বাংলাদেশিদের শ্রম অভিবাসনের ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার। দেশটিতে বৈধ-অবৈধ প্রায় ১০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি বসবাস করছেন এবং বিভিন্ন পেশায় কাজ করছেন। বাংলাদেশিসহ অবৈধ অভিবাসীদের ওপর কঠোর নজর রাখছে দেশটি। বাংলাদেশের অভিবাসী নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যও করছেন রক্ষণশীলরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশ একটি জনবহুল মুসলিম প্রধান দেশ। সেখানকার দরিদ্র লোকজন এমনি এমনি মালয়েশিয়ায় আসার কথা নয়। যারা দরিদ্র, মালয়েশিয়ায় আসতে জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন তাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন। কোনো মহল নেপথ্যে তাদের সহযোগিতা করছে।
Advertisement
মালয়েশিয়ায় আসতে অবৈধ অভিবাসীরা যে ৩-৪ লাখ টাকা দালালকে দিচ্ছেন, আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধপথে মালয়েশিয়া আসছেন এবং অবৈধভাবে বাস করছেন। মালয়েশিয়া সরকার সাফ জানিয়ে দিয়েছে- অবৈধ অভিবাসীদের বিষয়ে কোনো আপস নেই। গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত থাকবে। এরই মাঝে অবৈধদের বৈধকরণ প্রক্রিয়ার গুঞ্জন শোনা গেলেও অবশেষে তা আর হচ্ছে না। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মালয়েশিয়া সরকারের বেঁধে দেয়া এই সময়সীমার মধ্যে অবৈধ অভিবাসীরা ৪০০ রিঙ্গিত জরিমানা দিয়ে দেশে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ দিলেও অক্টোবর থেকে এ সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে অভিবাসন বিভাগ। বর্তমানে সহসা কেউ স্পেশাল পাস নিয়ে দেশে যেতে পারছেন না। এ নিয়ে মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশন সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে। অবৈধ বাংলাদেশিদের বৈধ করে নিতে হবে নতুবা অবৈধ কর্মীদের স্বল্পখরচে দেশে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবাসী বলছেন, ইচ্ছে করে কেউ অবৈধ হয়নি। দালালদের প্ররোচনায় পড়ে প্রতারণার শিকার হয়ে বাংলাদেশি কর্মীরা অবৈধ হয়েছেন। একদিকে পরিবারে অন্নদান অন্যদিকে ঋণগ্রস্ত প্রতারিত এসকল কর্মীদের বৈধতা না দিলে দেশে গিয়ে তারা কী করবে? এ বিষয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনকে শক্ত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানালে এ প্রবাসী।
এদিকে মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে বসবাসের অপরাধে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিভাগ ৪৫ হাজার ৪৯৯ জন অবৈধ অভিবাসীকে আটক করেছে। সম্প্রতি দেশটির পুত্রাজায়ায় অভিবাসন বিভাগের সদর দফতরে ‘অভিবাসন দিবস’ উদযাপন অনুষ্ঠান শেষে অভিবাসন বিভাগের মহাপরিচালক দাতুক সেরি মোস্তাফার আলি সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
Advertisement
মোস্তাফার আলি বলেন, সারা দেশে গত বছর মোট ১২ হাজারেরও বেশি অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে এক লাখ ৫৮ হাজার অভিবাসীর নথিপত্র যাচাইয়ের মাধ্যমে তাদের আটক করা হয়েছে। আটককৃতদের মধ্যে কতজন বাংলাদেশি রয়েছে তা জানা যায়নি।
দেশটিতে অবৈধ থাকা বিদেশি কর্মীদের বৈধ হওয়ার বিষয়টি দীর্ঘ আড়াই বছর ছিল আলোচনায়। অবৈধ কর্মীদের কাজ দেয়ায় এবং বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে এক হাজার ৩২৩ জন নিয়োগকর্তাকে আটক করা হয়।
অভিবাসন বিভাগের মহাপরিচালক মোস্তাফার আলি বলেন, অবৈধ অনুপ্রবেশ ও দেশটিতে অবৈধদের বসবাস ঠেকাতে বিভাগটি কাজ করছে এবং দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার তাগিদে কোনো পক্ষের সঙ্গে আপস করা হবে না।
চলতি বছরে ৭২ হাজার ৩৬১ জনকে পাসপোর্ট ও ভিসা জটিলতার কারণে অভিবাসন আইন ১৯৫৯/৬৩ এর ৮ (৩) ধারায় পাঁচ বছরের জন্য মালয়েশিয়া প্রবেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
Advertisement
এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের অধিকাংশ অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। অন্যান্য দেশের শ্রমিকের তুলনায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের পারিশ্রমিক খুবই কম। কিন্ত বাংলাদেশি শ্রমিকদের অভিবাসন ব্যয় সবচেয়ে বেশি এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা বিভিন্নভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। যেমন, অল্প পারিশ্রমিক, কারণ ছাড়া নোটিশে চাকরি থেকে প্রত্যাহার, সময়মতো বেতন না দেয়া, পরিমিত খাবার না দেয়া, স্বল্পস্থানে অনেক শ্রমিকের আবাস ও জোরপূর্বক চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া। বর্তমানে অভিবাসী শ্রমিকদের কম বেতন একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। এমতাবস্থায় অভিবাসন খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধিকরণে শ্রমিকের স্বার্থ ও অধিকারে সরকার, নিয়োগকর্তা, হাইকমিশন, এনজিও ও অভিবাসন শ্রমিকের মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন অভিবাসীরা।
মালয়েশিয়া প্রবাসী আজিজ উদ্দিন বলেন, একজন অভিবাসী ইচ্ছে করে অবৈধ হয় না। দালারচক্র ইচ্ছে করে তাকে অবৈধ করে। বৈধ করে দেয়ার নামে একজন শ্রমিকের কাছ থেকে পাসপোর্ট ও আট থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায়। তখন এই শ্রমিকের আর কিছু করার থাকে না। উদাহরণস্বরূপ আমি নিজেই। ২০১২ থেকে ২০১৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় ফেরারি হিসেবে কাজ করি। ১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মালয়েশিয়ান একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে কাজ করেছি।
অাজিজ বলেন, আমাদের বাংলাদেশি শ্রমিকরা যদি দালালের কাছে না গিয়ে দূতাবাসের পরামর্শে ভালো কোম্পানিতে বৈধতা নিতো তা হলে তাদের সমস্যা সৃষ্টি হতো না। অথচ শ্রমিকরা মালয়েশিয়া আসার আগে তাদের পরিবারের সদস্যদের বা আত্মীয়দের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে।
একটি গবেষণায় জানা গেছে, যে প্রায় ৩৫.৪ শতাংশ শ্রমিক পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে ঋণ নেয়, ১৮.৭ শতাংশ টাকা ধারক থেকে ঋণ নেয়, স্থানীয় ব্যাংক থেকে ৭.২ শতাংশ, ভূমি বন্ধক রেখে ২.৬ শতাংশ এবং বিদেশি ব্যাংক থেকে ০.৩ শতাংশ ঋণ নেয়।
মালয়েশিয়ায় অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন শাহ আলম হাওলাদার। তিনি বলেন, সরকার শ্রম মাইগ্রেশন খরচ সস্তায় সীমাবদ্ধতার মধ্যে আনতে, নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে, এবং অভিবাসন সমস্যা এবং পুনর্গঠন সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
একটি জরিপে দেখা গেছে, ২১৭ সালে দারিদ্র্যের হার ১৬.৫১ শতাংশ ছিল, ২০১৪ সালে এটি ১৯.৭০ শতাংশ ছিল, যা প্রতি বছর ১ শতাংশ হ্রাস পায়। কিন্তু দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে বিদেশি অভিবাসীরা উভয় অভ্যন্তরীণ ও অস্থায়ী পরিবারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
বিদেশি অভিবাসীদের মধ্যে, দারিদ্র্যের হার ৯.৬০ শতাংশ, অভ্যন্তরীণ অভিবাসীদের মধ্যে এটি ২৮.০৮ শতাংশ এবং অ-অভিবাসীদের জন্য এটি ১৭.৫২ শতাংশ। তুলনামূলকভাবে, ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত অভিবাসীদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ২৪ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ অভিবাসীদের মধ্যে ১২.৬৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, কিন্তু বিদেশি অভিবাসীদের ক্ষেত্রে এটি ৭.১১ শতাংশ কমিয়েছে।
বর্তমানে বিদেশি অভিবাসীদের গড় মাসিক আয় ৩২ হাজার ৮১৫ টাকা, যখন গড় মাইগ্রেশন খরচ প্রায় দুই লাখ ৭৬ হাজার টাকা। পুরুষ অভিবাসীদের গড় খরচ তিন লাখ ৪২ হাজার টাকা, মহিলা অভিবাসীদের জন্য এর গড় ৮৮ হাজার ৮৭৭ টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন মাইগ্রেশন, ঋণ এবং সুদের খরচ, এই দৃশ্যকল্প জন্য দায়ী।
মালয়া ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক মো. খালেদ শুকরান বলেন, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে মাইগ্রেশন খরচ বিশ্বের সর্বোচ্চ এবং বেতন পরিসীমা সর্বনিম্ন। অভিবাসন খরচ কমাতে পদক্ষেপ গ্রহণ না করা পর্যন্ত অভিবাসী পরিবারের সুবিধা হবে না। বাংলাদেশি অভিবাসীরা খুব কম টাকা উপার্জন করে এবং তাদের বেশিরভাগ উপার্জন পরিবারের জীবনযাত্রার ব্যয় বহন করতে ব্যয় করে। শুধু তাই নয় দেশের অর্থনীতির চাকাকে তারা সচল রেখেছে। তাদের সুবিধা-অসুবিধা দেখভালের দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়।
বিএ/এমএস