জাতীয়

আমাকেও গুম করে দিন, তাহলে বাবাকে দেখতে পারব

>> এবার হৃদির মুখে ‘বাবা’, ‘বাবা’ আর কান্না ছাড়া কোনো কথা নেই>> কতদিন হয়ে গেল মা ডাক শুনতে পাই না : মাসুমের মা>> কিছু বলার নেই মারুফ জামানের মেয়ের>> প্রত্যেক দলের ইশতেহারে গুমের বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্যের দাবি

Advertisement

‘কতদিন বাবাকে দেখি না। বাবার আদর পাই না। আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন। আমি বাবার সঙ্গে স্কুলে যেতে চাই। বাবার সঙ্গে খেলতে চাই। আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন। বাবা ছাড়া আমার কিছু ভালো লাগে না।’ কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিল ২০১৩ সালে ‘গুম’ হওয়া সাজেদুল ইসলাম সুমনের মেয়ে আফসানা ইসলাম রাইদা।

মঙ্গলবার ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘গুম হওয়ার পাঁচ বছর শেষ, আর অপেক্ষা কতদিন’ শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করে ‘মায়ের ডাক’ নামের একটি সংগঠন। এতে গুম হওয়াদের স্বজনরা বক্তব্য দেন।

মাইকে যখন রাইদা তার বাবাকে ফিরে পাওয়ার আকুতি জানাচ্ছিল তখন তার দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। তার সেই কান্নায় যেন ভিজে যাচ্ছিল সভায় উপস্থিত সকলের হৃদয়।

Advertisement

 

উচ্চ স্বরে কাঁদতে কাঁদতে রাইদা বলছিল, আমি আমার বাবাকে দেখতে চাই। আমার বাবা কোথায়? আমার বাবা কেমন আছে, আমি কিছু জানি না। আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন।

‘আমাকে আমার পরিবার বলে সাবধানে চলতে। আমি সাবধানে চলে কী করব। আমাকে নিয়ে যাবে, আমাকেও নিয়ে যেতে দিন, গুম করে দিন। তাহলে আমি আমার বাবাকে দেখতে পারব। আমি কেমন সন্তান যে, আমার বাবাকে পাঁচ বছর ধরে দেখতে পাই না,’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিল রাইদা।

২০১৩ সালে গুম হওয়াদের স্বজনদের নিয়ে এ আলোচনা সভায় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন নিখোঁজ সুমনের বড় বোন মারুফা ইসলাম ফেরদৌসী।

তিনি বলেন, প্রতিবছর আমরা আপনাদের কাছে ছুটে আসি এবং আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসী জানতে পারে আমরা আমাদের স্বজনদের হারিয়ে কত কষ্টে জীবনযাপন করছি। দেখতে দেখতে পাঁচটি বছর শেষ হয়ে গেছে। সামনে চলে এলো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনে বর্তমান সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করছে। আমাদের ‘মায়ের ডাকের’ পক্ষ থেকে সব রাজনৈতিক দলের প্রতি একটি দাবি, তাহলো- দলীয় ইশতেহারে গুম হওয়ার বিষয়ে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের স্পষ্ট বক্তব্য থাকতে হবে।

Advertisement

মারুফা বলেন, গত পাঁচ বছরে গুম হওয়া কেউ ফিরে আসেনি। কিন্তু গুম হওয়া পরিবারের অনেকেই কাঁদতে কাঁদতে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। মুন্নুর বাবা এই প্রেস ক্লাবে এসে সন্তানের ফিরে আসার দাবি জানিয়েছিলেন, এখন তিনি চিরদিনের জন্য আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। পারভেজ হোসেনের বাবা ও শ্বশুর না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তার মেয়ে হৃদি এখন কাউকে দাদু-নানু ডাকতে পারে না। সাইফুর রহমান সজীবের মা রেনু মারা গেছেন। ঝন্টুর বাবাও মৃত্যুবরণ করেছেন।

গত বছর ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত এমনই এক আলোচনা সভায় যুবদল নেতা পারভেজ হোসেনের চার বছর বয়সী মেয়ে হৃদি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বক্তব্য দিয়ে হৃদয়বিদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। এবারের আলোচনাতেও কথা বলেছে হৃদি। তবে ‘বাবা’, ‘বাবা’ আর কান্না ছাড়া এবার তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয়নি।

গুম হওয়া মারুফের বোন রত্না বলেন, পাঁচ বছর হয়ে গেলে আমার ভাইকে দেখতে পাই না। সে কোথায় আছে, কেমন আছে, আমরা কিছুই জানি না। আমাদের কোনোকিছু চাওয়ার নেই, শুধু আমার ভাইকে ফেরত চাই।

অপর গুম হওয়া আব্দুল কাদের মিয়া মাসুমের মা আয়শা আলী বলেন, আমি আমার ছেলেকে সব জায়গাই খুঁজে বেড়াই। কিন্তু কোথাও পাই না। আজ কতদিন হয়ে গেল মা ডাক শুনতে পাই না। আমার একটাই সন্তান। পাঁচ বছর ধরে সরকারের কাছে একটাই দাবি জানাচ্ছি, আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দিন। প্রধানমন্ত্রীও তো স্বজনহারা। তিনি কি স্বজন হারানোর ব্যথা বুঝেন না? আমি চাই আগামী ভোটের আগেই আমার সন্তানকে আমার কোলে ফিরিয়ে দিন।

আলোচনা সভার আয়োজকদের পক্ষ থেকে গুমের বিষয়ে কিছু বলার জন্য ডাকা হয় মারুফ জামানের মেয়ে সামিয়া জামানকে। বাবাকে খুঁজে না পাওয়া এই তরুণী মাইক হাতে নিয়ে বলেন, ‘আমার কিছু বলার নেই।’

পাঁচ বছর আগে গুমের শিকার হওয়া সুমনের মা হাজেরা বেগমের সভাপতিত্বে সভায় উপস্থিত ছিলেন- নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, বিএনপি নেতা তাবিথ আউয়াল, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের ফয়জুল হাকিম লালা, মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অধিকারের পরিচালক নাসির উদ্দিন এলএম প্রমুখ।

এমএএস/এমইউএইচ/জেডএ/এমএস