সিবাস্টিয়ান স্কিপার একজন জার্মান নির্মাতা। চলচ্চিত্র জগতে তার প্রবেশ অনেক আগেই ঘটে। তিনি একইসঙ্গে অভিনেতা, স্ক্রিপ্ট রাইটার ও পরিচালক। তাকে বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘ইংলিশ পেশেন্ট’ সিনেমাতে ছোট্ট একটি চরিত্রে দেখা গিয়েছিল। আজ তিনি একটি অসাধারণ সিনেমা বানিয়ে ফেললেন। ‘ভিক্টোরিয়া’। যে দুঃসাহস তিনি দেখিয়েছেন তা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নির্মাতারাও বানাতে কখনও সাহস করেনি।
Advertisement
কাহিনি সংক্ষেপঃ ‘ভিক্টোরিয়া’ নামের এক যুবতি মেয়ে বারে নাচানাচি করতে গিয়ে কিছু উদ্ভট মাতাল ছেলেদের সঙ্গে পরিচিত হয়। রাত তখন গভীর ও জার্মানির বড় রাস্তাগুলোও প্রায় ফাঁকা। উদ্ভট সেই দলটির সদস্য সংখ্যা ছিল ৪। তাদের মধ্যে একজন ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে খুব আন্তরিক সম্পর্ক করতে চায়।
ভিক্টোরিয়া দলটির সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করে এবং মিশে যায়। ভোর পর্যন্ত ভিক্টোরিয়া তার নতুন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় বেশ ভালো সময় কাটায়। কিন্তু, ভিক্টোরিয়া জানে না তার জন্য কি ভয়ানক ঘটনা অপেক্ষমান। চলচ্চিত্রটি বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘সিল্ভার বিয়ার’ পুরস্কার পায় তার আর্টিস্টিক অবদানের জন্য। পুরো সিনেমাটি এক শটে নেয়া হয় কোন কাট ছাড়া। যা চলচ্চিত্র ইতিহাসে খুবই বিরল। হাঙ্গেরিয়ান নির্মাতা প্রথম প্রয়োগ করেছিল তার ‘ম্যাকবেথ’ টিভি সিনেমায়। তারপর, প্রথম ফিচার সিনেমাতে মাইক ফিগিস নামের একজন আমেরিকান এক্সপেরিমেন্টাল বা ‘আভা-গার্দ’ সিনেমার পরিচালক নির্মাণ করেছিলেন ‘টাইমকোড’।
কিন্তু তা সফল হয়নি যদি-কিনা আর্টিস্টিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথম সাফল্য আনে ‘রাসিয়ান আর্ক’। সিনেমাটি এক শটে বা কোন কাট ছাড়া অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে নির্মাণ করেছিলেন বিখ্যাত রাশিয়ান নির্মাতা আলেকজান্ডার সকুরভ। কিন্তু, শুটিংয়ের পুরোভাগই ছিল পৃথিবীতে আয়তনের দিক থেকে সবচেয়ে বড় ‘হারমিতাজ’ মিউজিয়ামটির ভেতরের অংশকে কেন্দ্র করে যা-কিনা কিছু ডায়ালগ ভিত্তিক কাহিনির ওপর নির্মিত।
Advertisement
কোন ড্রামার খোজ মেলেনি এই সিনেমাতে। তবে বলতে হবে ‘রাশিয়ান আর্ক’ একটি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র ইতিহাসে। এরপর আরও অনেকেই এই চেষ্টা অব্যাহত রাখে এক শটে সিনেমা নির্মাণের দিকে নজর রেখে। প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল এবং ঐন্দ্রজালিক। মোটামুটি এক ধরনের পাগলামির আয়োজন, সিনেমা বানানোর জন্য।
কিন্তু, কিছু পাগল তো থাকতেই হবে না হলে চলচ্চিত্র বিকাশ কীভাবে অর্জন হবে? আর চলচ্চিত্র বিকাশ তো অনিবার্য। এক শটে সিনেমার মধ্যে ইরানের একটি চলচ্চিত্র উল্লেখযোগ্য ‘ক্যাট অ্যান্ড ফিশ’। ভিক্টোরিয়াকে বলতে গেলে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে এগিয়ে রাখা যায়, কারণ পুরো সিনেমাটির ভেতরে ড্রামা, অ্যাকশন, থ্রিলার সবই পাওয়া যায় যা-কিনা একশটে নির্মাণ হয়েছে।
প্রায় ১৪০ মিনিট ধরে চিত্রগ্রাহক স্টুরালা ব্র্যান্ডথ গ্রোভলেন শট নিয়েছিলেন এক যায়গা থেকে আরেক যায়গায় বলতে গেলে দৌড়িয়ে। এত বড় একটি যন্ত্র নিয়ে তিনি যেই নিখুঁত কান্ডটি করলেন তা সত্যি খুবই প্রশংসনীয়। সিনেমাতে জার্কিং খুবই কম। কন্ট্রেস্ট ও ফোকাসে কোন খুঁত নেই দেখে মনে হবে অন্যান্য সাধারণ কাজের মতন নিখুঁত।
পরিচালক নিজেও চিত্রগ্রাহকের পেছনে পেছনে দৌড়িয়েছে। যেহেতু, সিনেমা নির্মাণের পথটা কুসুমাস্তীর্ণ নয়, কন্টকাকীর্ণ। আমরা যেকোন সিনেমাকে হুট করে খারাপ বা বাজে বলে দিতে পারি ঠিকই কিন্তু আমরা মাঠে গেলে নিশ্চিত টের পাবো আসল পথটা কতটা বন্ধুর।
Advertisement
এই সিনেমা একটি নির্দিষ্ট সময়কে আটকিয়ে রেখেছে। এইখানে নেই কোন ইলিপসিস অথবা নেই কোন টাইম স্কিপিং। গভীর রাত থেকে শুরু করে সকাল পর্যন্ত নন-স্টপ শুটিং চালিয়ে যায়। লং টেইক যে সবসময়ই একটা রিয়েলেটি তৈরি করতে সক্ষম তা আবারও প্রমাণিত। পুরো স্টোরিটা কয়েকটা পেইজে লেখা হয়েছিল। কেবল ভাবটা অভিনয় করতে বলা হয়েছিল।
পুরো সিনেমা ইম্প্রোভাইজেশনের ওপর বানানো হয় যা সিনেমার ভেতরেও কিছুটা টের পাওয়া যাবে। তিনবার এই সিনেমার শট নেয়া হয় তিন দিনে। তার মধ্যে পরিচালক তৃতীয় শটটিকেই বাছাই করে নেন। এডিটরের শুধু কালার কারেকশন ছাড়া কোন কাজ ছিল না বলতে গেলে।
কারণ, সিনেমাতে একটাই মাত্র শট। আর অভিনয়ের তুলনা হয় না। বিশেষ করে ভিক্টোরিয়ার চরিত্রটি যে করেছে লাইয়্যা কোস্তা- তার অভিনয়কে আমি ১০ এ ১০ এ দিলাম। খুবই অত্যাচার হয়েছিল সিনেমার নির্মাণের সঙ্গে যারা সরাসরি যুক্ত ছিল। পুরো সিনেমাটি দারুণ উপভোগ করেছিলাম। খুশী হয়ে একটি নোট লিখেই ফেললাম। অপূর্ব!
লেখক: তারেক মাহমুদ, মালয়েশিয়ার মাল্টিমিডিয়া ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থী।
এমআরএম/পিআর