ম্যাচ জিতে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান ততক্ষণে শেষ। ট্রফি নিয়ে সিরিজ জয়ের আনন্দ উদযাপনও শেষ দলের খেলোয়াড়দের। ফটোগ্রাফারদের অনুরোধেই ট্রফি নিয়ে অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ছবি তুললেন গোটা কয়েক। ছবি তোলা পর্ব শেষ করে দলের মিডিয়া ম্যানেজার রাবিদ ইমামের সাথে সাকিব হাঁটা ধরলেন সংবাদ সম্মেলন কক্ষের দিকে।
Advertisement
এ দুজনের সাথে সঙ্গী হওয়ার কথা মেহেদি হাসান মিরাজেরও। কিন্তু তিনি আটকা পড়েন ফটোগ্রাফারদের অনুরোধের ভীড়ে। ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়কে পেয়ে একের পর এক চলতে থাকে ফটোগ্রাফারদের ক্যামেরার শাটার। কিছু শুভাকাঙ্খীও চলে আসেন প্রিয় তারকার সাথে ছবি তোলার জন্য।
ওদিকে সংবাদ সম্মেলন কক্ষের দিকে যেতে থাকা সাকিব কিছু দূর পিছে ফিরে তাকালেন মিরাজের জন্য। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অধৈর্য্য হয়ে আদরমাখা সুরে মিরাজকে ডাক দেন, ‘পিচ্চি, আয় না।’ সাকিবের গলার স্বর ওত দূর না পৌঁছলেও চেহারার অভিব্যক্তি দেখে মিরাজ বুঝতে পারছিলেন, যেতে হবে এবার।
ফটোগ্রাফার ও শুভাকাঙ্খীদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে হাঁটা ধরেন সাকিবের দিকে। তখনো হাসি লেগে ছিল মুখে। আসার পথে গ্যালারিতে থাকা পরিবারসদস্য, বন্ধু-বান্ধবদের দিকে হাত নাড়িয়ে বললেন, তারা যেন চলে না যায়। কাছে আসতেই সাকিব হালকা বকুনি দিলেও সেটা হাসিমুখেই গ্রহণ করেন মিরাজ। সংবাদ সম্মেলন কক্ষে প্রবেশ কিংবা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেয়ার সময় হাসিটা সরেনি এক মুহূর্তের জন্য।
Advertisement
এ থেকে অনুমান করা যেতেই পারে যে, মিরাজের ক্যারিয়ার সেরা ম্যাচই হয়তো ছিল এটি। অবশ্য পারিপার্শ্বিকতা বাদ দিয়ে স্রেফ উইকেটসংখ্যার বিবেচনায় এ ম্যাচে মিরাজের বোলিং ফিগার স্রেফ তার নিজের নয়, বাংলাদেশেরই ইতিহাসের সেরা। মাত্র ১১৭ রান খরচায় যে নিয়েছেন ১২টি উইকেট।
ম্যাচে ১২ উইকেট নেয়ার কৃতিত্ব এর আগেও দেখিয়েছেন ২১ বছর বয়সী মিরাজ। নিজের অভিষেক সিরিজেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঢাকা টেস্টে ১৫৯ রানে নিয়েছিলেন ১২টি উইকেট। আজকের (রোববার) আগে এটিই ছিলো দেশের ইতিহাসে এক ম্যাচে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড। সে ম্যাচে প্রথমবারের মতো টেস্ট ক্রিকেটে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন মিরাজ।
দ্বিতীয়বারের মত ম্যাচ সেরা হলেন দ্বিতীয়বার ম্যাচে ১২ উইকেট নিয়েই। তাহলে দুইটার মধ্যে কোনটাকে ব্যক্তিগতভাবে এগিয়ে রাখছেন এ যুবা? নিজের রেকর্ড নিজে ভেঙে ক্যারিবীয়দের হোয়াইটওয়াশ করার ম্যাচটি নাকি অভিষেক সিরিজেই ইংলিশ দম্ভ চূর্ণ করে পাওয়া জয়ের ম্যাচটি?
মিরাজ এগিয়ে রাখছেন তার অভিষেক সিরিজের ম্যাচটিকেই। এ ব্যাপারে তার ব্যাখ্যাও পরিষ্কার। জানা যাক তার উক্তিতেই, ‘দুইটা ম্যাচেই কিন্তু ভালো হয়েছে। কিন্তু প্রথমটা (ইংল্যান্ডের বিপক্ষে) আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট ছিল। এ কারণে অবশ্যই ওইটা এগিয়ে থাকবে। কারণ অভিজ্ঞতার দিক থেকে এখন অনেক পরিপক্ক হয়েছি। অনেক ম্যাচ খেলেছি দুই বছরে, ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেও অনেক জেনেছি, কোন উইকেটে বা কিভাবে কি করলে হবে। কাজেই ওইটাকে এগিয়ে রাখব আমি। যদিও এটাও কম না।’
Advertisement
উদযাপনের ব্যাপারে বরাবরই প্রাণখোলা মিরাজ। তবে কখনো কোনো উদযাপনের বিশেষ কোনো অর্থ বা অন্যরকম কোনো কারণ থাকে না বলেই জানান মিরাজ। তার আনন্দ মূলতঃ দেশের হয়ে ম্যাচ জেতানোতেই। এ কারণেই তৃপ্তি ও সন্তুষ্টিতেই থেকেই উদযাপনের বাঁধ মানে না মিরাজের।
তিনি বলেন, ‘(উদযাপনের কারণ) ওইরকম কিছু না। ভালো লাগছিল, আমি উইকেট পাচ্ছিলাম। যে কারণে দলের সাহায্য হচ্ছিলো, একটা করে পার্ট শেষ হচ্ছিল। দিন শেষে দেখেন আমরা ম্যাচটা কিন্তু দেশের হয়ে খেলছি, দেশের হয়ে ম্যাচ জিতছি- এটাই অনেক ভালো লাগার। অবশ্যই পরিবারের কাছেও ভালো লাগে যদি আমরা দেশের হয়ে ম্যাচ জিতি। স্পেশালভাবে ঐরকম (উদযাপন) কিছু ছিল না।’
চার স্পিনারের ভীড়ে চট্টগ্রামে মিরাজের ভাগে পড়েছিল কেবল তিনটি মাত্র উইকেট। যদিও তিনটিই ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া। তবু সংখ্যা মাত্র তিন! সেই শোধ মেটাতেই হয়তো ঢাকায় নিলেন ১২টি উইকেট। কিন্তু এই ১২ উইকেট নিতে বিশেষ কিছু করতে হয়নি বলেই অভিমত মিরাজের।
মিরাজ জানালেন, ভালো জায়গায় ধারাবাহিক বোলিং করার কারণেই মিলেছে সাফল্য। তিনি বলেন, ‘আমি আসলে ভালো জায়গায় ধারাবাহিকভাবে বল করেছি। এজন্য উইকেট পেয়েছি। যদি ভালো জায়গায় বল না করতাম তাহলে উইকেট পেতাম না, রানও হয়ে যেত।’
মিরাজের প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে শুরু হয় অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের পর্ব। সেখানে অধিনায়ককে জিজ্ঞেস করা হয় এ বছর স্পিনারদের এমন সাফল্য, ম্যাচে চার স্পিনার খেলিয়ে পাওয়া সিরিজ জয়ে তার অনুভূতি কি? উত্তরে তিনি মিরাজ, তাইজুল, নাঈমদের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
তখন পাশে থাকা মিরাজ মনে করিয়ে দেন, তার সতীর্থ বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল ইসলাম এ বছর ৪০টির বেশি (৪৩) উইকেট পেয়েছেন। কিন্তু মিরাজ যেন বেমালুম ভুলে গেলেন, তিনিও এ বছর দখল করেছেন ৪১টি উইকেট। যা কি-না তাইজুলের পর নির্দিষ্ট বছরে বাংলাদেশের সেরা।
সংবাদ সম্মেলন শেষে মিরাজকে মনে করিয়ে দেয়া হয়, তার ৪১ উইকেট নেয়ার কথা। ড্রেসিংরুমে ফেরার পথে বলা হয়, ‘মিরাজ, আপনিও তো এ বছর ৪১ উইকেট নিয়েছেন।’ কথাটা ঠিক হজম হয় না তার। সবিস্ময়ে বলেন, ‘কি বলেন! তাই নাকি?’ তাকে জানানো হয়, ‘হ্যাঁ! এবছর তাইজুলের উইকেট ৪৩টি, আপনার ৪১টি।’ মিরাজের সরল হাসিমাখা উত্তর, ‘আরেহ ভালো তো!’
এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরুর আগেই ২০১৬ সালের অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে নিজের ক্যারিয়ারের লক্ষ্য সম্পর্কে জানাতে গিয়ে মিরাজ বলেছিলেন, ‘অন্তত ১৫ বছর বাংলাদেশকে সার্ভিস দিতে চাই।’ অর্থাৎ দলের সেবা করাই তার মূল লক্ষ্য। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে থাকাকালীনই এমন লক্ষ্য স্থির করেন যিনি, তার কাছে নিজের সাফল্য বা পরিসংখ্যানের হিসেব না পাওয়াটাই স্বাভাবিক নয় কি?
এসএএস/এমএমআর/পিআর