অভিভাবক ডেকে 'সতর্ক' করার প্রবণতা বাংলাদেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই রয়েছে। খেয়াল করলে দেখা যায় এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর কাছে ‘এলিট’ হিসেবে বিবেচিত। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের ‘ভালো’ রেজাল্ট, ডিসিপ্লিন, শিক্ষার পরিবেশ, সোস্যাল স্ট্যাটাস ও সামগ্রিক বিষয়াদি মিলিয়ে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘদিনের একটা প্রতিষ্ঠিত ‘গুড ইমেজ’ রয়েছে। ফলে, প্রতিবছর নাগরিক অভিভাবক মহলে প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে নিজেদের কাঙ্ক্ষিত স্কুল-কলেজে সন্তানদের ভর্তি করবার প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতাও লক্ষ্য করা যায়। তবে এর মাঝে এক প্রকার ‘সোস্যাল স্ট্যাটাস’ এর ব্যাপার রয়েছে। ‘ভালো’ ‘নামি-দামী’ ‘বিখ্যাত’ এসব বিশেষণের সামাজিক বিলবোর্ড গায়ে লাগানো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্তানদের ভর্তি করানোর সঙ্গে ব্যক্তির সামাজিক পুঁজিও ওঠা-নামা করে। আর তাই, দিন শেষে শিক্ষার্থীদের ‘ভালো’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার প্রতিযোগীতার পাশপাশি অভিভাবকদের ভর্তি করানোর প্রতিযোগিতাই লক্ষ করি।
Advertisement
এই ভর্তি যুদ্ধকে তাই আর সমবয়সি দুটো শিশুর ‘যুদ্ধ’ নয় বরং না না বয়সী বিবিধ অভিভাবকদের যুদ্ধ বলেই মনে হয়। অবশ্য, কিছু নাগরিক চাকুরীজীবী অভিভাবকেরা এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্তান ভর্তি করাতে চায় ‘সেলফ রিলিফ’ পাওয়ার আশায়। এই ক্রমাগত টিকে থাকার অনিশ্চয়তার শহরে জীবন-জীবিকার পেছনেই কেটে যায় দিনের বড় একটা অংশ। ইচ্ছে থাকলেও হয়তো সন্তানদের শিক্ষার পেছনে অভিভাবকদের আলাদা সময় বের করার সময় থাকে না। মোটা অংক টিউশন ফির বিনিময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোই শিক্ষার্থীর সকল দায়িত্ব নিয়ে থাকে বলে ধারণা করা হয় বলে অভিভাবকদের সাথে সন্তানদের শিক্ষা সম্পর্কিত যোগাযোগ বলতে থাকে শুধু এসব ফি মেটানোর বন্দোবস্ত করা।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যখন কোন শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নেয় তখন ওই শিক্ষার্থীর সাফল্য যেমন প্রতিষ্ঠানের সাফল্য তেমনই ব্যর্থতার দায়ভারও প্রতিষ্ঠানেরই। কিন্তু প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন পাওয়ার প্রাকটিসের মাধ্যমে এই ব্যর্থতাকে আড়াল করে তাদের ‘এলিট’ ভাবমূর্তি বজায় রাখে। প্রতিষ্ঠানের এক ধরণের পাওয়ার রয়েছে। তারা শিক্ষার্থীদের ‘শিক্ষিত’ হবার সনদপত্র দেয়। তারা চাইলেই যেকোন শিক্ষার্থীকে ‘বিদায় নোটিশ’ দেবার ক্ষমতা রাখে। ফলে, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাথে প্রতিষ্ঠানের এক ধরণের ক্ষমতার জায়গা তৈরি করে। যেখানে, প্রাতিষ্ঠানিক হায়ার্কি চর্চার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অধস্তন করে রাখা হয়। অবশ্য, এর সঙ্গে অভিভাবকদের সামাজিক অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ। সে প্রসঙ্গে অন্য কোন দিনের জন্য তোলা থাকা।অতি সম্প্রতি রাজধানীরই এক এলিট বিদ্যায়তনের শিক্ষার্থী অরিত্রি অধিকারীর আত্মহত্যা এস ভাবনা আরো উসকে দেয়। আগ্রহ নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টগুলো পড়ি। বোঝার চেষ্টা করি অরিত্রির আত্মহত্যা কি আত্মহত্যা, নাকি হত্যা? এই যে অভিভাবক ডেকে সতর্ক করার প্রবণতা, সন্তানের দোষে অভিভাবককে অপমান করার এক ঘেয়ে ক্লিশে সেন্টিমেন্ট, সামাজিক অবস্থান ভেদে অভিভাবকের সাথে কতৃপক্ষের আচরণের তারতম্য সব মিলিয়ে এই সতর্করণ প্রক্রিয়া হয়ে উঠেছে একটা ‘সাইন অফ স্টিগমা’। এই ‘সাইন অফ স্টিগমাই’ কি অলক্ষ্যে মনের অন্দর মহলে ঢুকে কল কাঠি নেড়েছে আত্মহত্যার? ভাবা জরুরি।
প্রতিষ্ঠান ভেদে এই সতর্ক করণ প্রক্রিয়া আলাদা নামে অভিহিত হলেও কাঠামোগত দিক থেকে বিশেষ কোন পার্থক্য। যেমন। বাংলাদেশে আধাসামরিক কাঠামোয় প্রতিষ্ঠিত বিশেষ এক ধরণের আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই সতর্ক করার প্রাকটিস 'প্যারেন্টস কল' নামে পরিচিত। যেখানে কলেজ কতৃপক্ষ তাদের চোখে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত কর্মকান্ডের জন্য ওই প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের চিঠি পাঠিয়ে কলেজ কতৃপক্ষের সাথে আলোচনায় বসার অনুরোধ জানায়।তেমন এক বিদ্যায়তনে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় কাটানোর সুবাদে খুব নিকট থেকেই এই 'সতর্ক'করণ প্রক্রিয়াকে দেখেছি। দেখেছি, একটি 'প্যারেন্টস কল' কিভাবে আঘাত আনতে পারে শিক্ষার্থী ও তার অভিভাবকের মানসিক স্বাস্থ্যে। কিভাবে একটি ‘প্যারেন্টস কল’ ওই অভিভাবকের পরিচিত মহলে হয়ে উঠতে পারে ‘সাইন অফ স্টিগমা’।
Advertisement
অনলাইনে ভাইরাল হওয়া অরিত্রির অভিভাবকদের সাথে অধ্যক্ষের আলাপচারিতার ভিডিও দেখতে পাই সিসিক্যামেরার ফুটেজে। ভাষাহীন এই ভিডিওতে মূল কথোপকথন অনুপস্থিত থাকলেও ঠাহর করতে পারি প্রিন্সিপালের কাঠগোড়ায় দোষী কোন শিক্ষার্থী ও তার অভিভাবকদের আলাপচারিতার টুকরো চিত্র। এক যুগ আগের এমনই এক নারকীয় অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে। স্মৃতির ডায়েরি খুলে দেখি আমি নিজেও তেমনই এক 'এলিট' বিদ্যায়তনে সতর্কবার্তার মুখোমুখি হই। ফলে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিভাবক সতর্ক করার প্রক্রিয়ার আরেকটু অভ্যন্তর জানার সুযোগ ঘটে।
যে শিক্ষার্থীর প্যারেন্টস কল হতো, তার বাড়ির ঠিকানায় ডাক যোগে আচমকা পৌঁছে যেতো বিদ্যায়তনের লোগো সম্বলিত খামে কর্তৃপক্ষের অফিসিয়াল ভাষায় লেখা কঠিন কোন চিঠি। ঐ চিঠিতে থাকতো প্রাপকের 'পুত্র/ পোষ্যের' লঘু অপরাধের গুরু বিবরণের বিশদ বিবরণ।আমার পিতাও পেয়েছিলেন তেমন এক চিঠি। কোন এক জৈষ্ঠ্যের দুপুরে খাকি খামের ভেতর আগন্তুক কবুতরের মতো হাতে এসেছিলো এক খানা চিঠি। মনে পড়ে একটা অপ্রত্যাশিত চিঠি, এক টুকরো কাগজ, কলেজের মনোগ্রাফ সম্বলিত খাকি খামের এক প্রহেলিকায় ঘেরা বার্তা আমার সমস্ত পরিবারকে ফেলে দিয়েছিলো কি নিদারুণ দুঃশ্চিন্তায়! ঐ চিঠিতে আরও ছিলো, ওই অপরাধের প্রেক্ষিতে শাস্তির ধরণের এক আসন্ন পূর্বাভাস। প্রথম প্যারেন্টস কলের চিঠি ঐ ঠিকানায় আসা পরবর্তী সকল চিঠিকে 'সতর্কবার্তা বাহক' হিসেবে সন্দেহ করেছিলো। ফলে আমার পরিবারে চিঠি হয়ে ওঠেছিলো আতঙ্কেরই অন্য নাম।
স্কুল কলেজ সবাইকে একই ইউনিফর্মের আড়ালে সাম্যবাদের ধারণা দিলেও বাইরের পৃথিবীর বিস্তর বিভাজন ধরা পড়তো অভিভাবকদের সামাজিক অবস্থান ভেদে কতৃপক্ষের ভাষার ব্যবহারের মাধ্যমে। আভিজাত্যের প্রতি সুর হোতো নরম, আর 'সাধারণ' এর প্রতি সুর হোতো কঠোর। কলেজেরই এক অগ্রজের পিতাকে প্যারেন্টস কলে অধ্যক্ষ বলেছিলেন, আপনার ছেলেকে পিতা হয়ে কেন কন্ট্রোল করতে পারেন না? ওই পিতা উত্তর দিয়েছিলেন, আমার ছেলে বছরে মাত্র তিন মাস ( নৈবিত্তিক ছুটি) আমার কাছে থাকে, বাকি নয় মাস তো আপনাদের কাছেই থাকে। আমিও তো বলতে পারি অধ্যক্ষ হিসেবে আপনিই বা কী দায়িত্ব পালন করেছেন? এমন যথার্থ জবাবের পর ওই অভিভাবকের ভাগ্যে কি ব্যবহার জুটেছিলো তা জানা নেই তবে এও দেখেছি ব্যক্তিভেদে কিভাবে কতৃপক্ষের অবস্থান পাল্টায়। এমন অনেকেই আবার ছিলেন যারা প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম অনুযায়ী 'প্যারেন্টস কল' করলেও খুব মীমাংসার সুরে মেটাতেন কিশোরসুলভ সেসব অপরাধকে।
একজন শিক্ষক তো শুধু একজন শিক্ষকই নয়, একজন অভিভাবকও বটে। সোস্যাল প্যারেন্টিং এর জায়গা থেকে দেখলে একজন শিক্ষক তো পারেন তাঁর শিক্ষার্থীর অপরাধকে মমতায় মিলিয়ে দিতে। কিন্তু এই প্যারেন্টিং এর দায়িত্ব তো সবাই নেয় না। ফলে যেকোন 'অপরাধেই' বিচারের কাঠগোড়ায় দাঁড়াতে হয় শিক্ষার্থী এবং অভিভাবককে। এই যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ক্ষমতার চর্চা এরই কি নির্মম বলি অরিত্রিরা? যে কোন অপরাধই তো মীমাংসার আওতায় আনা যায়। সামাজিক অভিভাবকের দায়িত্ব নিয়ে একজন শিক্ষকই তো পারেন ওই শিক্ষার্থীর অপরাধকে ধরিয়ে দিতে। তার এটুকু বোধ অন্তত থাকা উচিত যে, কৈশোরের ওই দুরন্ত সময়ের কর্মকান্ডকে প্রৌঢ়ত্বের চোখ দিয়ে দেখলে তা শুধু অপরাধ-ই মনে হবে। শিক্ষকের সাইকো-সোস্যাল ধারণায় যা অপরাধ, তা হয়তো নিছক কোন কিশোর বয়সের সহজাত আচরণ কিংবা কোন ভুল। আর যদি ‘অপরাধ’ হয়েই থাকে তবে তো সুযোগ রয়েছে সংশোধনের, সুযোগ রয়েছে মীমাংসার। ক্ষমাই যদি না করা যায় তবে আদালতের সাথে স্কুল-কলেজের বিশেষ কি তফাৎ?
Advertisement
একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবককে তাঁর সামনে ডেকে এনে অপমান করা আমাদের শিক্ষকদের নৈতিকতা ও আদর্শের যে স্থলন ঘটেছে তারই যেন ইঙ্গিত দেয় বারবার। আবহমানকাল ধরে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের যে চমৎকার ধরণ রয়েছে এই সংস্কৃতিকে তাকেই যেন আঘাত করে। এই আঘাত আমাদের সংস্কৃতির মর্মমূল অবধি পৌঁছে যায়। এই সংস্কৃতি ‘মাস্টার মশাই’দের সর্বোচ্চ সম্মানই দিতে শিখিয়েছে, ‘মাস্টার মশাই’রাও সর্বোচ্চ স্নেহ নিয়ে আগলে রেখেছে তাঁদের শিক্ষার্থীদের। শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতার চর্চা নয় বরং মমতার চর্চাই অধিক জরুরী। শিক্ষকদের মর্যাদা দেওয়ার যুগ আর নেই। কিংবা আমাদের শিক্ষকেরাই ব্যর্থ তাঁদের মর্যাদা টুকু অর্জন করতে। দিন শেষে এইতো সত্য যে, সম্মান অর্জনের বিষয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ভক্তি, শ্রদ্ধা।
কবি কাজী কাদের নেওয়াজ অনেক আগে ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ নামের একটি কবিতায় শুনিয়েছিলেন মুঘল বাদশা আলমগীরের গল্প। ইতিহাস বাদশা আলমগীরকে আওরঙ্গজেব নামে পিতাকে বন্দী করে রাখা এক কুখ্যাত সম্রাট হিসেবে মনে রাখলেও এই একটি কবিতায় তিনি মহান হয়েছেন তাতো ঐ 'শিক্ষকের মর্যাদা' দিয়েই। তুমুল অত্যাচারী সম্রাটের যুগেও শিক্ষকেরা মর্যাদা নিয়ে বেঁচেছিলেন ভেবে ভালো লাগে। সে যুগ হয়তো আর নেই, কিন্তু অনাগত আগামীতে শিক্ষকের পা ধুয়ে দেয়ার মত সমদৃশ্যের অবতারণা কি ঘটবে না আর? নাকি 'সভ্যতার ফুল ফোটানোর' বদলে আমাদের বিদ্যালয়গুলো ফুটিয়ে যাবে 'ক্ষমতার হুল'? আর আত্মহত্যাপ্রবণ এইসব শীতের রাতে ঝরে যাবে অরিত্রির মতো কিশোর কুঁড়িরা।
লেখক: কবি, গবেষক।
এইচএন/পিআর