২০১৬ সালের জুন মাসে গণভোটের পর ব্রিটিশ জনগণের ব্রেক্সিট রায়কে বাস্তবায়ন করতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে তার দেশের পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট প্রস্তাবনা তুলে ধরবেন মঙ্গলবার। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে’র সামনে এখন তিনটি পথ খোলা আছে, প্রথমটি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে কোনো চুক্তি ছাড়াই বেরিয়ে যাওয়া যাকে সংক্ষেপে ‘নো ডিল ব্রেক্সিট’ বলা হচ্ছে। দ্বিতিয়টি পার্লামেন্টে টেরেসা মে’র প্রস্তাবিত চুক্তিটি পাস করিয়ে ব্রেক্সিট কার্যকর করা। তৃতীয়টি ব্রেক্সিটের পরিকল্পনা বাদ দেয়া। পার্লামেন্টারিয়ানরা তৃতীয় অপশনটি বেছে নিলে ব্রিটেনে নতুন করে আরেকটি গণভোটের সম্ভাবনা দেখা দেবে। সেক্ষেত্রে কনসারভেটিভ সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারবে কি-না সেটি নিয়েও শুরু হবে নতুন জল্পনা-কল্পনা। যদিও নরওয়ের মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে থেকেও ইউরোপের অর্থনৈতিক জোনে থাকার আরেকটি অপশন রয়েছে ব্রিটেনের হাতে।
Advertisement
তবে ১১ ডিসেম্বর টেরেসা মে যদি তার ব্রেক্সিট প্রস্তাবের প্রতি এমপিদের সমর্থন পেয়ে যান তাহলে প্রস্তাবিত ব্রেক্সিট ডিল নিয়ে ইউরোপের সাথে চূড়ান্ত বিচ্ছেদের পথে এগোবে ব্রিটেন। প্রস্তাবে এমপিদের সমর্থন না থাকলে ব্রিটেনকে ‘নো ডিল’ অথবা ব্রেক্সিট বাতিলের পথেই হাঁটতে হবে। মঙ্গলবার ভোটাভুটিতে শুধু ব্রেক্সিট ইস্যুরই সিদ্ধান্ত নয়, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে’র ভাগ্য নির্ধারিত হবে। ব্রেক্সিট বিলে টেরেসা মে আস্থা হারালে, তাকে লিডারশিপ থেকে সরে দাঁড়াতে হতে পারে। এক্ষেত্রে দলের ৪৮ জন সদস্য এই দাবি করলে আস্থা ভোটের মুখোমুখি হবেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে। তাই মঙ্গলবার টেরেসা মে’র জন্য অমঙ্গলও ডেকে আনতে পারে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মের ব্রেক্সিট প্রস্তাবনা যে তার নিজ দল ও বিরোধী লেবার দলের মধ্যে প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখে পড়বে, সেটির একটা আভাস পাওয়া গেছে চলতি সপ্তাহে পার্লামেন্টের ব্রেক্সিটের আইনগত নথি উত্থাপন বিষয়ে ভোটাভুটিতে। ২৯৯/৩২১ ভোটে টেরেসা মে'র পরাজয় মঙ্গলবারের ভোটাভুটির ফলাফলের একটা আভাস দিচ্ছে বটে।
এখানে ২০১৭ সালের জুন মাসে ব্রিটেনের স্ন্যাপ ইলেকশনের ফলাফলের একটা সারণি পাঠকদের মনে করিয়ে দিয়ে আলোচনায় ফিরতে চাই। মোট ৬৫০টি আসনের মধ্যে ক্ষমতাসীন টোরি পার্টি এককভাবে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ৩২৫টি আসন পায়নি। ৩১৮টি আসনে জয়ী টোরি নর্দান আয়ারল্যান্ডের ১০ আসন পাওয়া ডিইউপির সাথে জোট করে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছিল। ডিইউপির সাথে কনসারভেটিভ জোটের চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল, ব্রেক্সিট ইস্যুতে টেরেসা মেকে সমর্থন দেয়া। ডিইউপি আর টোরি মিলে ৩২৮টি আসন থাকা সত্ত্বেও ব্রেক্সিট লিগ্যাল পেপার উত্থাপন সংক্রান্ত ভোটে কনসারভেটিভ ২৯টি ভোট কম পেয়েছে। এই ২৯টি ভোটের ১৮টি তার নিজ দলের, বাকি ১০টি ডিইউপির। তাহলে সমীকরণ খুব পরিষ্কার। টেরেসা মে’র বেক্সিট ইস্যুতে সমর্থন না দিয়ে চুক্তি ভঙ্গ করেছে ডিইউপি! ব্রিটিশ রাজনীতির গণতন্ত্র বলে কথা। নিজ দলের সংসদ সদস্যরাই যেখানে বিভক্ত, সেখানে ডিইউপি বিরোধিতা করে ভোট দেয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
বিবিসির এন্ড্রু মার শো’তে ডিইউপি টেরেসা মে’র ব্রেক্সিট বিলে ভোট দেবে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে ডিইউপি লিডার এলিন ফস্টার, তাদের দেখতে হবে, বুঝতে হবে, পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে- এমন বক্তব্যের মধ্যেই ঘুরপাক খেয়েছেন। কোনো পরিষ্কার আত্মবিশ্বাসী উত্তর তিনি দিতে চাননি। শুধু এইটুকু বলেছেন, তিনি তার মেম্বারদের মধ্যে আস্থা ফেরাতে কাজ করবেন। অর্থাৎ টোরি-ডিইউপির সম্পর্কে দূরত্ব স্পষ্ট। টেরেসা মে-এলিন ফস্টার এই কয়দিনে সম্পর্ক কতটুকু উন্নয়ন করেছেন, সেটি ১১ ডিসেম্বর পার্লামেন্টে ভোটের পর বোঝা যাবে। তবে টেরেসা মে শেষ পর্যন্ত শরিক দল ডিইউপির ১০ এমপিকে বাগে আনতে পারলেও নিজ দলের এমপিদের সামলাতে না পারলে ব্রেক্সিট বিচ্ছেদ বিল অসমাপ্ত রেখেই ডাউনিং স্ট্রিট ছাড়তে হবে।
Advertisement
টেরেসা মে’র নিজের ঘরের অবস্থা বর্তমানে ভয়াবহ দুর্বল। অপয়া ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে মে’র সরকারের ডজনখানেক মন্ত্রী ও দলের শীর্ষ নেতারা পদত্যাগ করেছেন। দুইজন ব্রেক্সিট মন্ত্রী ডেভিড ডেভিস ও স্টিভ বেইকার ছাড়াও বিদায় নিতে হয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ওয়ার্ক ও পেনশন মন্ত্রীকে। গত জুলাইতে সাবেক লন্ডন মেয়র ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসনের পদত্যাগের পর জেরিমি হান্টকে ব্রিটেনের বিদেশমন্ত্রী বানাতে হয়েছে টেরেসা মে’র সরকারকে। বরিস জনসনই কনসারভেটিভ পার্টির হেভিওয়েটদের মধ্যে অন্যতম, যিনি ব্রেক্সিটের বিরোধিতা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আস্থা ভোটে হেরে গেলে কনসারভেটিভ পার্টির লিডারশিপ দৌড়ে এগিয়ে থাকবেন বরিস। তাই দলের সদস্যদের সমর্থন পেলে লিডারশিপের দায়িত্বও নিতে হতে পারে বরিস জনসনকে।
অন্যদিকে লেবার পার্টি শুরু থেকেই ব্রেক্সিটের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে থাকলেও নির্বাচনের পর লেবার পার্টি জনগণের রায়কে স্বাগত জানিয়ে সেটি বাস্তবায়নের পক্ষে মত দিয়েছিল। কিন্তু এখন লেবার পার্টির প্রধান জেরিমি করবিন বেক্সিট ইস্যুতে যে সুরে কথা বলছেন তাতে মনে হচ্ছে তার মনের সুপ্ত বাসনাটি হলো, টেরসো মে’কে বেকায়দায় ফেলে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হওয়া। বেক্সিট বিলে হেরে গেলে টেরেসা মে’র লিডারশিপ ক্রাইসিস শুরু হবে। এই সুযোগে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ‘নো কনফিডেন্স’ বিল উত্থাপন করতে পারেন জেরিমি করবিন। সেক্ষেত্রে প্রথা অনুযায়ী ব্রিটেনের রানি লেবার লিডার জঋমি করবিনকে সংখ্যালঘু সরকার গঠনের প্রস্তাব দিতে পারে। তাই ১১ ডিসেম্বর জেরিমি করবিনের অন্যতম টার্গেটই থাকবে টেরেসা মে’কে নো কনফিডেন্সের দিকে ঠেলে দেয়া।
তবে বেক্সিট ইস্যুকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদরা যে ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন এটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেই সাথে এই বিষয়টি সম্পর্কে রাজনীতিবিদরা গণভোটের আগে জনগণের কাছে পরিষ্কার করতে পারেননি। কারণ ভোটের সময় গুগলের সার্চ ইঞ্জিনে ব্রিটিশ জনগণ সবচেয়ে বেশিবার সার্চ করেছেন 'হোয়াট ইজ ইউরোপীয় ইউনিয়ন’? গুগল সার্চের এই তথ্য প্রমাণ করে, ভোটের আগে ব্রিটিশদের অধিকাংশেরই ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কার্যক্রম নিয়ে পরিষ্কার ধারণা ছিল না। ব্রিটিশ রাজনীতিবিদরা বিগত ৪৫ বছরে ইউরোপের সাথে সংসার করতে গিয়ে এতটাই পরনির্ভরশীল হয়ে গেছে যে এখন বিচ্ছেদের ফলে নিজেদের ভগ্ন মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবে এই আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছে না। আবার আকস্মিক এই বিচ্ছেদের ফলে যে অর্থনৈতিক ধস নামবে সেটি সামলানোর মতো দৃঢ়তা নেই ব্রিটেনের। জনগনের রায় নিয়ে নির্বাচিত হওয়া সংসদ সদস্যদের কাজ হলো, জনগণের মতামতকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আইন প্রণয়ন করা। ব্রিটিশ জনগণ ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় দিয়েছে। রাজনীতিবিদদের কাজ হবে, জনগণকে অনিশ্চয়তার মধ্যে না রেখে দ্রুত ব্রেক্সিট ইস্যুটির সমাধান করা।
লেখাটি যখন শেষ করেছি তখন জানতে পারলাম ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে তার দলের কেবিনেট মন্ত্রীদের কনফারেন্স কলে স্ট্যান্ডবাই থাকতে বলেছেন। মঙ্গলবার তার দলের এমপিরা যেন কোনো অনুমাননির্ভর ভোট না দেয় সে জন্য সকলকে একটি সতর্ক বার্তা দিতে চান টেরিসা মে। এদিকে ইউরোপীয়ান পার্লামেন্ট একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে। যুক্তরাজ্য সরকার চাইলে ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া বাতিলও করতে পারে এক্ষেত্রে ইউনিয়নের অপর ২৭টি রাষ্ট্রের অনুমতির প্রয়োজন হবে না। ইউরোপীয়ান কোর্ট অব জাস্টিসের এই রায়ের ফলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারিয়ানদের হাতে আরও একটি নতুন অপশন যোগ হলো।
Advertisement
ব্রেক্সিট নিয়ে কোনো আলোচনা কিংবা বিশ্লেষণ করা যাচ্ছে না, প্রতি মিনিটে মিনিটে এর গতি পরিবর্তিত হচ্ছে। সারা রাত ধরে অপেক্ষা আর ব্রেক্সিট বিশ্লেষণ করে একখানা লেখা নামালম, আর সকালে উঠে দেখি প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে আগামীকাল পার্লামেন্টের ভোট স্থগিত করে দিয়েছেন। নর্দান আয়ারল্যান্ড বর্ডার ইস্যু নিয়ে ইউরোপের পরিষ্কার দিকনির্দেশনা জানতে পার্লামেন্টের কাছে আরও সময় চেয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। তবে বিরোধী লেবার পার্টির দাবি প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্ট তার পরাজয় ঠেকাতে বেক্সিট সংক্রান্ত ভোট পিছিয়ে দিয়েছেন। বিবিসি তো রীতিমতো ভোট স্থগিতের আগাম সংবাদই ফাঁস করে দিয়েছে। টেরেসা মে’র এমন পদক্ষেপে লেবার লিডার জেরমি করবিনকে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী মনে হয়েছে। এমন বিরোধিতার বিপরীতে টেরেসা মে কতদিন টিকে থাকতে পারবেন সেটিই এখন দেখার অপেক্ষা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।একাত্তর টেলিভিশনের যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি।