কমিশন বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে প্রয়োজনীয় লোকবল বা লজিস্টিক সহায়তা চাইতে পারে। কমিশন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য যা যা প্রয়োজন তা সরকারের কাছে চাইতে পারে। এবং সংবিধান অনুযায়ী সরকারও সেসব সহায়তা প্রদান করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।

Advertisement

আমাদের নির্বাচন কমিশন সেই অর্থে সার্বভৌম নয় আমরা জানি। কমিশনের নিজস্ব সচিবালয় থাকলেও তার কাজ সম্পন্ন করতে সরকারের সাহায্য নিতে হয়। একটি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কমিশনের রয়েছে অনেক কাজ। এটি একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। যেমন, হলফনামায় ভুল তথ্য দেওয়ার কারণে প্রার্থিতা যেকোনো সময় বাতিল হতে পারে। কিন্তু এ কাজটি করার মতো লোকবল ও লজিস্টিকস ও সময় কমিশনের নেই।

কাজেই উপযুক্ত লোকবলের সমন্বয় ঘটিয়ে হলফনামা, ব্যাংক হিসাব, নির্বাচন পরিচালনার খরচ এবং সম্পদ, দায়দেনা– সংক্রান্ত বিবরণীগুলো যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেয়া কমিশনের জন্য যথেষ্ট কঠিন একটি কাজ। এছাড়া আচরণবিধি, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের প্রশ্নতো আছেই।

কমিশনের কর্মযজ্ঞ যেমন ব্যাপক তেমনি এর স্টেকহোল্ডারও অনেক এবং তাদের অধিকাংশই পরস্পর বিরোধী প্রতিপক্ষ। এসবের মধ্যেই কমিশনকে ভারসাম্য বজায় রেখে তার নিজের কাজটি সমাধা করতে হয়। এছাড়া রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন প্রেসার গ্রুপগুলোও কমিশনকে নানাভাবেই চাপের মধ্যে রাখে। সেকারণেই কমিশনকে তার এসব সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখে আইন ও বিধি অনুযায়ী চলাই শ্রেয়।

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে ভোটারদের মাঝে আস্থা সৃষ্টি করা কমিশনের দায়িত্ব। সরকার একাজে কমিশনকে সাহায্য করবে মাত্র। কিন্তু মূল কাজটি কমিশনকেই করতে হবে। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাবেন কিনা সে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তাদের ভোটের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করার দরকার নেই। নির্বাচনী প্রচারাভিযানকালেই তারা অনুমান করতে পারবেন ভোটের ভবিষ্যত।

ফলে আগামী ২০ দিন কমিশনের কার্যকলাপ ও প্রশাসনের মনোভাবই বলে দেবে ভোট কেমন হবে। একটি নির্বাচনে ক’টি দল অংশগ্রহণ করলো তার চেয়েও বড় বিষয় কত ভোটার সে নির্বাচনে ভোট দিতে পারলো। ইতোমধ্যে দেশে ভোটের জন্য একটি উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সবার মুখেই এখন ভোটের বয়ান।

কমিশন তার অর্জিত সাফল্য যাতে ধরে রাখতে পারে সেজন্য কাজ করে যেতে হবে। এটা আমাদের প্রত্যাশা। তফসিল থেকে চুড়ান্ত মনোনয়ন পর্যন্ত প্রক্রিয়ায় কমিশন তার প্রথম চ্যালেঞ্জটি যেভাবেই হোক মোকাবেলা করতে পেরেছে এবং সাফল্যও দেখিয়েছে।

দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি হলো নির্বাচনী প্রচারাভিযানকালে আচরণবিধি প্রতিপালনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা। আশা করি, কমিশন এখানেও সফল হবে। আর শেষ চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে ভোটের দিন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সুষ্ঠু ভোট সম্পন্ন করা ও তার ফলাফল প্রকাশ করা। আপিল নিষ্পত্তির সাফল্যের এ ধারাবাহিকতা বহমান ধাকুক পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়াতেই, এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম