বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে জনমানসে অন্যরকম শংকা উঁকি দেয়। আবার অশান্তি বাড়বে না তো! আতঙ্কগ্রস্থ মানুষগুলোর মুখে অস্ফুট উচ্চারণ। আবার সন্ত্রাস-আগুন-প্রাণহানির ঘটনা ঘটবে না তো! এবার অবশ্য নির্বাচনী হাওয়ায় সন্ত্রাসের বিষবাষ্প এখন অব্দি টের পাওয়া যাচ্ছে না। বরং অনেক বেশি স্বস্তির বাতাবরণ । যার শুরু প্রধানমন্ত্রীর সাথে অন্যান্য রাজনৈতিক দল আর জোটের সংলাপে। বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে অনেক সংলাপ আছে। কিন্তু সেগুলো ছিল নিস্ফলা। এবার সেখানেও ব্যতিক্রম। কারণ, এবার সংলাপ করেছেন প্রধান মন্ত্রী নিজে। যার নজির আগে নেই। তাই নির্বাচনের আগে ডিজিটাল বাংলাদেশ স্বস্তির নেটওয়ার্কের মধ্যেই আছে। স্বস্তির সেই নেটওয়ার্ক, থ্রি জি, ফোর জি নয়। নির্বাচন কাছাকাছি এলে ফাইভ জি হলে এবারের সংসদ নির্বাচন হতে পারে সত্যিই 'ভোট উৎসব'। যেটা এদেশের মানুষের আন্তরিক চাওয়া।
Advertisement
তবে চাইলেই সব পাওয়া যাবে তাও নয়। কারণ, সাতচল্লিশ বছরের বাংলাদেশে জনগণের অনেক চাওয়া পূরণ হয়নি। তার দায় আমাদের রাজনীতিবিদদের। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সেভাবে গড়ে ওঠেনি। কিংবা গড়ে তুলতে পারিনি। তবে পারিনি বলে, কখনোই পারবো না তা কী করে হয়! একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের সামনে সেই সুযোগ এনে দিয়েছে।
বাংলাদেশ অনেক কিছু করেছে। এদেশের মানুষ অনেক কিছু করে দেখিয়েছে। এবার আমাদের রাজনীতিদের সামনে গণতন্ত্রের পরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে তাঁরা ব্যর্থ হলে তার দায় এদেশের মানুষের কাঁধে চাপানো যাবে না। জনগণ চায় শান্তি। উন্নতি। তবে সেই শান্তি-উন্নতি ভিত হতে হবে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র যত শক্তিশালী হবে উন্নতি তত দ্রুত হবে। অশান্তির কুয়াশা তত দ্রুত কেটে যাবে। অনিশ্চয়তা-অশান্তি-আতঙ্কের কুয়াশা সরানোর পথ নির্দেশিকা হতে হবে অংশগ্রহণমূলক-প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এবং অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন। সেই পথ নির্দেশিকা তৈরির বড় দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। আর সহায়কের দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর রাজনৈতিক জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছেন। সাফল্য-ব্যর্থতা সবই দেখেছেন। তবে গণতান্ত্রিক নেত্রী হিসেবে তিনিও এবার বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এবং সেই চ্যালেঞ্জ তিনি নিজেই নিজের সামনে ছুঁড়ে দিয়েছেন। একটি দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে পারে সেই চ্যালেঞ্জটা তিনি নিয়েছেন।
Advertisement
প্রাথমিক ধাপে তিনি সফল। হ্যাঁ, সফল। কারণ, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোন দলীয় সরকারের অধীনে সব দল নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে। যারা প্রায় এক দশক ধরে বলে আসছিলেন কোন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নয়, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে কোন নির্বাচন নয় কিংবা শেখ হাসিনার অধীনে এই দেশে কোন নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। তাঁরা স্ট্যান্স বদল করেছেন।
বলা যায়; শেখ হাসিনা তাঁদের স্ট্যান্স বদল করতে বাধ্য করলেন। তবে সাধুবাদ জানাতে হবে তাদেরও। ধন্যবাদ তাদেরও প্রাপ্য। দেরিতে হলেও বিরোধীরা উপলব্দি করতে পেরেছেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ছেদ পড়া মানে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা থমকে যাওয়া। অনির্বাচিত ব্যক্তিরা যতোই নিরপেক্ষ, দক্ষ, সৎ, অভিজ্ঞ হোন না কেন, তারা নির্বাচিত সরকারের বিকল্প হতে পারেন না। এদেশের নাগরিক সমাজের একটা অংশ মুখে গণতন্ত্রের কথা বলেন। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রাথমিক পাঠে তাঁরা বিশ্বাস রাখতে চান না।
গণতন্ত্রের প্রাথমিক পাঠে খুব পরিষ্কার; অনির্বাচিত সরকারের চেয়ে নির্বাচিত খারাপ সরকারও ভাল। সেই নির্বাচনটা যদি খারাপও হয়। এই দেশের জন্মই হয়েছে গণতন্ত্রের আঙ্খাকা থেকে। কোন সামরিক, বেসামরিক অনির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা দেয়ার জন্য নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, উর্দি পরা কিছু লোকের উচ্চাকাঙ্খা আর আমাদের রাজনীতিবিদদের উচ্ছিষ্ট খাওয়ার ইচ্ছার কাছে বার বার হার মেনেছে আমাদের গণতন্ত্র।
নিজেদের প্রতি নিজেরা আস্থাহীনতায় ভুগেছেন রাজনীতিবিদরা। সেই সুযোগে কিছু অরাজনৈতিক ব্যক্তি ক্ষমতার স্বাদ নিয়েছেন। আর সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। হতাশ হয়েছেন। গণতন্ত্রের জন্য লড়াই সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু তাদের সেই কাঙ্খিত গণতন্ত্র হোঁচট খেয়েছে। মানুষ এক সময় নিজেদের হতাশা নিজেদের মধ্যেই রেখেছেন। কারণ, রাজনীতিবিদরা সাধারণ মানুষের কাছে সেই বার্তাটা দিতে পারেননি, ক্ষমতায় থেকেও একটা রাজনৈতিক সরকার অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ একটা নির্বাচন করতে পারে।
Advertisement
বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বড় সাফল্য সেই জায়গায়। তিনি বিরোধী রাজনৈতিক দল, জোট, ফ্রন্ট, থেকে সাধারণ মানুষের মনে সেই আস্থার জন্ম দিতে পেরেছেন। হ্যাঁ, তিনি একটা ভাল নির্বাচন উপহার দিতে চান। সেটা দেয়ার সদিচ্ছা তাঁর আছে। বার বার কথাটা তিনি বহুভাবে বলছেন। প্রধানমন্ত্রীর সেই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। সংগে অবশ্য ক্ষমতাসীন দল আর জোটের নেতাকর্মীদের। যাতে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা কোনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। যদি হয়; তাহলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্বাচনে জয়ী হলেও হেরে যাবেন গণতন্ত্রের নেত্রী শেখ হাসিনা। কারণ, বিরোধী দল আর সাধারণ মানুষের মনে প্রকৃত গণতন্ত্রের আস্থার বীজটা বপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং।
নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর দল হারতে পারে। কারণ নির্বাচনে হার-জিত দুটোই থাকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজের চ্যালেঞ্জে হেরে গেলে হেরে যাবে বাংলাদেশ। হেরে যাবে দেশের গণতন্ত্র। আপাত দুর্বল গণতান্ত্রিক নেটওয়ার্কের মধ্যে হয়তো আছি আমরা। কিন্তু এই নির্বাচন আমাদের সামনে বড় সুযোগ গণতন্ত্রের সেই নেটওয়ার্ককে আরো শক্তিশালী করা।
ডিজিটাল বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নেটওয়ার্ক থ্রি জি, ফোর জি নয় অন্তত ফাইভ জি হোক। এবারের নির্বাচন আমাদের সামনে সেরকম একটা বার্তা নিয়ে আসছে।
লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।
এইচআর/পিআর