মতামত

আওয়ামী লীগের জন্য যা ঝুঁকির বিএনপি’র তাই-ই প্রাপ্তি

মাত্র মাস খানেক আগেও আমরা ভাবতে পারিনি যে, বাংলাদেশে সকল দলের অংশগ্রহণে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বিশেষ করে দুর্নীতির দায়ে বেগম খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড হওয়ার পর থেকে বিএনপি নেতৃবৃন্দ ও সমর্থকদের কাছ থেকে কেবলই এই হুমকি শোনা যাচ্ছিলো যে, বেগম জিয়াকে কারাগারে রেখে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হবে না, কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।

Advertisement

সত্যিইতো, বেগম জিয়ার মতো রাজনৈতিক নেতৃত্ব, যাকে বলতে গেলে বাংলাদেশের অর্ধেক মানুষ নেতা বলে স্বীকার করেছে, তাকে নির্বাচনের বাইরে রেখে কী করে বাংলাদেশে নির্বাচন হয়? ফলে এক ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তা নিয়ে ক্রমশঃ সময় এগিয়ে আসছিলো নির্বাচনের দিকে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মেনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার নির্দিষ্ট তারিখ থাকে।

বাংলাদেশেও সে তারিখ যতোই এগিয়ে আসছিলো ততোই শঙ্কা সকলের মনে বদ্ধমূল হচ্ছিলো যে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও দেশ চরম অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে এবং জনগণের নিরাপত্তা চরম ভাবে বিঘ্নিত হবে। কিন্তু শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বার বারই একথা জোরের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছিলো যে, যতো কিছুই হোক তারা বাংলাদেশকে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেবেন এবং তাতে যদি বাংলাদেশের মানুষ তাদেরকে নির্বাচিত না-ও করে তাহলেও তারা সে নির্বাচন মেনে নিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসবেন।

বিএনপি’র পক্ষ থেকে এই বক্তব্যকে হাস্যকর ভাবে উড়িয়ে দেওয়া হতো এবং তারা বরাবরই বলে আসছিলেন যে, যতো কিছুই হোক শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবেন না। বলাই বাহুল্য আজকের পরিস্থিতির সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের সেই বক্তব্যের কোনো মিলতো নেই-ই বরং বাস্তবতাও আজকে সম্পূর্ণই ভিন্ন।

Advertisement

বিএনপি কী করে এরকম তিনশ ষাট ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে আজকের অবস্থানে চলে এলো তা নিয়ে বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন নেই। রাজনৈতিক দলগুলো দেশে দেশে অস্তিত্বের সংকটে পড়লে এমন কিছু করে যা স্বাভাবিক অবস্থা তথা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় হয়তো ভাবতেও পারে না। একই কথা আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, কিন্তু একুশ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পরও দলটি যে ভাবে নিজেদের অস্তিত্ব ও নিজস্ব রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে তা রাজনীতির ইতিহাসে সত্যিই বিরল।

অথচ এক দশকের একটু বেশি সময় ক্ষমতায় বাইরে থাকার ফলে বিএনপি এমন এক সংকটে পর্যবসিত হয়েছে যে, তাকে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ড. কামাল হোসেনকে নেতা মানতে হচ্ছে। এর মূল ও একমাত্র কারণ হচ্ছে, বিএনপি‘র জন্ম ও ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ার প্রক্রিয়াটি কোনো ভাবেই রাজনৈতিক ছিল না। জনগণের টাকা ব্যবহার করে সেনা ছাউনীতে যে রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমটিকে আজকের বিএনপি হিসেবে আমরা দেখতে পাই তা মূলতঃ ক্ষমতা-কেন্দ্রিক একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যাকে বার বারই কোনো না কোনো পক্ষের (বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অরাজনৈতিক) সাহায্য নিতে হয়।

এর আগে এই প্ল্যাটফরমটি আমলা ও সেনা বাহিনীর একচ্ছত্র সমর্থন পেয়ে নির্বাচনকে নিজের মতো ব্যবহার করে ক্ষমতারোহনে সফল হয়েছে। যে কারণে ১৯৯৬ সালে একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন করে এক মাসও ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মতো সাময়িক ও বলতে গেলে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক একটি ব্যবস্থার জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশে বিএনপি’র কারণেই।

মজার ব্যাপার হলো, আবার এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির মৃত্যুও হয়েছে সেই বিএনপি’র কারণেই। না হলে ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার রীতি মনে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতা ত্যাগ করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসলে সম্পূর্ণ দলীয় সরকার হিসেবেই ক্ষমতাসীন ছিল এবং তার ফলাফলও হাতেনাতে পাওয়া যায়।

Advertisement

এরপর বয়স বাড়িয়ে নিজস্ব প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার-প্রধান করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে দলীয় রাষ্ট্রপ্রধানকে একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের দায়িত্ব দেওয়ার পর এই অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি কোনো রাজনৈতিক দলেরই আর আস্থা থাকার কথা নয়। থাকেওনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই সেটি বাতিল করেছে।

বাতিল করার পর প্রথম দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ভোটে বিএনপি অংশ নেয়নি। অথচ নির্বাচন কমিশন গঠনে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছিল বিএনপি তাতে অংশ নিয়েছিল এবং নিজেদের পছন্দের নির্বাচন কমিশনারের নামও দিয়েছিল। যেমনটি এই নির্বাচন কমিশনেও আমরা দেখতে পাচ্ছি। নির্বাচন কমিশন গঠন ও তাদের কর্মপদ্ধতি বাংলাদেশে এখনও একটি অস্বচ্ছ ও ঘোলাটে সংস্থা হিসেবে বিদ্যমান হলেও যেটুকু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নির্বাচন কমিশন এখনও চর্চা করে যাচ্ছে বলতে গেলে তার পুরোটাই আওয়ামী লীগের হাত ধরে এসেছে।

বিশেষ করে সকল দল ও মতের মানুষের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের যে পদ্ধতি বাংলাদেশে শুরু হয়েছে তা বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠনে সর্বোতভাবে অনুসরণ করা হয়েছে বলেই আমরা জানি। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার কোনো রাজনৈতিক দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে নির্বাচন কমিশন বদলানোর দাবিতেও বিএনপি ব্যর্থ হয়। যে সকল প্রশ্ন আগেও ছিল, এখনও সকলের মনে রয়েছে যে, এতো গণভিত্তি ও সুনির্দিষ্ট ভোটব্যাংক থাকার পরও কেন একটি রাজনৈতিক দল কোনো আন্দোলনই সফল করতে পারে না? কেনই বা তাদেরকে বার বারই অ-রাজনৈতিক শক্তির কাঁধে ভর করে ক্ষমতায় যেতে হয়? কিংবা যাদের ভোট নেই কিন্তু রাজনীতি করতে জানেন তাদের কাঁধে ভর দিয়ে একটি বড় দলকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে হয় সরকার-পক্ষের ন্যায্য অ-ন্যায্য সকল শর্ত মেনেই?

নিঃসন্দেহে এবারের নির্বাচনে বিএনপি’কে এসব প্রশ্নের উত্তর ভোটারদেরকে দিতে হবে এবং একথাও বলতে হবে যে, ক্ষমতায় গেলে কাকে তারা প্রধানমন্ত্রী করবেন? কার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে এসব প্রশ্নের উত্তরে কী স্থায়ী সমাধানের ব্যবস্থা করবেন সেটিও জনগণ নিশ্চিত ভাবেই জানতে চাইবে।

কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল যাই-ই হোক না কেন, বিএনপি বা আওয়ামী লীগকে সেটা যে এবার মানতেই হবে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। কারণ, সবকিছুকে গুছিয়ে দেশের রাজনীতিকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে নিয়ে যাওয়াটা চাট্টিখানি কথা নয়। এদিক দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কৃতিত্বকে অবশ্যই আমাদের স্বীকৃতি দিতে হবে। কোনো ভাবেই নির্বাচনকে বানচাল করার কোনো রকম হঠকারী কোনো পদক্ষেপে দলটি কাউকে উৎসাহ দেয়নি বা এমন কোনো কাজও করেনি যাতে অন্য কেউ সেটি করার সুযোগ পায়।

বরং বিএনপি’কে নির্বাচনে নিয়ে আসার জন্য হঠাৎ জন্ম নেয়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আলোচনায় বসে শেখ হাসিনা দেশে-বিদেশে সকলকে চমক দিয়েছেন এবং একটি সুচিন্তিত রাজনৈতিক চাল চেলেছেন। বিএনপি’র না-হয় হারানোর কিছু নেই, কিন্তু আওয়ামী লীগ যদি এবারের নির্বাচনে পরাজিত হয় তাহলে তারাতো ক্ষমতা হারাবেই, সেই সঙ্গে দেশ ও জাতি বঞ্চিত হবে একটি সুসংগঠিত নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে।

অপরদিকে, বিএনপি নির্বাচনে বিজয়ী না হতে পারলে একদিকে একথা যেমন জোর গলায় বলতে পারবে যে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ায় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি অতএব তারা জয়ী হতে পারেনি; তেমনি বিজয়ী হলে বলতে পারবে যে, এই বিজয় জনগণের, জনগণই আওয়ামী লীগের অপশাসনের জবাবে তাদেরকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছে।

একথা কোনো রকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই বলা যায় যে, আজকের মতো পরিস্থিতিতে বিএনপি কোনো ভাবেই এরকম একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঝুঁকি নিতো না কখনওই। আওয়ামী লীগ নিয়েছে কারণ দলটির একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য রয়েছে। আওয়ামী লীগ এর বাইরে আর কোনো প্রক্রিয়ার কথা ভাবতেও পারে না বা তার সামনে আর কোনে পথও খোলা ছিল না।

তার মানে হচ্ছে, একটি দলীয় সরকারের অধীনে দেশের সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে, তার জন্য আওয়ামী লীগ এককভাবে কৃতিত্ব দাবি করতেই পারে এবং তাতে কোনো দোষও তাদের দেওয়া যাবে না।

বিশ্বময় আমরা যখন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস হতে দেখছি, যখন নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নানা ভাবে প্রভাবের আওতায় এনে কিংবা মিথ্যা প্রচারণা দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করে উগ্র ও গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর রাজনীতিকে ক্ষমতায় আসার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে তখন বাংলাদেশের মতো ছোট্ট একটি দেশে গণতন্ত্রের পক্ষে ও গণতন্ত্রের জন্য জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের এই সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।

আমি নিশ্চিত, জনগণ এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে এবং সঠিক প্রার্থী বাছাই করে নিতে ভুল করবে না। এই শঙ্কাকুল বিশ্বপরিস্থিতিতে বাংলাদেশে একটি সত্যিকার অর্থেই গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক সরকারের শাসন খুউব জরুরি, নাহলে বাংলাদেশ আবার পথ হারাবে। বহুদিন লেগেছে বাংলাদেশকে আজকের ‘পথে’ ফিরিয়ে আনতে। ১১ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার ২০১৮

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.com

এইচআর/পিআর