আন্তর্জাতিক

‘তারা আমার পা কেটে ফেলেছে, আমার স্বপ্নকে নয়’

ছেলেটিকে দেখলে কেউ কেউ হাসে। আবার কেউ কেউ অবজ্ঞার সুরে বলে-‘এই শরীর নিয়ে এ আবার কী করবে?’ তবে সকলের এরকম অবহেলা ও অবজ্ঞা সত্ত্বেও থেমে যাননি ফিলিস্তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী তরুণ আব্দুল রহমান আবু রাওয়া।

Advertisement

কঠিন ইচ্ছাশক্তি আর প্রবল ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির জোরে তিনি সবাইকে ভুল প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। তার ডান হাত ও পা নেই। তারপরও এই শরীরে এক হাত ও পা দিয়েই গাজার বালুকাময় রাস্তায় দিব্যি সাইকেল চালিয়ে যেতে পারে তিনি।

তাকে দেখলে এটি অসম্ভব মনে হলেও সে ঠিকই এটিকে সম্ভব করে তুলেছে। এক হাত ও পা দিয়ে সাইকেল চালাতে তার মোটেও সমস্যা হয় না। দারুণভাবে ব্যালেন্স করে সে গাজা ভূখণ্ডের উত্তরাঞ্চলের গ্রামে তার প্রতিবেশীদের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করে সে।

আবু রাওয়া জানান, সাইকেল চালাতে পারাটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। তাকে দেখে হয়তো সে রকম না-ও মনে হতে পারে, মনে হতে পারে এই শরীরে কীভাবে সাইকেল চালানো সম্ভব! তবে সে এটা করতে পেরেছে এবং এটাই বাস্তব।

Advertisement

প্রথমদিকের দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে রাওয়া জানান, প্রথমদিকে তাকে সবাই বলত-এটা বিপজ্জনক। অনেকে ব্যঙ্গও করত। এই শরীর নিয়ে সাইকেল চালাতে দেখে মজা করত অনেকে। রাওয়া বলেন, আমি তাদের অবজ্ঞাকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলাম। এখন আমি নিজের কাছে ও অন্যদের কাছ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি যে, আমার শারীরিক অক্ষমতা আমার জন্য কোনো বাধা নয়।

রাওয়া বর্তমানে ২৩ বছরের একজন টগবগে তরুণ। ডান হাত ছাড়াই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পরে পরপর দুটি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এক পা-ও হারাতে হয়। তবে এক হাত ও পা না থাকা সত্ত্বেও তিনি থেমে যাননি। জীবনযুদ্ধে তিনি পুরোপুরি একজন লড়াকু সৈনিক।

গত সোমবার ছিল আন্তর্জাতিক শারীরিক প্রতিবন্ধী দিবস। শত শত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও গাজা ভূখণ্ডের শারীরিক প্রতিবন্ধীরা এইদিন জানালেন তারা কীভাবে তাদের প্রতিবন্ধকতা জয় করে স্বপ্নকে পূরণ করেছেন।

ইসরায়েলি সেনা ও সীমান্তে মিসরের অবরোধের কারণে এমনিতেই বিপর্যস্ত গাজায় বসবাসরত ২০ লাখ ফিলিস্তিনির জীবন। এই অবস্থায় তাদের মধ্যে যারা শারীরিক প্রতিবন্ধী তাদের জীবন আরও চ্যালেঞ্জের। বিশেষ করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হলে নিদারুণ কষ্ট করতে হয় তাদের। ঘনবসতিপূর্ণ গাজার বাড়িঘরগুলোও শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের থাকার উপযোগী নয়। দৃষ্টি-প্রতিবন্ধীদের অবস্থা আরও করুণ। সেখানকার আর্থিক অবস্থায়ও অতটা ভালো নয় যে, শারীরিক প্রতিবন্ধীরা পর্যাপ্ত সেবা পেতে পারেন।

Advertisement

নিজের সাইকেল নিজেই ঠিক করেন এক পা ও হাত হারানো রাওয়া

শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য কৃত্রিম অঙ্গ বিশেষ সহায়ক। তবে গাজায় কৃত্রিম যেসব অঙ্গ পাওয়া যায় তার মান অতটা ভালো নয়। কারণ অবরোধের কারণে কৃত্তিম অঙ্গ তৈরির কাঁচামাল ও উন্নতমানের কৃত্তিম অঙ্গ আমদানি বাধাগ্রস্ত হয়।

শত শত অংশ জোড়া লাগিয়ে এসব কৃত্তিম অঙ্গ তৈরি করা হয়। তবে এর কোনো একটি অংশ হারিয়ে গেলে কৃত্তিম অঙ্গ তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। ফলে গাজায় অবস্থা এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে যে, এসব অংশ হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া কেউ এসব কৃত্তিম অঙ্গ পরতে চান না।

প্রথম দিকে রাওয়া কৃত্তিম হাত ও পা ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলেন। আর এটা কিনতে খরচ হয়েছিল ২ হাজার ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় ১ লাখ ৬৭ হাজার।

গাজায় বসবাসরত মানুষের যে আর্থিক অবস্থা সে হিসাবে এই পরিমাণটা কোনো পরিবারের জন্য গলাকাটা দাম।

অবশ্য রাওয়া কৃত্তিম অঙ্গ বেশিদিন ব্যবহার করতে পারেননি। কারণ এটি পরলে তার ত্বকের ক্ষতি হচ্ছিল। এজন্য তিনি হুইলচেয়ার ব্যবহার করা শুরু করলেন। তবে এটাও তার জন্য তেমন কোনো কাজে আসেনি। হুইলচেয়ার থেকে প্রায়ই পরে যেতেন তিনি এবং এটির ব্যবহারও তার জন্য আরামদায়ক ছিল না।

‘অবশেষে একদনি আমি লক্ষ্য করলাম আমার ভাই তারেক সাইকেল চালাচ্ছে। আমি তাকে বললে সে আমাকে সাইকেল চালাতে দিল। যদিও আমি প্রথমবারই পরে গিয়েছিলাম, তারপরও আমার অনুভূতিটা দিল দারুণ। ধীরে ধীরে আমি সাইকেলে ভারসাম্য ঠিক রাখতে শিখে গেলাম। বাবা এটি দেখে খুশি হলেন এবং আমাকে নতুন একটি সাইকেল কিনে দিলেন। একপর্যায়ে ভালোভাবেই সাইকেল চালানো শিখে গেলাম আমি। এমনকি সাইকেলে করেই স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম। বাড়ি থেকে স্কুল প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ছিল। এভাবে চলাফেরার জন্য আমি পুরোপুরি সাইকেলের ওপর নির্ভর হয়ে গেলাম’-যোগ করেন রাওয়া।

২৩ বছরের এই তরুণ জানান, যদি কখনও সাইকেলের কোনো অংশ ভেঙে যায় বা কাজ না করে, তাহলে আমি নিজেই এটি ঠিক করি। এ সময় অনেকেই আমাকে বলত, তুমি কখনও পারবে না। অথচ আমি তাদের করে দেখিয়েছি।

শারীরিক প্রতিবন্ধী এই তরুণের ভাষ্য, মানুষ কেন বলে আমি এটা করতে পারব ওটা পারব না। তারা কেন এটা বলে? তাদের তো উচিত অন্তত চেষ্টা করে দেখা যে, আসলেই সে পারে কি না। আপনি যদি চেষ্টা করেন তাহলে আপনি অবশ্যই পারবেন। প্রত্যেকেরই উচিত চেষ্টা করে যাওয়া। কারণ জীনবটাই হলো চেষ্টার।

‘তারা আমার পা কেটে ফেলেছে, আমার স্বপ্নকে নয়’

রাওয়ার মতে, আগে যেভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অবজ্ঞার চোখে দেখা হতো, এখন সে প্রবণতা অনেকটা কমে গেছে। বিশেষ করে ইসরায়েলি হামলার জের ধরে অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। ফলে এখন দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্যানুসারে, চলতি বছরের ৩০ মার্চ থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ কর্মসূচির জের ধরে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় অন্তত ৫ হাজার ৩০০ ফিলিস্তনি আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে অন্তত ৬৮ জনের পা কেটে ফেলতে হয়েছে। পা হারানো আরেকজন আলা আলদালি। ৩০ মার্চ দ্য গ্রেট মার্চ রিটার্ন কর্মসূচি চলাকালে ইসরায়েলি সেনার ছোড়া একটি গুলি এসে তার পায়ে লাগে। আঘাতটি গুরুতর হওয়ায় পরে অস্ত্রোপচার করে পা কেটে ফেলতে হয়।

রাওয়ার মতো তারও চলাফেলার একমাত্র অবলম্বন সাইকেল। একমাত্র ঘুমানোর সময় বাদে বেশিরভাগ সময়ই তার সাইকেল চড়ে কাটে। আলদালির স্বপ্ন ছিল গত আগস্টে ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত সাইকেল চালানো প্রতিযোগিতায় নাম লেখানোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফিলিস্তিনির প্রতিনিধিত্ব করা। তবে তার স্বপ্নে গুড়েবালি হয় যখন সে তিনি দেখলেন ইন্দোনেশিয়া যাওয়ার আগেই এক বিকেলে ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনির সংঘর্ষ বেধে যায়।

তবে আলদালি তার স্বপ্ন এখনও জিইয়ে রেখেছেন। তিনি মনে করেন, যদিও তার এক পা নেই, তারপরও ঠিকই একদিন এই এক পা নিয়েই একজন সাইক্লিস্ট হিসেবে বিশ্বে ফিলিস্তিনির প্রতিনিধিত্ব করবেন

‘তারা আমার পা কেটে ফেলেছে, কিন্তু আমার স্বপ্নকে নয়। আমার প্রিয় খেলা নিয়েই আবার আমি ফিরে আসব। আমরা অবশ্যই আবার আগের বাড়িতে ফিরে যাব। আমরা ফিলিস্তিনিরা যে ত্যাগ স্বীকার করছি, তা বৃথা যেতে পারে না’-যোগ করেন আলদালি।

সূত্র : আল জাজিরা

এসআর/জেআইএম