বিশেষ প্রতিবেদন

জলে ভাসা পদ্ম ওরা

আলো ও আঁখি। দুজনেই অবুঝ। আলো সবার মতোই স্বাভাবিক। কিন্তু আঁখি অস্বাভাবিক। মানে বুদ্ধি প্রতিবন্ধি।  আলোর বয়স ১৮ বছরের কাছাকাছি। আঁখির বয়সও তাই। তাদের বাড়ি ঠাকুরগাঁও শহরের কলেজ পাড়ায়। দুজনেই অভাবি বাবার সন্তান। কোনো মতে দিন চলে তাদের। কিন্তু, আশ্চর্যজনক ঘটনা হলো এই দুই কিশোরীর ঘরে বড় হচ্ছে তাদের পিতৃ পরিচয়হীন সন্তান।  দুই কাপুরুষ তাদের করুণ এই অবস্থা সৃষ্টি করলেও সঠিক বিচারের অভাবে এই দুই কিশোরীর দুই সন্তান পাচ্ছেনা তাদের বাবার পরিচয়। দুইজনেরই মামলা ঠাকুরগাঁও নারী শিশু আদালতে বিচারাধীন।২০০৯ সালের ঘটনা।  আলোর বয়স তখন মাত্র ১২ বছর। একদিন বাড়ির পাশে খেলাধুলা করার সময় পরিচয় ঘটে একই এলাকার হায়দার আলীর ছেলে হাসমতের সঙ্গে। পরিচয়ের এক মাসের মাথায় হাসমতের পরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে আলোর।মূল ঘটনাটি ঘটে একই সালের সেপ্টেম্বরে। একদিন হাসমত আলোদের বাড়িতে এসে তাকে ডেকে নিয়ে যায় তাদের বাড়িতে। সেখানে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং আলোকে বিষয়টি কাউকে না জানানোর ভয় দেখায়।  লোক লজ্জার ভয়ে কিশোরী আলো বিষয়টি কাউকেই জানায়নি।এভাবে চলার তিন মাস পর অসুস্থ হয়ে পড়ে আলো। ডাক্তারের কাছে নেওয়ার পর আলোর পরিবার জানতে পারে তাদের মেয়ে তিন মাসে অন্তঃসত্ত্বা। এবার আলো বিষয়টি তার পরিবারকে জানায়। বাবা সানোয়ার হোসেন শানু কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে এলাকার কয়েকজন মাতব্বরকে বিষয়টি জানান। কিন্তু, মাতব্বররা আগে থেকেই ভিড়ে ছিল হাসমতের পরিবারের সঙ্গে। তখন ওই মাতব্বররাই শানুকে হুমকি দেয় বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার। লোক লজ্জার ভয়ে চেপে যায় শানু। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না তিনি। অন্যদিকে মেয়ের পেটে তার সন্তান বড় হচ্ছে। অথচ সামাজিক কোনো পরিচয় নেই কার সন্তান সেটি। আলোর বাবা এবার সরাসরি হাসমতের বাড়িতে গিয়ে মিমাংসার দাবি জানায়। হাসমতের পরিবার এলাকায় প্রভাবশালী হওয়ায় মারধর করে শানুকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এভাবে তিন মাস চলার পর ২০১০ সালে আলোর মা সুলতানা বেগম বাদী হয়ে ঠাকুরগাঁও সদর থানায় একটি ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন।মামলার কিছুদিন পরেই আলো একটি কন্যা সন্তান প্রসব করে। এখন আলোর ওই বাচ্চার বয়স সাড়ে চার বছর।  নাম হাসনা বানু।আলোর এই মামলাটির বয়সও প্রায় পাঁচ বছর। এখনো পর্যন্ত পুলিশ এ মামলার আসামিদের গ্রেফতার করতে পারেনি।অন্যদিকে একই এলাকায় এরকমই ঘটনার শিকার হয়েছে হাফিজুর রহমানের মানসিক প্রতিবন্ধি মেয়ে আঁখিও। তার ঘরেও বড় হচ্ছে তারই মতো প্রতিবন্ধি কন্যা সন্তান মীম। ৯ বছর বয়স তার।আঁখির সঙ্গে এই ঘটনাটি ঘটেছে ২০০৫ সালে। আঁখির বয়স তখন মাত্র ১৩ বছর।  প্রতিবন্ধি হওয়ায় এলাকায় সবার সঙ্গেই মিশতো আঁখি। কিন্তু তার এই সহজ সরলতার সুযোগ নিয়ে একই এলাকার দুই সন্তানের জনক দুলাল হোসেন (৩১) আঁখিকে তার বাড়িতে নিয়ে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। কিছুদিন পর অসুস্থ হয়ে যায় আঁখি। ডাক্তারের কাছে নেওয়ার পর পরিবারের লোকজন জানতে পারে সে সন্তানসম্ভবা।একই সালের ডিসেম্বর মাসের দিকে প্রতিবন্ধি কন্যা মীমের জন্ম দেয় আঁখি। এ ঘটনায় আঁখির বাবা মামলা করলেও সেটিও ঠাকুরগাঁও নারী শিশু আদালতে বিচারাধীন। বর্তমানে প্রতিবন্ধি মেয়ে ও নাতীকে নিয়ে অসহায় জীবন যাপন করছেন এই বাবা।সম্প্রতি এই দুই পরিবারের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। বাবার পরিচয় ছাড়াই তাদের সন্তানদের মানুষ করছেন আলো ও আঁখি। এখনো তাদের ভরসা একদিন পরিচয় ফিরে পাবে তাদের সন্তানরা।এই দুই ঘটনার প্রেক্ষিতে ঠাকুরগাঁও নারী শিশু আদালতের বিশেষ পিপি নজমুল হুদার সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের।তিনি বলেন, শুধু আলো ও আঁখি নয়, নারী ও শিশু আদালতে এরকম ১৫টি মামলা রয়েছে বিচারাধীন। প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে এই ১৫টি মামলার ভিকটিম তাদের সন্তানদের পিতৃ পরিচয় পাচ্ছেন না।তিনি আরও বলেন, এসব মামলা ১৩-১৪ বছর আগের। মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা আদালতে চার্জশিট দিলেও ডিএনএ টেস্ট না করতে পারার কারণে এখনো পর্যন্ত মামলাগুলো ঝুলে রয়েছে।নজমুল হুদা বলেন, ডিএনএ টেস্ট করতে ঢাকায় পাঠাতে হয়। এজন্য প্রয়োজন ১৫ হাজার টাকা। মামলার ভিকটিম, অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং তাদের সন্তানসহ তিনজন ও একজন পুলিশ সদস্যকে ঢাকায় পাঠানোসহ মোট খরচ দাড়ায় প্রায় ২০ হাজার টাকা।  ভিকটিমের পরিবারগুলো গরীব হওয়ায় তারা এই টাকা যোগাড় করতে পারেনা। অপরদিকে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা গ্রেফতার না হওয়ার কারণেও মামলাগুলো এতদিন ধরে ঝুলে রয়েছে।তিনি বলেন, গত দেড় বছর আগে লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে একটি মামলার ডিএনএ টেস্টের খরচ হিসেবে ১৫ হাজার টাকা পাওয়া গেছে। তাদের কাছে টাকার জন্য আরো ছয়টি আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ঠাকুরগাঁওয়ে লিগ্যাল এইডের কার্যক্রম সক্রিয় না থাকায় তাদের কাছে আশানুরুপ সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছেনা।এসব বিষয়ে জাগো নিউজের কথা হয় নারীদের নিয়ে বিভিন্ন কাজ করা সংগঠন এনজিও সেলের এক কর্মকর্তার সঙ্গে।সিনিগ্ধা নামে এই কর্মকর্তা বলেন, এনজিও সেল মূলত কাজ করে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে। কিভাবে নারীরা সমাজে ক্ষমতা বিস্তার করবে এই বিষয়গুলো নিয়েই আমাদের কাজ।তিনি বলেন, অসহায় এবং নির্যাতিত নারীদের নিয়ে কাজ করে জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর।এমএএস/আরআইপি

Advertisement