‘হোয়াইটওয়াশের হ্যাটট্রিক’ মিশন সফল। সেই সাথে আরেক অন্যরকম ‘হ্যাটট্রিক’ পূর্ণ করলেন সাকিব আল হাসান। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের দুই ডানা অজস্র সাফল্যের পালকে ভরা।
Advertisement
একজন ক্রিকেটার হিসেবে যত রকম কৃতিত্ব, অর্জন আর প্রাপ্তি সম্ভব-তার প্রায় সবটুকুই এরই মধ্যে আহরণ করে ফেলেছেন সাকিব। সবাই দেখেছে, ঢাকা টেস্টে সাকিবের গতিশীল নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ইনিংস ও ১৮৪ রানে হারিয়ে ১১২ নম্বর টেস্টে এসে প্রথম ইনিংস জয়ের স্বাদ পেয়েছে বাংলাদেশ।
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, সাদমান ইসলাম, সাকিব ও লিটন দাসের আত্মবিশ্বাসী আর কার্যকর ব্যাটিং এবং অফস্পিনার মিরাজের ক্যারিয়ার সেরা বোলিংয়ে ১১৭ রানে ১২ উইকেট (৭/৫৮+ ৫/৫৯) সাথে জয়ের অদম্য স্পৃহা আর ভালো খেলার দৃঢ় সংকল্পর অনুপম মিশেল এই অবিস্মরণীয় জয়।
কিন্তু এ ম্যাচে আরও একটি বড় অর্জন আছে। বাংলাদেশ এর আগে যে দুটি সিরিজে প্রতিপক্ষকে (ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর জিম্বাবুয়ে) হোয়াইটওয়াশ করেছিল, তার দুটিতেই ম্যান অফ দ্য সিরিজ সাকিব আল হাসান। এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ঘরের মাঠে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে সেরা পারফরমারও সাকিব।
Advertisement
তার মানে কি দাঁড়াল? বাংলাদেশ যখন কাউকে টেস্টে ‘বাংলাওয়াশ’ করে, তার সিরিজ সেরার পুরস্কারটা শুধু একজনের হাতে মানে সাকিবের হাতেই ওঠে। অথচ তার নাকি এ সিরিজের প্রথম ম্যাচ খেলার কথাই ছিল না। ঢাকা টেস্ট শুরুর আগের দিন জনাকীর্ণ সংবাদ সন্মেলনে সাকিব জানিয়ে দেন, তিনি প্রথম টেস্টে অপ্রস্তুত ও ফিটনেসে ঘাটতি নিয়ে খেলেছেন।
তারপরও পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ফিট ও প্রস্তুত সাকিব প্রথম টেস্টে ম্যাচ জেতানো পারফরম করতে না পারলেও ঠিক সময় মতো কাজের কাজ করে দিয়েছেন। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি বল ও ব্যাট (৩৪+১=৩৫ রান আর ৩/৪৩+২/৩০) হাতে ঠিক কার্যকর অবদান রাখেন সাকিব।
আর এই টেস্টে একবার ব্যাট করার সুযোগ পাওয়া সাকিব করেছেন ৮০ (১৩৯) রান। আর দুই ইনিংসে (৩/২৭ + ১/৬৫) পতন ঘটান চার উইকেটের। তার মানে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় দুই টেস্টের তিন ইনিংসে (৩৪+১+৮০) = ১১৫ রান এবং দুই টেস্টে (৩/৪৩+২/৩০+৩/২৭+১/৬৫)= ৯ উইকেট।
এই দুই ম্যাচে সাকিব কেমন খেলেছেন, ম্যাচ জয়ে তা ভূমিকা কি ছিল, তা শুধু এই পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যাবে না। সাকিবের সত্যিকার পারফরমেন্স জানতে হলে দুই ম্যাচের চালচিত্র খুঁটিয়ে দেখতে হবে।
Advertisement
প্রথম কথা হলো- সাকিব দুই টেস্টে যে চার বার বোলিং করেছেন তার তিনবারই প্রথম ওভারে উইকেট পেয়েছেন। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে প্রথম ইনিংসে বল হাতে নিয়েই ব্রেক থ্রু দিয়েছেন। পরের ইনিংসে না পারলেও শেরে বাংলায় দুই বারই বল হাতে নিয়েই উইকেট। বিশেষ করে এ টেস্টে উদ্বোধনী বোলারের ভূমিকা নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংসের প্রথম ওভারে বল করতে গিয়েই আঘাত হেনেছেন।
বার বার বোলিংয়ে গিয়ে ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানদের আউট করে নিজ দলকে করেছেন চাঙ্গা। আর উইন্ডিজ শিবিরে কাঁপন ধরিয়েছেন সাকিব। আর ঢাকা টেস্টে দলের প্রয়োজনে ৮০ রানের দারুণ ইনিংস খেলে স্কোর লাইন বড় করতে রেখেছেন বড় ভূমিকা।
মাহমুদউল্লাহর সাথে তার ষষ্ঠ উইকেটে ১১১ রানের পার্টনারশিপ বাংলাদেশকে ৫০০ ‘র ঘরে যেতে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। আর এই টেস্টের দুই ইনিংসে বোলিংয়ে গিয়েই ব্রেক থ্রু। যা ক্যারিবীয়দের ব্যাকফুটে যেতে রেখেছে বড় ভূমিকা। তারই পুরস্কার আসলে সিরিজ সেরা পারফরমার।
ইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে, এর আগে বাংলাদেশ যে দুইবার প্রতিপক্ষকে হোয়াইটওয়াশ করেছে ঐ দুবারই সিরিজ সেরা পুরস্কার উঠেছে সাকিবের হাতে। আসুন খুব সংক্ষেপে ঐ দুই সিরিজে সাকিবের পারফরমেন্সটা একটু দেখে নেই।
২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে দুই টেস্টের সিরিজে কিংস্টাউনে হওয়া প্রথম টেস্টে (৯-১৩ জুলাই ২০০৯) বাংলাদেশ জিতেছিল ৯৫ রানে। ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন তামিম ইকবাল। আর দ্বিতীয় টেস্ট জিতিয়ে ম্যাচ সেরা এবং সিরিজ সেরার পুরস্কার জিতেছিলেন সাকিব।
প্রথম টেস্টে দুই ইনিংস মিলে সাকিবের রান ছিল (১৭ +৩০) = ৪৭। আর উইকেট ছিল ৫ টি, ১১৫ রানে (৩৫-১০- ৭৬-২, ২৮.১-১১- ৩৯-৩)। আর সেন্ট জর্জে বল ও ব্যাট হাতে সব্যসাচি সাকিবের চৌকশ নৈপুণ্যে ৪ উইকেটের অবিস্মরণীয় জয় পায় বাংলাদেশ। অলরাউন্ডার সাকিব বল ও ব্যাট হাতে জ্বলে উঠে ১২৯ রানে ৮ উইকেট (৩/৫৯ এবং ৫/৭০) শিকারের পাশাপাশি ব্যাট হাতে ১৬ ও ৯৭ বলে ৯৬ রানে নট আউট থেকে হন ম্যাচ সেরা । তার ৯৬ রানের সংগ্রামী ও প্রত্যয়ী ইনিংসে ২১৫ রানের টার্গেট ছুঁয়ে ফেলে টাইগাররা।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সেটাই ছিল দেশে আর বাইরে মিলে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে প্রথমবার ২-০ ‘তে টেস্ট সিরিজ বিজয়। আর সে কৃতিত্বটা নিশ্চিত হয় সাকিবের ম্যাচ জেতানো ব্যাটিংয়ে। সিরিজ সেরা পারফরমারও তাই সাকিবকেই দেয়া হয়।
এরপর ২০১৪ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঢাকা, খুলনা ও চট্টগ্রামে তিন টেস্ট জয়ের নায়ক ও ম্যাচ সেরা তিনজন-তাইজুল (শেরে বাংলায়), সাকিব (খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামে) আর মুমিনুল (চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে)।
প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে সাকিব ৫৯ রানে ৬ উইকেট শিকারি। খুলনায় দ্বিতীয় টেস্টকে নিজের করে রাখেন তিনি। সাকিবময় সে ম্যাচে ব্যাট হাতে অনবদ্য শতরানের পাশাপাশি বল হাতে ১০ উইকেট শিকারের দুর্লভ ও অনন্য কৃতিত্ব দেখিয়ে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে ফেলেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার।
বাঁহাতি ওপেনার তামিম ইকবালের (১০৯) সাথে সাকিবের ১৩৭ রানের ইনিংস বাংলাদেশকে দেখায় ম্যাচ জয়ের পথ। তারপর সাকিব দুই ইনিংসে (৫/৮০ আর ৫/৪৪) সমান ৫ উইকেটের পতন ঘটিয়ে দলকে পৌছে দেন জয়ের বন্দরে। মূলতঃ বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের ক্যারিয়ার সেরা অলরাউন্ডিং পারফরমেন্সেই বাংলাদেশ পায় ১৬২ রানের বড় জয়।
এবার সাকিবের সামনে তৃতীয় বার ধবলধোলাইয়ের মিশনে সিরিজ সেরার সুবর্ণ সুযোগ ছিল। শতভাগ সুস্থ না থেকে আর পুরোপুরি প্রস্তুত না হয়ে মাঠে নেমেও সাকিব তা কাজে লাগিয়ে ফেললেন। তাই তো সাকিব সবার সেরা। বিশ্বসেরা।
এআরবি/এমএমআর/জেআইএম