ধর্ম

তাবলিগের আমির হতে মাওলানা সাদ বেপরোয়া হয়ে ওঠেন যেভাবে

বিশ্বব্যাপী দাওয়াতে দ্বীনের বৃহৎ সংগঠন তাবলিগ জামাত। বর্তমান সময়ে ধর্মীয় অঙ্গনে এ তাবলিগ জামাত সংকটময় সময় অতিক্রম করছে। মাওলানা সাদ কান্ধলভির কিছু বিতর্কিত বক্তব্য, কর্মকাণ্ড ও সিদ্ধান্তে তাবলিগের সাথী ও আলেম-ওলামাদের সঙ্গে বিরোধ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। যা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে।

Advertisement

আলেম-ওলামাদের পরামর্শ ভিত্তিক পরিচালিত এ ধর্মীয় সংগঠনটিতে হঠাৎ করেই কেন এ অরাজকতা সৃষ্টি হলো? এর পেছনে কারণই বা কী? কখন থেকে এ সমস্যার সূত্রপাত হয়? এ সম্পর্কে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, সাময়িকীতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ওঠে এসেছে।

যে সব কারণে মাওলানা সাদ কান্ধলভি তাবলিগ জামাত পরিচালনায় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন কিংবা একক সিদ্ধান্তে তাবলিগ জামাতকে পরিচালিত করতে চান। এমনকি নিজেকে বিশ্ব তাবলিগের আমির ঘোষণা দেয়ার সুযোগ পেয়েছেন; তার পেছনে কারণই বা কী?

তাবলিগের প্রতিষ্ঠাতা হলেন হজরত মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি। তিনি আলেম-ওলামাদের পরামর্শে যে সিদ্ধান্ত হতো সে মোতাবেকই দাওয়াতে দ্বীনের এ সংগঠন তাবলিগের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।

Advertisement

বর্তমানে তাবলিগ জামাতে বিদ্যমান যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে তা মূলত তাবলিগের তৃতীয় মুরব্বি হজরত মাওলানা এনামুল হাসান রহমাতুল্লাহি আলাইহির ইন্তেকালের পর থেকেই শুরু হয়।

মাওলানা এনামুল হাসান রহমাতুল্লাহি আলাইহি ইন্তেকালের ২ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯৩ সনে তাবলিগের কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ১০ সদস্য বিশিষ্ট একটি শুরা কমিঠি গঠন করেছিলেন। তন্মধ্যে-

- ভারতের নিজামুদ্দিনে ছিলেন ৫ জন।- পাকিস্তানের ৪ জন এবং- বাংলাদেশের ১ জন।

এ ১০ জন শুরা সদস্যের মধ্যে বয়স ও অভিজ্ঞতায় সবার ছোট ছিলেন মাওলানা সাদ কান্ধলভি। শুরা কমিটির ১০ জনের একজন হিসেবে তিনি বেশ কিছু দায়-দায়িত্ব পালনের সুযোগ লাভ করেন।

Advertisement

এ সুযোগে তিনি তাবলিগের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে পরিবর্তন আনতে শুরু করেন এবং তার বক্তব্যে দেখা দেয় কুরআন-হাদিসের সঙ্গে নানা অসঙ্গতি। এতে করে অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হতে থাকে।

হজরত এনামুল হাসান রহমাতুল্লাহি আলাইহি কর্তৃক নির্ধারিত ১০ শুরা সদস্যরাও পর্যায়ক্রমে ইন্তেকাল করতে থাকেন। কিন্তু তাদের ইন্তেকালের পর বিভিন্ন কৌশলে নতুন কোনো শুরা সদস্যও তিনি নিয়োগ করতে দেননি।

নতুন শুরা সদস্য না আসায় একসময় তিনি নিজেকে তাবলিগ জামাতের সারা বিশ্বের আমির হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দিতে শুরু করেন। আর তখন থেকেই তাবলিগ জামাতের সমস্যা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।

আরও পড়ুন > যে কারণে বিতর্কিত মাওলানা সাদ

তাবলিগের শুরা সদস্যদের ইন্তেকাল

নিজামুদ্দিনের ৫ শুরা সদস্যদের মধ্যে ৩ জন খুব অল্প সময়ের মধ্যে ইন্তেকাল করেন। ১৯৯৬ সালে হজরত মাওলানা ইজহারুল হাসান সাহেব, ১৯৯৭ সালে হজরত ওমর পালনপুরি সাহেব এবং ১৯৯৮ সালে আরো একজন শুরা সদস্য ইন্তেকাল করেন।

বাকি ছিলেন খুবই নরম তবিয়েতের অধিকারী হজরত মাওলানা জুবাইর সাহেব ও হজরত মাওলানা সাদ সাহেব। ২০১৪ সালে হজরত মাওলানা জুবাইর সাহেব ইন্তেকাল করেন। বাংলাদেশের শুরা সদস্য হজরত আব্দুল মুকিত সাহেবও ইন্তেকাল করেন।

অন্য দিকে পাকিস্তানের হাজি আব্দুল ওয়াহাব সাহেব ছাড়া বাকি ৩ জন আগেই ইন্তেকাল করেন। গত কিছুদিন আগে হাজি আব্দুল ওয়াহাবও ইন্তেকাল করেন।

তাবলিগের এ ১০ শুরা সদস্যদের মধ্যে হজরত সাদ কান্ধলভি সাহেব স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি তৎপর ছিলেন। এ জন্য তার ওপর অনেক বাড়তি একটা গুরুত্বও ছিল। সব মিলিয়ে তিনি নিজামুদ্দিনে একক আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হন।

অন্যদিকে তাবলিগের শুরা সদস্যদের ইন্তেকালের পর নতুন করে কোনো শুরা সদস্য নিয়োগ না করতে মাওলানা সাদ সাহেবই মূল ভূমিকা পালন করেন। তিনি তাবলিগের মূল মারকাজ নিজামুদ্দিন পরিচালনা করছেন।

তাছাড়া তিনি তাবলিগের প্রতিষ্ঠাতা হজরত ইলিয়াস রাহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর বংশের সন্তান। সুতরাং মাওলানা সাদ সাহেবকে বাদ দিয়ে অন্য কেউ শুরা সদস্য নিয়োগ করার উদ্যোগ নেয়াও ছিল বেশ কঠিন। তিনি বিভিন্ন ভাবে শুন্য পদে শুরা সদস্য গ্রহণের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।

এ সব বিষয়েও কোনো আপত্তি আসেনি। যখনই তিনি বিতর্কিত বক্তব্য প্রদান শুরু করেন, তখন থেকেই তাকে তার বক্তব্য থেকে রুজু হওয়ার আহ্বান জানায় ওলামায়ে দেওবন্দসহ বিশ্বের আলেম-ওলামা। তিনি তাঁর বক্তব্য থেকে সরে না এসে নিজেকে বিশ্ব তাবলিগের আমির হিসেবে ঘোষণা করেন।

আরও পড়ুন > যেভাবে বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমা শুরু হলো

যে কারণে বর্তমান সময়ে তাবলিগ জামাতের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে দেশব্যাপী তাবলিগের সাথীরা ২ ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ায় তাবলিগের সম্পূর্ণ কার্যক্রম বর্তমানে বন্ধ প্রায়।

কেউ মাওলানা সাদ কান্ধলভি পক্ষ অবলম্বন করে এতায়াতি নাম ধারণ করেছেন। আবার কেউ আলেম-ওলামাদের পক্ষাবলম্বন করেন আলমি নাম ধারণ করেছেন।

অথচ হজরত ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি কোনো পক্ষ-বিপক্ষ করে তাবলিগ প্রতিষ্ঠা করেননি। তিনি শুরাভিত্তিক আলেম-ওলামাদের পরামর্শের আলোকে পরিচালিত হবে তাবলিগ- এ মর্মে তিনি নিজেসহ হজরত মাওলানা জুবাইর রহমাতুল্লাহি আলাইহি ২০১৪ সাল পর্যন্ত তাবলিগের কাজ পরিচালনা করে গেছেন।

তাবলিগ জামাতের দাওয়াতি কাজের কোথাও এতায়াতি বা আলমি বলে কোনো পক্ষ বিপক্ষ নেই। কিন্তু গত ডিসেম্বরের ১ তারিখ বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের রক্তাক্ত সংঘর্ষের পর বর্তমানে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানসহ সব জায়গায় তাবলিগের কাজ বন্ধ রয়েছে।

২০১৯ সালের বিশ্ব ইজতেমা আদৌও অনুষ্ঠিত হবে কিনা সে ব্যাপারটিও নিশ্চিত নয়।

তাই তাবলিগের সব সাথীরা এবং বাংলাদেশের আলেম-ওলামাসহ সবাই পক্ষ বিপক্ষ মতভেদ ভুলে সঠিক পথে শুরাভিত্তিকভাবে আগের ন্যায় দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ পরিচালনা করবে এমনটাই আশা করছেন মুসলিম উম্মাহ।

এমএমএস/আরআইপি