মতামত

তোমাদের যা বলার ছিল

যারা নিজের জীবনের চেয়ে অনেক বেশি ভালোবেসেছিলেন এই দেশকে, যারা চাইলে হয়তো নিজের জীবনটাকে বাঁচাতে পারতেন শাসকের পদলেহন করে, যারা আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কোন আপোস করেননি, তারা আমাদের পরম গৌরব, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবী।

Advertisement

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের আনন্দের মধ্যেই জাতিকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে এক ভয়াবহ দৃশ্য। রায়ের বাজার, বসিলার বিল, মহম্মদপুরের বধ্যভূমি, কাঁটাসুরে আবিষ্কৃত হয়েছে বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহ। চোখ উপড়ানো, হৃদপিণ্ড তুলে নেওয়া, হাত বাঁধা, চোখ বাঁধা, দেহে সীমাহীন নির্যাতনের চিহ্ন বুকে নিয়ে জলকাদার মধ্যে পড়ে ছিল জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মৃতদেহ।

চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ, লেখক, সাংবাদিকসহ বুদ্ধিজীবীদের সুপরিকল্পিতভাবে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশকে মেধাহীন করে দেওয়ার জঘন্য নীল নকশা ছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তার। এই নীল নকশা বাস্তবায়ন করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হায়েনারা এবং তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামসের ঘাতক দালালরা।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে শুরু হয় বাঙালির উপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ। সেরাতেই হামলা চালানো হয় ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের ছাত্রাবাস ও আবাসিক এলাকায়। দার্শনিক গোবিন্দচন্দ্র দেব ও অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাসহ কয়েকজন শিক্ষক সে রাতেই শহীদ হন। তারপর নয় মাস ধরে চলা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়।

Advertisement

ডিসেম্বরে পরাজয় আসন্ন বুঝতে পেরে নতুন করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও তাদের এদেশীয় দোসররা। শিল্প সাহিত্য সাংবাদিকতাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে মেধাবী, সাহসী ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকা করা হয়। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী।

ডিসেম্বরের ১০ তারিখ থেকে শুরু হওয়া এই হত্যাকাণ্ডে সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, ডা. মুর্তজা, সেলিনা পারভীনসহ সারাদেশে এক হাজারের বেশি খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও সংস্কৃতিকর্মী শহীদ হন। শহীদদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন বামপন্থী এবং প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

পাকিস্তানিদের কাছে এই বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকা তুলে দিয়েছিলে তাদেরই সহকর্মী, চেনা পরিচিত, ছাত্র ও বন্ধুরা যারা ছিল জামায়াতে ইসলামী, রাজাকার, আলবদর, আল শামসের সদস্য। বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান ঘাতক ছিল বদর বাহিনীর চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খান। এবিএম খালেক মজুমদার, আবদুল কাদের মোল্লা, মাওলানা আবদুল মান্নানসহ আরও অনেকে প্রত্যক্ষভাবে হত্যাকারী। এদের মধ্যে কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়েছে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে। চট্টগ্রামে ফজলুল কাদের চৌধুরী, সাকা চৌধুরী (এরও ফাঁসি হয়েছে), গিয়াস কাদের চৌধুরীও ছিল ঘাতক।

বুদ্ধিজীবীদের ঘাতকদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু এখনও জীবিত। এই পিশাচগুলো এখনও আমাদের সমাজেই মুখোশ পরে বহাল তবিয়তে দিন কাটাচ্ছে। বুদ্ধিজীবী হত্যার মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে কয়েক প্রজন্মের জন্য মেধাশূন্য করার এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পূর্ণ বিচার আজও হয়নি। ঘাতক ও জড়িতদের নামের পূর্ণ তালিকা প্রকাশিত হওয়া উচিত ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধতা থেকেই।

Advertisement

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শহীদ বুদ্ধিজীবীর স্ত্রী, পরিজন ও সন্তানরা যে কঠিন পরিস্থিতির শিকার হন সেটিও ইতিহাসের অংশ। তাদের জীবন সংগ্রাম ছিল ভয়াবহ। বাবা-মাকে হারানোর বেদনার সঙ্গে যুক্ত ছিল আর্থিক সংকট। সেই ক্ষত তাদের বয়ে বেড়াতে হয়েছে প্রায় সারাজীবন। যেমন, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের একমাত্র সন্তান প্রয়াত সুমন জাহিদকেও সারাজীবন জীবিকার জন্য সংগ্রাম করতে হয়।

স্কুলে আমার সহপাঠী ছিলেন অর্ণব নীলিম যিনি শহীদ ডা. মুর্তজার সন্তান। আমি মিসেস মুর্তজাকে দেখেছি দুই সন্তানকে লালন পালনের জন্য তাকে কতটা সংগ্রাম করতে হয়েছে। সেইসঙ্গে বহন করতে হয়েছে অকাল বৈধব্যের যন্ত্রণা। আরও অনেক শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তানের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুবাদে দেখেছি তাদের মনোবেদনা ও জীবন সংগ্রাম। বুদ্ধিজীবী হত্যার পূর্ণাঙ্গ বিচারের মাধ্যমে শহীদের রক্তের প্রতি এবং তাঁদের পরিজনদের প্রতি সুবিচার করাটা জাতির কর্তব্য।

শহীদ বুদ্ধিজীবীরা কী চেয়েছিলেন? তারা চেয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ, চেয়েছিলেন শোষণমুক্ত সমাজ, চেয়েছিলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, বাংলা ভাষা ও বাঙালির সংস্কৃতির জয়। তাঁরা বৈষম্যহীন সমাজের আদর্শকে বুকে ধারণ করে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন সাহসের সঙ্গে। আজকের বাংলাদেশ কি তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে?

আমরা স্বাধীন স্বদেশ পেয়েছি সত্যি। কিন্তু এখনও সমাজে বৈষম্য, অবিচার, নারী নির্যাতন চলছে। এখনও মৌলবাদ তার অশুভ চক্রান্ত চালু রেখেছে। আজও পদে পদে মানবাধিকার লংঘিত হয়। এখনও সড়কে আশ্রয়হীন মানুষের দেখা মেলে। পথশিশুরা আজও শিক্ষাবঞ্চিত। যতদিন না আমরা সমাজের সর্বস্তরে মানবাধিকার নিশ্চিত করতে পারব, যতদিন না আমরা বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারব, যতদিন না আমরা বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারব, ততোদিন শহীদের আত্মা শান্তি পাবে না।

বাংলামায়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি কেবল লোকদেখানো শ্রদ্ধাজ্ঞাপন নয়, বছরে কেবল একটি দিন রায়ের বাজারের স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ নয়, বরং বাংলাদেশকে অগ্রগতির পথে নিয়ে যাওয়া, দেশের প্রতিটি মানুষের অধিকার সুনিশ্চিত করার মাধ্যমেই সম্ভব শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান।

আমরা সেই সুখী সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের প্রত্যাশা রাখি যেদিন আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে পারব। তাঁরা যে আদর্শের জন্য জীবন দিলেন সেই আদর্শকে যেদিন ধারণ করতে পারব, তাঁদের যা বলার ছিল সেদিন তা বলবে বাংলাদেশ।

লেখক : কবি, সাংবাদিক, বর্তমানে চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়া শিক্ষকতা করছেন।

এইচআর/পিআর