এস এম গোর্কি। দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার প্রধান ফটোসাংবাদিক। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন তিনি। খুব কাছে থেকে দেখেছেন সেদিনের বীভৎসতা। ওই দিনের ঘটনা নিয়ে সম্প্রতি জাগো নিউজের মুখোমুখি হন এস এম গোর্কি। জাগো নিউজ কার্যালয়ে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সাঈদ আরমান ও সায়েম সাবু।
Advertisement
জাগো নিউজ : ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আগ মুহূর্তে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার খুব কাছে থেকে ছবি তুলছিলেন। গ্রেনেড হামলায় আপনি নিজেও গুরুতর আহত হয়েছিলেন। ঘটনার বর্ণনায় কি বলবেন?
এস এম গোর্কি : আওয়ামী লীগ ওই দিন জঙ্গি ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী একটি শান্তি মিছিল করবে বলে আমাকে অফিস থেকে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়। মিছিলের পূর্ববর্তী একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে। সভার শুরু থেকেই আমি সেখানে অবস্থান নেই। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী) ভ্রাম্যমাণ মঞ্চ ট্রাকের ওপর উঠলেন। আইভি চাচী (আইভি রহমান), মতি আপা (মতিয়া চৌধুরী) আমার পাশে। কাজল (সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ) এবং সাভারের একজন মহিলা (ওইদিন গুরুতর আহত) আমার সামনে। ওরা বলছে ভাই আপনি লম্বা মানুষ। সামনে যাইয়েন না। আমরা দেখতে পাব না। আমি বললাম, দুটি ছবি তুলেই সরে পড়ছি।
জাগো নিউজ : মঞ্চের কতটুকু দূরত্ব থেকে ছবি তুলছিলেন?
Advertisement
এস এম গোর্কি : মঞ্চের সিঁড়ির কাছেই ছিলাম। ছবি নেয়ার জন্য পরে মঞ্চে উঠি। বিরোধীদলীয় নেত্রীর বক্তব্য শেষ হওয়ার আগে আমি তাকে অনুরোধ করলাম, আপা আরেকটি ভালো ছবি নেব। নেতাদের এমন অনুরোধ আমরা প্রায়শই করে থাকি। এক্ষেত্রে তারাও আমাদের সহযোগিতা করে থাকেন।
আমার অনুরোধে তিনি দাঁড়ালেন। তিনি বললেন, তোদের আর ছবি তোলা শেষ হয় না। আচ্ছা, তোল। দাঁড়ানোর ১০ সেকেন্ডের মধ্যেই প্রথম গ্রেনেডটি চার্য হয়।
জাগো নিউজ : গ্রেনেডগুলো কোন দিক থেকে নিক্ষেপ হল?
এস এম গোর্কি : আমরা বুঝতে পারিনি। আমরা মঞ্চের উপরে। প্রথম শব্দ শোনার পরপরই শেখ হাসিনাকে মানবপ্রাচীর করে নিরাপদ করা হলো। তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ভাই, মায়া ভাই, ব্যক্তিগত নিরাপত্তকর্মী মামুন ভাইসহ অনেকেই শেখ হাসিনাকে ঘিরে ফেললেন। তবে আমার মনে হয়েছে প্রথমে গ্রেনেডগুলো দক্ষিণ দিক থেকে এসেছে। এরপর কি হয়েছে, কোন দিক থেকে এসেছে, গুলি কোন দিক থেকে এল, তা কিছুই বুঝতে পারিনি। সবাই তখন দিকহারা। জাগো নিউজ : অমন শব্দে আপনারা কি মনে করেছিলেন?
Advertisement
এস এম গোর্কি : আমরা কেউই বুঝতে পারিনি, এটি গ্রেনেডের শব্দ। আমরা মনে করেছিলাম, ককটেল বা পটকা জাতীয় কিছু হবে। আমার ৩০ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে এরকম অনেক শব্দ বা হামলার ঘটনা দেখেছি। কিন্তু গ্রেনেড! কল্পনা করা যায় না।
আইভি রহমান নিচে দাঁড়িয়ে আছেন শেখ হাসিনাকে হাত ধরে নামাবেন বলে। কিন্তু তিনি হাত ধরার সুযোগ পাননি। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলার সঙ্গে সঙ্গেই বিকট শব্দ। সম্ভবত প্রথম গ্রেনেডটি ট্রাকের ডালার সঙ্গে লেগে নিচে বিস্ফোরিত হয়। ওটি ট্রাকের উপরে পড়লে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই মারা যেতেন। সঙ্গে আমরাও।
জাগো নিউজ : এরপর শেখ হাসিনা কোথায় গেলেন?
এস এম গোর্কি : মঞ্চের সামনে রক্তের বন্যা। শত শত মানুষ শুয়ে আছে। কে নিহত আর কে আহত বোঝার উপায় নেই। আমি নিজেও রক্তাক্ত। রক্তে সমস্ত শরীর ভিজে গেছে।
বুঝলাম, শেখ হাসিনাকে তার নিরাপত্তারক্ষীরা মঞ্চ থেকে নামিয়ে গাড়িতে ওঠালেন।
জাগো নিউজ : শেখ হাসিনার গাড়িতে গুলি হল কখন?
এস এম গোর্কি : মঞ্চ থেকে নামিয়ে তাকে গাড়িতে তোলা হচ্ছে, ঠিক তখনই পেছন থেকে গুলি করা হয়। গুলিতে শেখ হাসিনার নিরাপত্তাকর্মী কর্পোরাল মাহবুব ঘটনাস্থলেই মারা যান। জাগো নিউজ : মঞ্চ থেকে গাড়ি কত দূরে ছিল?
এস এম গোর্কি : একেবারে কাছেই। মঞ্চ থেকে সর্বোচ্চ সাত গজ দূরে হবে হয়ত। শেখ হাসিনার গাড়িটি বুলেট প্রুফ ছিল বলেই তিনি প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন। গাড়ির বডিতে, গ্লাসে, টায়ারে গুলি লাগলেও বুলেট প্রুফ ছিলো বলে চলে যেতে পেরেছে।
জাগো নিউজ : বিরোধীদলীয় নেত্রীর জনসভা। ওইদিন নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন ছিল?
এস এম গোর্কি : বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল, তা বলা যাবে না। একটি জনসভাকে কেন্দ্র করে পুলিশের যে তৎপরতা থাকে, তার চেয়ে কম ছিল বলেই মনে হয়।
জাগো নিউজ : গ্রেনেডের স্প্লিন্টার আপনার শরীরের কোথায় লেগেছিল?
এস এম গোর্কি : মাথা থেকে পা পর্যন্ত অনেকগুলো স্প্লিন্টার ঢুকে যায়। এখনো অর্ধশত স্প্লিন্টার শরীরে আছে বলে ডাক্তারি পরীক্ষায় ধরা পড়েছে। তবে তা শরীরের জন্য মারাত্মক কোনো ঝুঁকি নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
জাগো নিউজ : আপনি কোথায় গেলেন?
এস এম গোর্কি : পুলিশের এসআই (সম্ভবত মোশাররফ নাম হবে) আমাকে টান দিয়ে তাদের গাড়িতে ওঠালেন। সাধারণ পুলিশের গাড়ি মনে করে জনগণ তখন ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে শুরু করল। উপায় না দেখে চালক বাইতুল মোকাররম মসজিদের সামনে দিয়ে সোজা না গিয়ে পল্টন মোড়ের দিকে গেলেন। ইতোমধ্যে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চালক গাড়ি আইল্যান্ডের উপরে উঠিয়ে দিলেন। পরে ক্যামেরাম্যান জেমস আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। জেমস-এর কাছে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। ঢামেকে গিয়ে আমি আমার স্ত্রীকে ফোন করি। ঢাকা মেডিকেলের কথা শুনে সে দৌঁড়ে আসে। আমি হুইল চেয়ারে রক্তাক্ত অবস্থায় বসা। তখন একের পর এক আহতরা আসতে শুরু করেছে। ঢামেক যেন এক মৃত্যুপুরী। রক্তের গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে। আমার স্ত্রীও রাজনীতি করে। যারা আসছে সবাই তার পরিচিত। আমার স্ত্রী দিশেহারা। পরে সেখান থেকে জেমস আমাকে শমরিতা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানেও জায়গা হয় না।
এর মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা সুভাষ সিংহ রায় আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, ভাই আপনার জন্য ধানমন্ডির ৫ নম্বরে সাউথ এশিয়ান হাসপাতালে ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরে পপুলার ডায়াগনেস্টিক সেন্টারে গিয়ে জরুরি এক্স-রে করে সাউথ এশিয়ান হাসপাতালে চলে গেলাম। আমার পূর্ব পরিচিত চিকিৎস্যক অধ্যাপক কাজী শহিদুল ইসলাম এসে নিজের হাতে আমার চিকিৎসা প্রদান করেন। জাগো নিউজ : আহতদের চিকিৎসার ব্যাপারে সরকারের বিশেষ কোনো সহায়তা বা নজরদারি ছিল কিনা?
এস এম গোর্কি : সরকারের বিশেষ কোনো সহায়তা ছিল বলে আমার কাছে তেমন মনে হয়নি। সরকারের বিশেষ নজরদারি থাকলে তো আমরা ঢাকা মেডিকেলেই উন্নত চিকিৎসা পেতাম। ডাক্তাররা স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি নিয়েছে বলে মনে হয়েছে। তবে আমি চলে আসার পর কি হয়েছে, তা বলতে পারব না। আর সত্যি কথা বলতে কি, শত শত মানুষ আহত। চিকিৎসকরা তো বসে থাকার কথা নয়। তারা তাদের মতো করেই সেবা দিয়েছে। একসঙ্গে এত মানুষকে সেবা দিতে হিমশিম খেতেই হয়।
তবে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর নিহত, আহতদের সব সময় খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখনো আমাদের খবর রাখেন।
জাগো নিউজ : সেই দিনকার দুঃসহ স্মৃতি এখন আপনাকে কতটুকু তাড়া করে?
এস এম গোর্কি : এটি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। ওই ঘটনা মনে পড়লে আবেগ সংবরণ করতে পারি না। আল্লাহর অশেষ রহমতে প্রাণে বেঁচে আছি। নইলে আজ আমারও মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হত। সেদিন যারা চলে গেছেন, তাদের স্বজনরা কি বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছেন তা বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই।
সর্বোপরি আমি সবার উদ্দেশ্যেই বলব, রাজনীতির নামে এমন পাষণ্ডতা, বর্বরতা যেন জাতিকে আর না দেখতে হয়। এএসএস/এসএইচএস/একে/পিআর