ড. তোফায়েল আহমেদ। উপাচার্য, বেসরকারি ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। লেখক, গবেষক, রাজনীতি ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ। নির্বাচন প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর। প্রশ্ন তোলেন নির্বাচনী পরিবেশ এবং নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে।
Advertisement
নির্বাচন আয়োজন এখন পর্যন্ত ‘সাজানো’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিরোধী পক্ষের সঙ্গে সরকার এবং নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে। রাজনীতির চলমান সংকট উত্তরণে সরকারের ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট, বলেও মত দেন। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি।
আরও পড়ুন >> সত্যিকার অর্থে নির্বাচন কমিশন কিছুই করছে না
জাগো নিউজ : গত পর্বে ভোট-নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের অনাগ্রহের কথা বলেছিলেন। পরিস্থিতির এমন ধারাবাহিকতায় বিরাজনীতিকরণ ঘটছে কি?
Advertisement
তোফায়েল আহমেদ : বিরাজনীতিকরণ না ঘটলেও সাধারণ মানুষ এখন রাজনীতি নিয়ে উদাসীন। রাজনীতি আর সাধারণ মানুষের কাছে নেই। এটি এখন ব্যবসায়ীদের কাছে। রাজনীতির আড়ালে তারা ব্যবসা চাঙ্গা করছেন। রাজনীতির সঙ্গে এখন নগদ অর্থের হিসাব-নিকাশ হচ্ছে। এগুলো ব্যাংকিং হিসাবে আপনি পরিমাপ করতে পারবেন না। হাজার হাজার কোটি টাকা ঘুষ হচ্ছে, তা কোনো ব্যাংকিং লেনদেনে নয়, গোপনে। রাজনীতিই এই গোপন পথ তৈরি করে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতারা বাইরে অর্থপাচার করছেন। বিদেশে একাধিক বাড়ি রয়েছে কারও কারও। হলফনামায় এসব সম্পদের কোনো হিসাব পাবেন না। এ নিয়ে কোনো তদন্তও নেই। এই কারণে সাধারণের আগ্রহ কমে যাচ্ছে নির্বাচন নিয়ে।
নেতারা মিডিয়ায় কথা বলতে অস্থির। অথচ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলছেন না। তাদের সমস্যা জানছেন না। নির্বাচনের ২০ দিন এলাকায় থাকবেন। জয়ী হয়ে ফের ঢাকায় চলে আসবেন। কর্মীরা ভোট করবেন। সাধারণরা কর্মীর কাছেও ভিড়তে পারবেন না। এই সিস্টেম তো দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। হঠাৎ করে এই কাঠামো ভেঙে মানুষ জাগ্রত হবে, তা আমি বিশ্বাস করি না। বাইরে ঘুরলেই সব বোঝা যায়।
নির্বাচন-ব্যবস্থাপনা আছে তা অস্বীকার করছি না। কিন্তু তার বিপরীতে ডি ফ্যাক্টো (চোরাপথ) সিস্টেমও কায়েম হয়েছে। অর্থাৎ একটি গ্রুপ ভোটগ্রহণ করে, অন্য গ্রুপ ম্যানেজ করে। আর ভোটাররা ভোট থেকে দূরে থাকেন। ২০১৪ সালের পর থেকে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিতে পারেননি, তা সবাই প্রত্যক্ষ করেছেন। রাতারাতি তো আপনি মানুষের মধ্যে বিশ্বাসের পরিবর্তন আনতে পারবেন না।
Advertisement
আরও পড়ুন >> নির্বাচনের কাঠামোই ভেঙে দিল কমিশন
সরকারি দলের বাইরে গেলে শাস্তি পেতে হয়, এটি শুধু ভোটের দিনের বিবেচ্য নয়। এই শাস্তি পুরো পাঁচ বছর ধরে চলতে থাকবে। এই শাস্তি মানুষ ভোগ করবে, নাকি নীরব থেকে নিজের বসবাস খানিক নিরাপদ রাখবে- এমন ভয়ের সংস্কৃতি পাঁচ বছরে তীব্র হয়েছে।
জাগো নিউজ : ভয়ের সংস্কৃতি ভোটের সংস্কৃতিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
তোফায়েল আহমেদ : ভবিষ্যতের কথা বলা মুশকিল। বর্তমানেই তো মানুষের চিন্তার পরিবর্তন হলো ভয়ঙ্করভাবে। মিডিয়া সাধারণের মতামত নেয়। এই মতামত অনেকটাই অসত্য। অনেকেই সত্য বলছেন না। বলেন, ভোটযোগ্য প্রার্থীকে দেব, ভোট সুষ্ঠু হবে। মিডিয়াতে প্রচার হয় এভাবেই। আসলে এটি অন্তরের কথা নয়। ভয়ে বলছেন এসব। আমি নিজে মাঠে গিয়ে এসব শুনেছি। তার মানে, জাতি মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, যেখানে মনের কথাটাও সাহস করে বলতে পারছে না কেউ।
জাগো নিউজ : মিথ্যার বেড়াজালে আটকা গণতন্ত্রের যাত্রা…
তোফায়েল আহমেদ : গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা আছে। কিন্তু সমাজের সব জায়গাতেই থমকে যাচ্ছে গণতন্ত্র। পরিবার, প্রতিষ্ঠান, সমাজ, রাষ্ট্র; কোথায় আছে গণতন্ত্র?
রাজনীতি ব্যবসার প্রধান হাতিয়ার হলে সাধারণ মানুষ তো রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখবে। তৃণমূলের সঙ্গে মিশলেই বোঝা যায়। অথচ মিডিয়ায় ভিন্ন সুর। এ কারণে মিডিয়ায় কথা বলা কমিয়ে দিয়েছি। ডাকলেও যাই না।
জাগো নিউজ : সমাধানের পথ কোথায়?
তোফায়েল আহমেদ : সংকট দীর্ঘদিন ধরে তৈরি হয়েছে। তবে সমাধান করতে হলে মূল দায়িত্ব সরকারকে পালন করতে হবে। মানুষকে সত্যিকার অর্থে ভোট দেয়ার সুযোগটা দিতে হবে। এখন পর্যন্ত যা হয়েছে, সেটা ভুলে যেতে হবে। মানুষের পছন্দের ওপর সবকিছু ছেড়ে দিতে হবে। ভোটের দিন আর কারসাজি করিয়েন না। ভোটারদের সামান্যতম শ্রদ্ধা করুন।
দায়িত্ব সরকারের, নির্বাচন কমিশনের। বিরোধী দলকে হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটতে দেয়া হয়েছে। এই অবস্থায় নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না।
আরও পড়ুন >> আকাঙ্ক্ষা তীব্র হলেই সংশোধন হবে রাজনীতি
জাগো নিউজ : দায় তো সবারই। ভোটাররাও এই দায় এড়াতে পারেন না…
তোফায়েল আহমেদ : অবশ্যই। শুধু গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ঘরে বসে থাকলে চলবে না। দায় সবারই। আমার অধিকার ভোগ করতে আমাকেও দায়িত্ব পালন করতে হবে। অনেকেই ভোট কেন্দ্রে যেতে চান না। বিত্তশালীর ছেলে-মেয়েরা মনে করেন, আমার তো অভাব নেই। ভোট নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কী? এটি সুস্থ চিন্তার কথা নয়। একে দেশপ্রেম বলে না। এই মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
মানুষ যে একেবারেই নামছে না, তা নয়। কুমিল্লা, সিলেটে মানুষ ভোটে অংশ নিয়েছে। আবার বরিশাল, খুলনা, গাজীপুরে তো বিরোধী পক্ষ লাখ লাখ ভোট পেল।
জাগো নিউজ : তার মানে মানুষই শেষ ভরসা?
তোফায়েল আহমেদ : আমি মানুষের প্রতি আশা হারাতে চাই না। মানুষ সুযোগের অপেক্ষায়। সবাই মিলে সেই সুযোগ কাজে লাগালেই হলো। মানুষ অবশ্যই বেরিয়ে আসবে। মানুষের দ্বার বন্ধ হলে ফলাফল ভালো হয় না।
সরকার বৈধতার আড়ালে সন্ত্রাস করছে। সন্ত্রাস বলতে আমরা সন্ত্রাসীদের অবৈধ কার্যকলাপ বুঝে থাকি। শুধু তা-ই নয়। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে খুন, গুম, হামলা হচ্ছে। জবাবদিহিতা নেই। বিচার নেই। এসবও সন্ত্রাসের মধ্যে পড়ে।
জাগো নিউজ : অনেকেই ভোট, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সমাজ-ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করছেন…
তোফায়েল আহমেদ : সমাজ ওই পর্যায়ে যাক আমি তা প্রত্যাশা করি না। এখনকার মানুষের সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবার নিয়ে যে মনোভাব, তা যদি ১৯৭১ সালে থাকতো তাহলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। দেশ স্বাধীন হবে কি, হবে না- তা না ভেবেই তখন মানুষ যুদ্ধে গেছে এবং জীবন দিয়েছে। এ কারণেই দেশ স্বাধীন হয়েছে।
আরও পড়ুন >> খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তাই শেখ হাসিনার বড় ভয়
এখন এক শ্রেণির মানুষ মনে করছেন, গণতন্ত্রের দরকার নেই। পেটে খাচ্ছে বলে পিঠে কিল খাওয়ার জন্য মানুষ এখন অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে।
জাগো নিউজ : এই অবস্থায় বাঙালি তো দীর্ঘদিন থাকেনি?
তোফায়েল আহমেদ : অতীতে দাঁড়িয়ে কথা বলে লাভ নেই। চোখ বন্ধ করে মানুষ এখন হাঁটতে চায়, খেতে চায়। এ সংখ্যা ৩০ শতাংশ হলেও সমাজের আর ভবিষ্যৎ থাকে না। মানুষ এখন মুক্তি চায় চুপ থাকার মধ্যে। পাশেই একজন মরে পড়ে আছে, অথচ এগিয়ে আসছে না। বিরাজনীতিকরণ সমাজে বিমানবিকরণের জন্ম দিচ্ছে বলে মনে করি।
রাজনীতিই সমাজকে বর্বর করে তুলছে। সমাজ চিরদিন এক জায়গায় থাকেও না। মানুষের ভোগ, সম্পদ বাড়ছে। কিন্তু চেতনায় পেছনের দিকে যাচ্ছে। আগে ভোগের থেকে ত্যাগের মহিমা বেশি ছিল। এখন রাজনীতি ভোগের মহিমা শেখায়। যার বেশি সম্পদ আছে তাকেই মনোনয়ন দেয়া হচ্ছে, মানুষও তাকেই ভোট দেবে। যার গাড়ি-বাড়ি নেই সে ভোট পাবে না।
এএসএস/এমএআর/জেআইএম