বিজয় দিবস এলেই সরাফত সাহেবের স্মৃতিগুলো মনে পড়ে। জীবদ্দশার শেষ বছরগুলোয় তাকে প্রায়ই হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যায় ভর্তি করা হতো।
Advertisement
জীবনের শেষ কিছু দিন খুব কষ্ট হলেও সরাফত সাহেব কৃত্তিম শ্বাস প্রশ্বাসে নিয়ে বাঁচতে চাননি। তখন তার মেজাজটাও খুব খিটমিটে থাকতো। অবশ্য এমনিতেই তিনি বেশ খিটমিটে স্বভাবের মানুষ ছিলেন। প্রথম পরিচয়ে তাকে বিশেষ কেউ পছন্দ করে কিনা এ ব্যাপারে আমার বেশ সন্দেহ আছে। অবশ্য তাতে তার কিছু আসে যায় নি।
আমার মনে আশা ছিল তিনি হয়তো এবার ফিরে আসতে পারবেন। অনেকবারই তিনি আমাকে অবাক করে দিয়েছেন। এবার তিনি পারলেন না।
সরাফত সাহেবের সাথে আমার পরিচয় প্রায় দশ বছর। সময় গড়িয়ে যাবার সাথে সাথে তার অনেক ইতিহাস আমি জেনেছি। বাড়ি তার দাউদকান্দিতে। গ্রামের ধনি পরিবারে মেধাবী ছাত্র হিসেবে কয়েক গ্রামের মানুষজন তাকে চিনতো।
Advertisement
যখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এলেন, তার আশা ছিল আকাশছোঁয়া। রাজনীতির ধার ধারতেন না। বন্ধুবান্ধবরা রাজনীতি করতো। তিনি পড়াশোনা করতেন। এরই মাঝে পরিচয় হলো রাবেয়ার সাথে। প্রথম দেখাতেই রাবেয়ার প্রেমে পড়ে গেলেন তিনি।
রাবেয়া করতেন প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতি। তিনি রাবেয়ার রাজনীতি দর্শনের ছায়াতে থাকতেন। তার বাইরে পা রাখতেন না তিনি। রাবেয়া যখন মিছিল মিটিংএ ব্যস্ত তখন তিনি পড়াশোনাতে।
এরই মাঝে তাঁর একটি সুযোগ এসে গেলো ফলিত রসায়নে উচ্চশিক্ষার। অনেক দূরে। কেমব্রিজে। রাবেয়াকে বললেন, চলো বিয়েটা সেরে ফেলি। রাবেয়া রাজি হলেন না।
তবে রাবেয়া কথা দিলেন তিনি অপেক্ষায় থাকবেন।
Advertisement
দু বছর পর ফিরে এলেন তিনি। রাবেয়া তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে তৃণমূল রাজনীতিতে ঢুকে গেছেন। রাবেয়ার কাছে বিবাহিত জীবন, ঘর বাঁধবার স্বপ্ন, বিলেতে যাবার স্বপ্ন কেবল বাতুলতা।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে ঢুকলেন। শুরু হলো ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান। আস্তে আস্তে তিনিও জড়িয়ে পড়লেন রাজনীতিতে অনিবার্যভাবে। ১৯৭১ এর ২৫ শে মার্চের কালো রাতের বীভৎসতা নিজ চোখে দেখলেন তিনি। রাবেয়া সে রাতে হারিয়ে গেলো তার জীবন থেকে। সে রাতে রাবেয়া ছিলেন আজকের রোকেয়া হলে।
রাবেয়াকে অনেক খুঁজেছেন তিনি। খুঁজতে খুঁজতে জড়িয়ে গেলেন মুক্তিযুদ্ধে। বনে বাদাড়ে দিনের পর দিন রাতের পর রাত কেটেছে তার ।
তার যুদ্ধে যাবার খবরটা জেনে যায় শান্তি বাহিনী। তার বাবা আর দু ভাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। যুদ্ধের মাঝে আহত হয়ে ফিল্ড হাসপাতালে ছিলেন অনেক দিন। প্রায় মরতে মরতে বেঁচে যান তিনি। বিজয় শেষে ফিরে আসেন নিজের গ্রামে। কিছুই ছিলো না তার তখন। ঘর পুড়ে গেছে , আপন আত্মীয় কেউ আর নেই। নেই রাবেয়া।
আবার ফিরে এলেন কেমব্রিজে। আসক্ত হয়ে গেলেন কাজ আর গবেষণার মাঝে। এরই মাঝে এক মার্কিন বিজ্ঞানীর সাথে পরিচয়। তারই আমন্ত্রণে পারডু বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এলেন তিনি।
সেখানেই পরিচয় আইরিনের সাথে। বুলগেরিয়ার অধিবাসী এ রমণীর মাঝে তিনি খুঁজে পেলেন রাবেয়ার ছোঁয়া। সময় পেলেই অনেক দূর গাড়ি চালাতেন আইরিনকে নিয়ে। একদিন ভয়াবহ এক সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ে গেলেন তিনি। তিনি বেঁচে গেলেও আইরিন বাঁচলো না। তারপর থেকে ভগ্ন স্বাস্থ্য তার। এর ওপর যোগ হলো মাদকাসক্তি।
এ শহরের কোনো বাঙালির সাথে মিশতে চান না তিনি। নিজেকে রাখতে চান অযত্নে অবহেলায়। কেবল শেষের প্রতীক্ষায়। নিজেকে সযত্নে দূরে রেখেছেন সবকিছু থেকে। স্মৃতিকে বড়ো ভয় পেতেন তিনি।
বিজয় দিবস এলেই তার মন ভীষণ এলোমেলো হয়ে যেতো। এবার আর তা আর হবে না। নিজের দেহটা তিনি দান করে গিয়েছেন মেডিক্যাল কলেজের গবেষণার জন্য। তাকে কেউ খুঁজে পাবে না।
অনেক সরাফত সাহেব এভাবে হারিয়ে যান। খ্যাতি, যশ, পার্থিব কোন কিছুই স্পর্শ করে না তাদের। কেউ জানতে পারে না তাদের।
আমি নিশ্চিত জানি ক্ষয় নেই তার।
‘ উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ‘ ভয় নাই, ওরে ভয় নাই — নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই। '
এইচআর/জেআইএম