একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপর্ব শেষ। শুরু হয়েছে প্রচারপর্ব। ৩০ ডিসেম্বর ভোটপর্বে অংশ নেয়ার জন্য দেশবাসী উন্মুখ হয়ে আছে। এই অবস্থায় দুটো দিক খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
Advertisement
প্রথমত, সামরিক শাসন নেই, নেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার, দলীয় সরকার ক্ষমতায়, সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে দেশে ভোট হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের আগে কোনো আন্দোলন নেই, শান্তিপূর্ণভাবে সংলাপ হয়েছে, স্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই দুই অবস্থায় নির্বাচন ১৯৭৩ সালের পর আর হয়নি। বিষয়টি দেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও অগ্রযাত্রার ইতিহাসে তাৎপর্যপূর্ণ এবং একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল এবং সব দলের অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে নির্বাচন হয়েছিল। তারপর ১৯৭৯ ও ১৯৮৬ সালের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংসদ নির্বাচন সামরিক আইনের মধ্যে যথাক্রমে সেনাশাসক জিয়া ও এরশাদের আমলে সংঘটিত হয়েছিল। দুই নির্বাচনের আগেই কমবেশি আন্দোলন হয়েছিল এবং এর মধ্যে এরশাদের আমলের নির্বাচন বিএনপি নির্বাচন বয়কট করেছিল।
Advertisement
১৯৮৮ সালে এরশাদ আমলের চতুর্থ সংসদ নির্বাচন হয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৮ দল, বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দল ও বামপন্থীদের ৫ দলের আন্দোলন ও নির্বাচন বয়কটের ভেতর দিয়ে। অন্দোলনের পটভূমিতে ১৯৯১ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সব দলের অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।
১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে দলীয় সরকার বিএনপি ও জিয়ার অধীনে আন্দোলন বয়কট ও ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। চার মাস পর জুনে আন্দোলনের পটভূমিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এবং আন্দোলন ছাড়া স্বাভাবিক অবস্থায় ২০০১ সালে সব দলের অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
২০০৮ সালে আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট ও আগুন সন্ত্রাসের ভেতর দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়।
সংসদ নির্বাচনের এই ইতিহাস দেখিয়ে দিচ্ছে, ৪৫ বছর তথা ১৯৭৩ সালের পর এই প্রথম সংবিধানের ভিত্তিতে দলীয় সরকারের অধীনে আন্দোলন না থাকা অবস্থায় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রথমে সেনাশাসক এরশাদ ও পরবর্তী সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোট নেতা খালেদা জিয়ার পক্ষে সম্ভব হয়নি, শান্তিপূর্ণভাবে সংবিধানের ভিত্তিতে সব দলের অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের। তারা দুজন অবশ্য সরকারপ্রধান হিসেবে সব দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে চেষ্টা করেননি কিংবা করার মতো ইচ্ছা বা অবস্থানও তাদের ছিল না।
Advertisement
কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হাসিনা অনেক চেষ্টা করেছিলেন সব দলকে নির্বাচনে আনতে। কিন্তু সম্ভব হয়নি। পুরো নির্বাচন পর্বই তখন ছিল দুঃস্বপ্নের মতো, নাশকতামূলক আগুন সন্ত্রাস নির্বিচারে চালিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোটের ক্যাডার-সন্ত্রাসীরা নিরীহ মানুষ-পুলিশ হত্যা ও বাস-ট্রাক পুড়িয়ে তাণ্ডব চালিয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তিতে একইভাবে যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে রাস্তায় নেমে আগুন সন্ত্রাস চালিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট নীলনকশা করেছিল যে, শেখ হাসিনা সরকারকে এখনই ক্ষমতা থেকে নামতে হবে এবং ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ কোনো ক্রমেই দেয়া হবে না। নির্বাচন বয়কট করা, সরকার পতন ইত্যাদি কত বড় বড় কথাই না খালেদা জিয়া বাইরে থাকতে তিনি নিজে আর দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেলে যাওয়ার পর বিএনপি নেতারা বলেছেন।
কিন্তু বাস্তবে এর উল্টোটাই ঘটেছে। বিএনপি-জামায়াত জোট আদালতের রায়ে নেত্রী খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পরও আন্দোলন কিংবা আগুন সন্ত্রাসের পথে না গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপের ভেতর দিয়ে সংবিধানের ভিত্তিতেই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এই উল্টো ঘটনা একটা বিষয়কে সুদীর্ঘ বছর পর সোজাভাবে সুস্পষ্ট করেছে। তা হলো শেখ হাসিনাই এখন দেশের একমাত্র নেতা যিনি দেশে আন্দোলনের নামে যে কোনো যড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও অরাজকতা-অস্থিরতা-অস্থিতিশীলতার পাঁয়তারা বন্ধ করতে পারেন এবং সংবিধান অনুযায়ী দেশকে পরিচালিত করতে পারেন।
প্রসঙ্গত, এটা কার না জানা এবং স্বতঃসিদ্ধ যে, প্রথমত অর্থনীতি ও রাজনীতি একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত ও পরিপূরক, প্রথমটা বেসিক স্ট্রাকচার আর দ্বিতীয়টা সুপার স্ট্রাকচার। দ্বিতীয়ত, আমাদের মতো দেশগুলোর পক্ষে বর্তমান দুনিয়ায় নানামুখী ঝড়ঝাপ্টা ও চাপের মধ্যেও উন্নতি-সমৃদ্ধি এবং জনগণের জীবন-জীবিকার মানোন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন টেকসই উন্নয়নমুখী ও জনকল্যাণমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপযোগী স্থায়ী রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এটা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সংসদীয় গণতন্ত্র আমাদের জাতীয় পছন্দ এবং জাতীয় চার মূলনীতির এক নীতি। সংসদ ও সংসদ নির্বাচনের বাইরে গিয়ে স্থায়ী রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো পথ খোলা নেই।
উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় সেনাশাসক এরশাদ ৯ বছর দেশ চালিয়েছিলেন এবং তখন দুর্নীতি-লুটপাটের মধ্যেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু উন্নয়ন হয়েছিল। কিন্তু গণরোষ ও আন্দোলন ধাক্কা দিতেই ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল এরশাদ।
কারণ তখন আমাদের জাতীয় পছন্দ, জাতীয় চার মূলনীতির এক নীতি আর সেই সঙ্গে উন্নয়নের উপযোগী রাজনৈতিক ব্যবস্থা তথা সংসদীয় গণতন্ত্র ছিল না। একই সঙ্গে জাতীয় চার নীতির আরো দুই নীতি জাতিসত্তার স্মারক জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার নামগন্ধ তখন যেমন ছিল না, তেমনি অপর জাতীয় নীতি বঙ্গবন্ধু যাকে বলতেন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর (সমাজতন্ত্র শব্দটি হচ্ছে ক্ষুধা দারিদ্র্য শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্তির অভিব্যক্তি) বিষয়টিও তখন এরশাদের কাছে কোনো বিষয় ছিল না। বলাই বাহুল্য, জাতীয় চার নীতির যে কোনো এক বা একাধিককে আলাদা করে কিংবা এই চারের মধ্যে ভারসাম্য বিনষ্ট করে আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা স্থায়ী ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা টেকসই হতে পারে না। এই বিচারে রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভঙ্গুর হওয়াটা ছিল নিয়তির মতোই এরশাদের ললাটের লিখন।
এখানে বলতেই হয় যে, দুই পর্যায়ে খালেদা জিয়ার দশ বছরের শাসনামলে লুণ্ঠন ও সন্ত্রাসের মধ্যে উল্লেখ করার মতো তেমন উন্নয়নই হয়নি। বরং এই দুই আমলে গণতন্ত্রসহ জাতীয় চারনীতির বিপরীতমুখী কর্মকাণ্ডই সংঘটিত হয়েছিল। তাই ক্ষুদ্র কলামে ওই দুই আমল সম্পর্কে এখানে কিছু বলার সুযোগ নেই।
বলাই বাহুল্য, পঁচাত্তরে সপরিবারে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর পরাজিত শক্তি সুপরিকল্পিতভাবে দেশের অবস্থানকে ক্রমাগত পাকিস্তানি আমলের মতো প্রতিক্রিয়ামুখী করেছে। পরবর্তী সময়ে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ক্রমেই আরো দক্ষিণমুখী হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার উন্নয়নের উপযোগী গণতন্ত্রসহ জাতীয় চার নীতিতে যথাসম্ভব ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। আর তা পেরেছেন বলেই আন্দোলন বা অস্থিরতা-অরাজকতা ছাড়াই যেমন দশ বছর ধারাবাহিকভাবে দেশ ও জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে, ঠিক তেমনি সংবিধান অনুযায়ী সব দলের অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানও সম্ভব করে তুলছে।
বাংলাদেশ এখন কেবল সহস্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন তথা প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়ন সূচক বৃদ্ধি করে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বিস্ময় বা উন্নয়নের রোল মডেলই নয়; উগ্র সন্ত্রাস দমন, আইনসম্মতভাবে সমুদ্র বিজয়, আলোচনার মাধ্যমে সীমান্তবিরোধ নিষ্পত্তি ও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে শান্তি সমৃদ্ধি ও মানবতার দেশ হিসেবে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। দেশের ইতিহাসে এই অবস্থা ব্যতিক্রমী এবং অনন্য।
দেশকে এমন এক ভারসাম্যমূলক অবস্থান ও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিঃসন্দেহে কৃতিত্বের দাবিদার। এত বছর পর বিশ্ব সমাজের রীতি ও সংবিধান অনুযায়ী আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা স্বাভাবিকতা বজায় রেখে সব রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনী মাঠে নামিয়ে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রার ইতিহাসে যে উদাহরণ সৃষ্টি করলেন, তা দেশের রাজনীতির ইতিহাসে অমোচনীয় কালিতে লিপিবদ্ধ থাকবে।
এই কথাগুলো যখন বলা হচ্ছে, তখন আত্মসন্তুষ্টির কোনো অবকাশ নেই। সামনে অগ্রসর হওয়ার সময়ই আরো বেশি করে সীমাবদ্ধতা দুর্বলতা ও অপারগতাকে বিবেচনায় নিতে হয়। তাতে গতি বাড়ে, লক্ষ্যাভিমুখী পথ বন্ধুর না হয়ে প্রশস্ত ও আলোকিত হয়। বলাই বাহুল্য, বিগত দিনগুলোতে বাক-ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কার্যকর থাকলেও বিএনপি-জামায়াত জোটের তথাকথিত জনসমর্থনহীন আন্দোলনে বাধাবিঘ্ন কিছু ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো গণতন্ত্র কি আইনের ঊর্ধ্বে! আগুন সন্ত্রাস করতে যেমন রাস্তায় নামতে দেয়া যায় না, তেমনি যারা আগুন সন্ত্রাস করেছে কিংবা লুটপাট করেছে তাদের গ্রেপ্তার করাটাও আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য একান্ত প্রয়োজন এবং তা সরকারের কর্তব্য।
যদি বিএনপি-জামায়াত জোটকে ২০১৪ ও ২০১৫ সালের মতো রাস্তায় নামতে দেয়া হতো তবে কি বর্তমানে সব দলের অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে সংলাপ এবং নির্বাচন হতো? নিশ্চয়ই হতো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দরজা সংলাপের জন্য এখনো খোলা।
আর নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর তো দেখা যাচ্ছে, আইনের প্রয়োগ ছাড়া যেমন নির্বাচনে প্রার্থী হতে কারো বাধা থাকছে না, তেমনি নির্বাচন প্রচারণায়ও সব দল একইভাবে নামতে সক্ষম হচ্ছে। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন এখন হাত ধরাধরি করে অগ্রসর হচ্ছে। এ দুই ফ্যাক্টর অবারিত থাকার অর্থটাই কিন্তু তাই!
বিজয়ের মাস ডিসেম্বর এখন চলছে। বিজয়ের ৪৭ বছর কয়েকদিন পরই জাতি পালন করবে। দেখতে দেখতে অনেক সময় আমরা পার হয়ে এসেছি। স্বাধীনতার ৫০ বছর রজতজয়ন্তী সামনে। নির্বাচন সামনে রেখে তাই আজ প্রশ্ন আমরা কি জাতীয় চারনীতিকে বর্তমানের ভারসাম্যমূলক অবস্থায় রেখে চলব নাকি ভারসাম্য বিনষ্ট করব? উন্নয়ন ও অগ্রগতির স্বার্থে স্থিতিশীলতা বজায় রাখব নাকি অরাজকতা-অস্থিতিশীলতার দিকে দেশকে ঠেলে দিব?
এসব প্রশ্নের সমাধান হবে আগামী ৩০ ডিসেম্বর ভোটপর্বে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করা ভিন্ন বিকল্প নেই।
লেখক : রাজনীতিক।
এইচআর/পিআর