খেলাধুলা

ফ্লোরিডায় পারলে দেশের মাটিতে কেন পারবে না টাইগাররা?

‘আরে ভাই! টেস্ট আর ওয়ানডেতে আগের সেই রমরমা দিন আর নেই। তারপরও টি টোয়েন্টি ফরম্যাটে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এখনো দারুণ দল। রীতিমত বিপজ্জনক। বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়নও। এই ফরম্যাটে ক্যারিবীয়দের হারানো সহজ কম্ম নয়।’

Advertisement

টি-টোয়েন্টি সিরিজ শুরুর ২৪ ঘণ্টা আগে অফিসিয়াল প্রেস কনফারেন্সে বাংলাদেশের কোচ স্টিভ রোডসের মুখেও সে কথা। সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের প্রেস বক্সেও আজ সকাল থেকে এ প্রশ্ন উঠল।

এটা সত্য ওয়েষ্ট ইন্ডিজের আগের সেই রমরমা দিন ও একচেটিয়া প্রাধান্য, কর্তৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব আর নেই। ৭০ ও ৮০‘র দশকের দুরন্ত, দূর্বার ও দুর্দমনীয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ এখন শুধুই অতীত। সেই ক্লাইভ লয়েড, রিচার্ডস, গ্রিনিজ, হেইন্স, কালিচরন, রিচার্ডসন, রজার হরপার, গাস লোগি, জেফরি ডুজন, মাইকেল হোল্ডিং, অ্যান্ডি রবার্টস, জোয়েল গার্নার, কলিন ক্রফট, কার্টলি এ্যামব্রোস আর ম্যালকম মার্শালের ওয়েষ্ট ইন্ডিজ-নাম শুনলেই বুক কাঁপতো।

বিশ্ব ক্রিকেটের প্রথম দুই বারের (১৯৭৫ ও ১৯৭৯) চ্যাম্পিয়ন। তারপর ব্রায়ন চার্লস লারা, কার্ল হুপার ও কোর্টনি ওয়ালশরা বিশ্বসেরা হতে না পারলেও দল হিসেবে ছিলেন দারুণ; কিন্তু সময়ের আবর্তে সে গুলো এখন শুধুই অতীত। তারপর যতই সময় গড়াচ্ছে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ততই কেমন যেন অগোছালো, ছন্নছাড়া দল।

Advertisement

এখন টেস্ট আর ওয়ানডেতে সে অর্থে কর্তৃত্ব নেই। তবে একমাত্র টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটেই ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ এখনো বিপজ্জনক দল। বিশ্বসেরাও।

ক্রিস গেইল, এভিন লুইস, কাইরন পোলার্ড, আন্দ্রে রাসেল, ডোয়াইন ব্রাভো, কার্লোস ব্র্যাথওয়েট আর সুনিল নারিনরা মিলে অন্তত ২০ ওভারের ক্রিকেটে পূর্বসুরীদের নাম ডাক ও খ্যাতি অক্ষুন্ন রাখার প্রাণপন চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

কিন্তু তারাও দলে নিয়মিত নেই। আজ আছেন তো কাল নেই। এক সিরিজে ওপরের ওই চার-পাঁচ তারকার সবাই আছেন, পরের সিরিজেই দেখা গেল তিন-চারজন নেই।

বোর্ডের সাথে যখন তখন চুক্তি, বেতন ভাতা ও আনুসাঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে মত পার্থক্য ও দ্বন্দ্ব এবং ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের প্রতি অতিমাত্রায় আকৃষ্ঠ হওয়ার কারণেই গেইল, এভিন লুইস, আন্দ্রে রাসেল, কাইরন পোলার্ড, ডোয়াইন ব্রাভো ও সুনিল নারিনরা প্রায় অনিয়মিতই হয়ে গেছেন।

Advertisement

ওপরে যাদের নাম বলা হলো তার বড় অংশ বাংলাদেশের বিপক্ষে এ সিরিজেও নেই। গেইল, পোলার্ড, ডোয়াইন ব্রাভো, নারিন আর আন্দ্রে রাসেলদের কেউ নেই। আছেন শুধু এভিন লুইস আর কার্লোস ব্র্যাথওয়েট। যেহেতু মাত্র ১২০ বলের খেলা, এখানে টেকনিক, কৌশল, লক্ষ্য-পরিকল্পনা ও ছকের পাশাপাশি শারীরিক শক্তি ও সক্ষমতাও একটা বড় সহায়ক উপাদান।

‘পাওয়ার হিটিং’টা ক্যারিবীয়দের বড় সম্পদ ও শক্তি। বিশ্বের যে কোন ক্রিকেট দলের চেয়ে ওয়েষ্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটারদের গড়পড়তা উচ্চতাও বেশি। লম্বা চওড়া, শক্ত সামর্থ্য এবং সুগঠিত শরীর দলটির একটি বিশেষ প্লাস পয়েন্ট এবং সেই সুবাদে পেশি শক্তির ব্যবহারে পাওয়ার হিটিং- ‘বিগ হিটিং অ্যাবিলিটিও’ বেশি।

তাদের মাঝ ব্যাটে লাগা হিট মাঠের বাইরে গিয়ে ছিটকে পড়ে। ঠিকমত না লাগা বা মিসহিটও অনেক সময় ছক্কা হয়ে যায়। সেটা শুধুই বাড়তি শারীরিক সক্ষমতা বেশি বলে। ১২০ বলে গোটা দশেক ছক্কাই বদলে দিতে পারে খেলার চালচিত্র।

এ কারণেই কে আছে, আর কে নেই? সেটা খুব ধর্তব্য নয়। বড় কথা হলো, ২০ ওভারের ক্রিকেটে সত্যিই ওয়েস্ট ইন্ডিজ অন্যরকম দল। সেই দলকে হারানো আসলেই টেস্ট আর ওয়ানডের তুলনায় কঠিন ।

কিন্তু ইতিহাস তা বলছে না। পরিসংখ্যান দিচ্ছে আশার আলো। খুব বেশিদিন আগে নয়, এইতো মাত্র তিন মাস আগে (আগস্টে) বাংলাদেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে টি-টোয়েন্টি সিরিজে হারিয়ে এসেছে।

ক্যারিবীয় দ্বীপ সেন্ট কিটসে তিন ম্যাচের সে সিরিজের প্রথমটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৭ উইকেটে জিতলেও ফ্লোরিডায় শেষ দুই ম্যাচে টাইগারদের ব্যাট ও বলের নৈপুণ্যের দ্যুতির কাছে হেরেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। যথাক্রমে ১২ ও ১৯ রানে জিতেছে সাকিবের বাংলাদেশ।

৪ আগস্ট ফ্লোরিডার লডারহিলে বাংলাদেশ জয়ী হয় তামিমের অনবদ্য ব্যাটিং আর অধিনায়ক সাকিবের চৌকশ নৈপুণ্যে। ৪৪ বলে চার ছক্কা ও ছয় বাউন্ডারিতে ৭৪ রানের ঝড়ো ইনিংস উপহার দিয়ে ম্যাচ সেরা হন তামিম। সাকিব ৩৮ বলে ৬০ রানের আক্রমণাত্মক ইনিংস খেলার পাশাপাশি ৪ ওভারে ১৯ রানে দুই উইকেট দখল করেন।

ঠিক পরদিন, ৫ আগস্ট দল জেতাতে মূখ্য ভূমিকা রাখেন লিটন দাস। ৩২ বলে ছয় বাউন্ডারি ও তিন ছক্কায় ৬১ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে ম্যাচ সেরাও হন লিটন। পেসার মোস্তাফিজ দারুণ বোলিং (৩/৩১) করে সাফল্যে রাখেন কার্যকর অবদান। সাকিবও বেশ সুনিয়ন্ত্রিত (৪ ওভারে ১/২২) বোলিং করেন।

শেষ ম্যাচে আন্দ্রে রাসেল ২১ বলে ছয় ছক্কা হাঁকিয়ে ৪৭ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে ভয় জাগিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারেননি। এ সিরিজে সেই অন্দ্রে রাসেলও নেই। আছেন শুধু এভিন লুইস আর ব্র্যাথওয়েট। এ দু’জনার সাথে যোগ হবেন ওয়ানডে সিরিজ সেরা সাই হোপ। ছয়-ছয়বার মিরাজের বলে আউট হওয়া হেটমায়ারও আছেন।

কাজেই ফ্লোরিডার চেয়েও কাগজে-কলমে দুর্বল দল এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আর টেস্টের পর ওয়ানডে সিরিজ জিতে বাংলাদেশ যেন টগবগ করে ফুটছে। তামিম, সৌম্য, মুশফিক আর অধিনায়ক সাকিব সবাই রানে আছেন। অফ স্পিনার মিরাজ ওয়ানডেতে দারুণ বল করে পার্থক্য রচনায় রেখেছেন বড় ভূমিকা। স্লো পিচে মিরাজের টাইট ও বুদ্ধিদীপ্ত অফ স্পিন বোলিং ক্যারিবীয় বধে কার্যকর হবে- এমন আশা অনেকেরই।

সবচেয়ে বড় কথা খেলাটা ঘরের মাঠে। উইকেট, পারিপশ্বিকতা- সবই অনুকুল। চেনা-জানা। সেই ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফির ভাষায় বলতে হয়, ‘সীমিত ওভারের ফরম্যাটে টিম বাংলাদেশের সামর্থ্য এখন আগের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ দল এখন যে কোন বড় শক্তিকে হারানোর ক্ষমতা রাখে। দরকার শুধু সামর্থ্যের সঠিক ও যথাযথ প্রয়োগ।’

এই সিলেটে শেষ ওয়ানডেতেই মিলেছে তার প্রমাণ। উইকেট আর পরিবেশের সাথে মিল রেখে সাজানো একাদশ আর লক্ষ্য-কৌশল ও পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন ঘটেছে মাঠে। আর তাতেই ‘কেল্লা ফতে’। ভাল খেলতে পারলে তো কথাই নেই, সিলেট ও ঢাকায় ফ্লোরিডার পারফরমেন্স হলেই চলবে।

সাকিবের নেতৃত্বে সেই চনমনে, উজ্জীবিত, উদ্দীপ্ত, ভাল খেলতে দৃঢ় সংকল্পব্ধ আর জয়ের অদম্য বাসনার বাংলাদেশের দেখা মিললেই হবে।

এআরবি/আইএইচএস/আরআইপি