টেস্টে গত দেড়যুগে যা হয়নি, ১১২ নম্বর টেস্টে এসে তাই হলো। এতদিন যা ছিল অধরা কৃতিত্ব, আগে কখনো স্বাদ মেলেনি, এবার ঘরের মাঠে সেই না পাওয়া স্বাদ নিল টাইগাররা। প্রথমবারের মত ইনিংস জয়ের স্বাদ পেল সাকিবের দল।
Advertisement
ঘরের মাঠে স্পিন ট্র্যাকে খেলা আর চার স্পিনার নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বধ। দুই ম্যাচের সিরিজে ক্যারিবীয়দের হোয়াইটওয়াশ। ১৮ বছরে ১১২ নম্বর টেস্টে এসে প্রথম ইনিংস জয়। বাংলাদেশের বোলারদের মধ্যে টেস্টে এক ম্যাচে অফস্পিনার মেহেদি হাসান মিরাজের (১১৭ রানে ১২) সেরা বোলিং নৈপুণ্য। সব মিলে টাইগারদের শৌর্য্য-বীর্য্য আর শ্রেষ্ঠত্বে গাঁথা এক সিরিজ। কোথায় উৎসবের জোয়ারে ভাসবে বাংলাদেশ, খুশির ফলগুধারা বইবে গোটা দেশে!
বিজয়ের মাসে ক্রিকেটের ব্যতিক্রমী সাফল্যে অন্যরকম হৈ চৈ হবে, রীতিমত সাড়া পড়ে যাবে চারিদিকে। একটা আনন্দ মুখর পরিবেশে সাকিব, মুমিনুল, মাহমুদউল্লাহ, লিটন, তাইজুল, মিরাজ ও নাঈমদের বরণ করে নেয়া হবে। কিন্তু তা নেই। জয় নিয়ে উচ্ছ্বাস আছে। উল্লাস নেই তেমন। বরং চারিদিক কেমন যেন নিস্তব্ধতা।
ভাবছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগত। বড় ছোট সব রাজনৈতিক দল, নেতা-কর্মী আর সমর্থকরাসহ গোটা জাতি ব্যতিব্যস্ত ভোট নিয়ে। হ্যাঁ, সেটা একটা কারণ। তবে তা ছাপিয়ে আসল কাহিনী ভিন্ন।
Advertisement
ঘরের মাঠে টাইগারদের এ সাফল্যর প্রশংসা করছেন কম বেশি সবাই। সাকিব বাহিনীর কৃতিত্ব, অর্জন ও প্রাপ্তি যে দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে একটা নতুন মাইল ফলক- তা মানছেন সবাই।
পাশাপাশি বলা হচ্ছে , বাংলাদেশের স্পিনারদের সামর্থ্য বেড়েছে। তারা এখন ঘরের মাঠে ‘হোম অ্যাডভান্টেজ’ নিতে শিখেছেন। বিশ্বের সব দলের বোলাররা নিজ দেশের কন্ডিশনের সর্বোচ্চ ফায়দা নিয়ে থাকেন। এবার বাংলাদেশের মিরাজ, তাইজুল, নাঈম ও সাকিবরাও নিয়েছেন।
তবে ক্রিকেটারদের পারফরমেন্সের প্রশংসা হলেও তাকে খুব বড় করে দেখায় অনীহা কারো কারো। মোদ্দা কথা, টাইগারদের এ সাফল্যের অনুভূতি আসলে মিশ্র। একদম উচ্ছসিত প্রশংসার নহর বয়ে যায়নি। অনেকেরই কথা, ঘরের মাঠে এমন স্পিন পিচে ক্যারিবীয়দের নাকাল করে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার কিছু নেই। এ সাফল্য সাময়িক। এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের মত দলের বিপক্ষে, যারা স্পিনে তত পারদর্শী না। সেই দলের বিপক্ষে চার স্পিনার খেলিয়ে জয় নিয়ে খুব বেশি হৈ চৈ করার কিছু নেই।
উপমহাদেশের কোন দলের বিপক্ষে অমন টার্নিং পিচে খেললো তো আর এমন সাফল্যর দেখা মিলবে না। আর এই স্পিন নির্ভরতা দেশের বাইরে কাজে দেবে না। তখন নানা ঝক্কি ও ঝামেলায় পড়তে হবে।
Advertisement
জাতীয় দলের দুই সাবেক অধিনায়ক এবং বর্তমান বাংলাদেশ জাতীয় দলের ‘থিঙ্কট্যাঙ্ক ’ আকরাম খান ও মিনহাজুল আবেদিন নান্নু এ সময়ের এ আলোচিত ইস্যুতে জাগো নিউজের সাথে কথা বলেছেন। তারা তিনজনই একমত, ঘরের মাঠে স্পিন সহায় পিচ তৈরি করা এবং চার স্পিনার নিয়ে মাঠে নেমে ক্যারিবীয়দের নাকাল করায় কোন দোষ নেই। এতে ‘মহাভারত অশুদ্ধ ’ হয়নি। বিশ্বের সব দেশই হোম অ্যাডভান্টেজ নেয়। বাংলাদেশও নিয়েছে।
তবে আকরাম খান ও মিনহাজুল আবেদিন নান্নু মানছেন, এই চার স্পিনার ফর্মূলা ও স্পিন ট্র্যাকে খেলা- পুরোপুরি কৌশলের অংশ। সব সময় দলের সাথে এমন হবে না। স্পিনে পারদর্শী দলগুলোর সাথে অমন উইকেটে খেলাও হবে না। চার স্পিনারও খেলবে না।
আগে ফার্স্টক্লাস ক্রিকেটে ফাস্ট ও বাউন্সি পিচে খেলা জরুরি : আকরামবিসিবি ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান আকরাম খান বলেন, ‘চার স্পিনার খেলানো এবং শতভাগ স্পিন সহায় পিচে টেস্ট আয়োজন পুরোপুরি পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায়। এটা সাময়িক সিদ্ধান্ত। শতভাগ সাময়িক ফর্মূলা।
আকরাম পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন, স্পিন সহায় পিচ এবং চার চারজন স্পিনার নিয়ে মাঠে নামা তাদের লক্ষ্য ও পরিকল্পনার অংশ। তাই তো মুখে এমন কথা, ‘আমরা দল দেখে তাদের শক্তি ও সামর্থ্য খুঁটিয়ে বিচার বিবেচনা করে এমন উইকেটে খেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের জেতার লক্ষ্য ছিল। ড্র করার ইচ্ছে থাকলে উইকেটের অবস্থা এমন থাকতো না।’
আকরাম কিছুতেই মানতে চান না যে উইকেট খারাপ ছিল। তার ভাষায়, ‘চট্টগ্রামের উইকেটে বল ঘুরেছে। সেটাকে টার্নিং পিচ বলা যায়। কিন্তু ঢাকায় শেরে বাংলার পিচ মোটেই তত খারাপ বা স্পিন সহায় ছিল না। আমাদের বোলাররা ভালো জায়গায় বল ফেলেছে। আর ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানরা তার যথাযথ জবাব দিতে পারেনি, তাই বার বার পরাস্ত হয়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বেশির ভাগ ব্যাটসম্যানের স্পিনে দূর্বলতা আছে, তাই আমরা স্পিন উপযোগি পিচ তৈরি করেছি।’
আকরাম খানের শেষ কথা, আসলে রাতারাতি দেশের পিচের চরিত্র বদলে ফেলা সম্ভব না। আগে ঘরোয়া ক্রিকেটে বিশেষ করে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে পেস সহায় উইকেট তৈরি করে স্থানীয় ব্যাটসম্যান ও বোলারদের সে পিচে খেলার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। তাতে করে ব্যাটসম্যানদের ফার্স্ট, বাউন্সি ও ঘাসের উইকেটে খেলার কৌশল রপ্ত হবে। ঐ কন্ডিশনে ভালো খেলার মানসিকতাও জন্মাবে। আর পেস বোলাররাও জানবে ঘাসের উইকেটে কোন লাইন ও লেন্থে বল ফেললে সফল হওয়া যায়, সমীহ আদায় করা যায়।
আকরাম বলেন, ‘আমরা ঐ সব পিচে পেসারদেরও আগামীর জন্য তৈরি করার চেষ্টা করছি। সে কারণেই জাতীয় লিগ ও বিসিএল ঘাসযুক্ত ফার্স্ট-বাউন্সি পিচে আয়োজন করা হচ্ছে। আমরা চাচ্ছি দেশের পেসারদের ঐ রকম উইকেটে অভ্যস্ত করে তুলতে। তারপর দেশে অমন উইকেটে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।’
উপমহাদেশের দল হলে এমন উইকেটে খেলা হতো না : নান্নুপ্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নুও ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান আকরাম খানের মতো একই সুরে কথা বলেন। নান্নু অকপটে স্বীকার করেছেন, ‘আমরা আসলে অনেক ভেবে ও চিন্তে এই উইকেটে খেলা দিয়েছি। আমরা জানি ক্যারিবীয়রা পেস বোলিংয়ের বিপক্ষে অনেক স্বচছন্দে খেলে। সাবলীল ব্যাটিং করে। তাদের বিপক্ষে শতভাগ ব্যাটিং সহায় ও স্পোর্টিং পিচে আমরা জেনে বুঝে খেলতে চাইনি। তাতে সফল হবার সম্ভাবনা খুব কম থাকতো। আমরা জিততে চেয়েছি, আর জেতার জন্যই আমরা ভেবে চিন্তে স্পিন সহায় পিচে খেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
প্রধান নির্বাচক পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, জয়ের চিন্তায়ই চার স্পিনার খেলানো। তাই মুখে এমন কথা, ‘আমরা ড্র‘র জন্য খেলিনি। জিততে চেয়েছি। তাই যে পিচে খেলা হয়েছে, সেটা পার্ট অফ গেম প্ল্যান। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, জিততে হলে স্পিন দিয়েই জিততে হবে। ক্যারিবীয়দের ঘায়েল করতে হলে স্পিনই হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র। পেস বোলিং সহায় পিচ হলে বরং উল্টো ক্যারিবীয় পেসারদের দৌরাত্মে আমরা বিপাকে পড়তাম। তাই আমরা এমন পিচে খেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
এআরবি/এমএমআর/এমএস