দেশের রাজনৈতিক দলগুলো কখনো কখনো ট্রাকে অস্থায়ী মঞ্চ বানিয়ে সমাবেশ করে থাকে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের সমাবেশেও এমনটিই করা হয়েছিল। খোলা ট্রাকে তৈরি মঞ্চে চেয়ার দেয়া হলেও সচরাচর টেবিল পাতা হয় না। কিন্তু সেদিন একটি টেবিলও পাতা হয়েছিল। ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার সময় সেই টেবিলের নিচে মাথা গুঁজে জীবন রক্ষা করেছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের অনেক নেতা জানিয়েছেন, সেদিন নেত্রী নিজেই খোলা ট্রাকরে মঞ্চের সামনে একটি টেবিল দিতে বলেছিলেন, যাতে পেছন থেকে ধাক্কাধাক্কিতে কেউ পড়ে না যায়। নেত্রীর কথায় ট্রাকে টেবিল দেয়া হয়েছিল। গ্রেনেড হামলা শুরু হলে কিছু সময় নেত্রী টেবিলের নিচে মাথা গুঁজে থাকলেন। মুহূর্তের মধ্যেই নেতা-কর্মীরাও মানববর্ম তৈরি করে গ্রেনেডের আঘাত থেকে নেত্রীকে অক্ষত রাখেন।তার পর মুহূর্তেই অন্য রকম প্রতিক্রিয়া দেখালেন শেখ হাসিনা। একদিকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের মৃত্যুকূপ থেকে নেত্রীকে বাঁচাতে নেতা-কর্মীরা অস্থির, মরিয়া। তাকে দ্রুত তোলা হয় মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িতে। গাড়িচালক মতিন নেত্রীকে নিয়ে ছুটে চললেন ধানমণ্ডির সুধা সদনের দিকে। অন্যদিকে নেত্রীর তাতে আপত্তি।ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন মায়ার মতে, শেখ হাসিনা তখন বলতে থাকেন, ‘গাড়ি থামাও, আমি সুধা সদন যাবো না, সবাইকে দেখে তারপর সুধা সদন যাবো।’ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে নেতা-কর্মীদের অবস্থা দেখতে তিনি ছিলেন অস্থির। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ থেকে ধানমণ্ডির সুধা সদনে পৌঁছা পর্যন্ত পথে বারবারই শেখ হাসিনা বলছিলেন, ‘গাড়ি থামাও, আমি যাবো না, সবাইকে দেখে তারপর যাবো।’ মানববর্ম তৈরি করে নেতা-কর্মীরা যেমন প্রিয় নেত্রীর জীবন রক্ষা করেছিলেন, তেমনি শেখ হাসিনাও ছিলেন নেতা-কর্মীদের জন্য ভীষণ উদ্বিগ্ন।বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর মৃত্যুকূপ থেকে সেদিন শেখ হাসিনাকে সুধা সদনে ফিরিয়ে নিতে অনেক কষ্ট হয়েছে বলে জানান মায়া ও মতিন। রাস্তায় আবারো কোনো হামলা হয় কি-না, সে আশঙ্কাও তাড়া করছিল তাদের মনে। মতিন বলেন, ‘আমার মধ্যে ছিল অন্য রকম চাপ। নেত্রীর গাড়ির চাকা গুলি লেগে পাংচার হয়ে গেছে। এরই মধ্যে দ্রুত বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ ত্যাগ করতে হবে। কীভাবে যে তা করেছি, ভাবতেই এখন গা শিউরে ওঠে।’মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, শেখ হাসিনার তখনকার নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, মেজর সোয়েব, মামুন ও জাহাঙ্গীর মিলে শেখ হাসিনাকে সেদিন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ থেকে সুধা সদনে রেখে আসেন। শেখ হাসিনা গাড়িতে উঠতে না চাইলেও তারিক আহমেদ সিদ্দিক ও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া সেদিন জোর করেই গাড়িতে তুলে দেন।২১ আগস্ট ২০০৪। দিনটি ছিল শনিবার। বিকেলে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে সন্ত্রাস ও বোমা হামলার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সমাবেশ। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়েছিল সেদিন। সমাবেশ শেষেই সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল হওয়ার কথা। তাই মঞ্চ নির্মাণ না করে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি ট্রাককে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সমাবেশে অন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্যের পর শেখ হাসিনা বক্তব্য দিতে শুরু করেন।সময় তখন বিকাল ৫টা ২২ মিনিট। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে বক্তৃতা শেষ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার হাতে থাকা একটি কাগজ ভাঁজ করতে করতে এগোচ্ছিলেন ট্রাক থেকে নামার সিঁড়ির দিকে। তখনই শুরু হল নারকীয় গ্রেনেড হামলা। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে লাগলো একের পর এক গ্রেনেড। মুহূর্তেই মৃত্যুপুরীতে পরিণত হলো বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। শেখ হাসিনাকে টার্গেট করে একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায় ঘাতকরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ১৩টি গ্রেনেড বিস্ফোরণের বীভৎসতায় মুহূর্তেই রক্ত-মাংসের স্তূপে পরিণত হয় সমাবেশস্থল। রক্তগঙ্গা বয়ে যায় এলাকাজুড়ে।ঘাতকদের প্রধান লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনা। বিষয়টি বুঝতে পেরে ট্রাকে অবস্থানরত আওয়ামী লীগ নেতারা ও শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিকভাবে মানবঢাল রচনা করে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন বঙ্গবন্ধুর এই কন্যাকে। নেতা ও দেহরক্ষীদের আত্মত্যাগ ও সৃষ্টিকর্তার রহমতে অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান শেখ হাসিনা।১৫ আগস্টের কালো রাতের মতো আরেকটি রক্তাক্ত আগস্ট ঘটাতে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে উপর্যুপরি ১৩টি গ্রেনেড মেরেই ক্ষান্ত হয়নি ঘাতকরা, গ্রেনেডের আঘাতে প্রাণ কেড়ে নিতে না পেরে সেদিন শেখ হাসিনার গাড়িতে বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়েছিল তারা। পরিকল্পিত ও টার্গেট করা ঘাতকদের নিক্ষিপ্ত গুলি ভেদ করতে পারেনি শেখ হাসিনাকে বহনকারী বুলেটপ্রুফ গাড়ির কাঁচ। শেখ হাসিনাকে আড়াল করে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে জীবন বিলিয়ে দেন তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী ল্যান্স কর্পোরাল (অব.) মাহবুবুর রহমান। নারকীয় এ হামলায় প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দের কারণে বাম কান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাম কানে শ্রবণশক্তি হারান তিনি। দেশে-বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার এতদিন পরও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারনেনি।পরিকল্পিত হামলায় মৃত্যুর দুয়ার থেকে শেখ হাসিনা ফিরে এলেও সেদিন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় পুরো এলাকা। এ ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলার পর সেদিন স্প্রিন্টারের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন বহু মানুষ। আকস্মিক মৃত্যু আর রক্তস্রোতে শান্তিপ্রিয় অসংখ্য মানুষের হাত-পাসহ মানবদেহের বিভিন্ন অংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে।কারও হাত নেই, কারও পা উড়ে গেছে। রক্তে ভিজে লাল হয়ে যায় পিচঢালা কালো পথ। সেদিন শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের মেরে ফেলাটাই ঘাতকচক্রের মূল পরিকল্পনা ছিল।এফএইচ/বিএ
Advertisement