সৌদি প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের জন্য জি-২০ সম্মেলন সবসময়ই একটি পরীক্ষা। সৌদির ভিন্ন মতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ডের পর আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠিত এবারের এই সম্মেলনেই প্রথম কোন আন্তর্জাতিক মঞ্চে হাজির হলেন মোহাম্মদ বিন সালমান।
Advertisement
খাসোগজি হত্যার আদেশ সৌদি সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে দেয়া হয়েছিল বলে ব্যাপক সন্দেহ ও অভিযোগ রয়েছে।ফলে আন্তর্জাতিক মহল সৌদির সঙ্গে কেমন আচরণ করেছে তা দেখার জন্য বুয়েন্স আয়ার্সের এই সম্মেলন ছিল একটা দারুণ সুযোগ।
এর প্রথম ইঙ্গিত পাওয়া যায় প্রথা মাফিক শীর্ষ নেতাদের যেসব ছবি তোলা হয় তার মধ্যেই। সৌজন্য বিনিময়, হাত মেলানো, নেতাদের শরীরী ভাষা যা বলে দিয়েছে, তা হয়ত একাধিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ সম্ভব হতো না।
শীর্ষ নেতাদের গ্রুপ ছবি তোলার সময় সৌদি আরবের ডি ফ্যাক্টো শাসক মোহাম্মদ বিন সালমান, যাকে এমবিএস নামে ডাকা হয়, নিজে থেকেই একেবারে সারির শেষ প্রান্তে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
Advertisement
জি-২০ সম্মেলনে আসা নেতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন একমাত্র আরব নেতা, আর স্যুট-টাই পরিহিত একদল প্রভাবশালী মানুষের ভিড়ে নিজের পোশাকের কারণে তিনি দূরেই ছিলেন। কখনো কখনো তাকে কিছুটা অনিশ্চিত, এমনকি নার্ভাসও মনে হয়েছে। বিশ্ব নেতাদের কেউ কেউ তার সঙ্গে সৌজন্যসূচক দুয়েকটি কথা বলেছেন, আবার অনেকেই হাত মেলাতেও ভুলে গেছেন।
এর ব্যতিক্রম ছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। অনেকটা আয়োজন করেই হাই-ফাইভ দিয়েছেন তিনি।আর এটা কেবল ক্যামেরায় পোজ দেয়ার জন্য ছিল না। বসেছিলেনও দু'জন পাশাপাশি। তবে এর অনেকটাই নিজ স্বার্থে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। কারণ সৌদি আরবের সঙ্গে কৌশলগত কারণেই রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা রাখা দরকার।
সেই সঙ্গে, বিরোধী মত দমনের ক্ষেত্রে পুতিনের বিরুদ্ধে পশ্চিমা নেতাদের একই রকমের অভিযোগ রয়েছে। ফলে এই সম্মেলনের সূত্র ধরে বিশ্ব নেতাদের মনোভাব বোঝা আর কূটনৈতিকভাবে সেটাকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসার প্রথম সুযোগে এমবিএসকে কিছুটা ম্লান মনে হয়েছে। তার সঙ্গে অন্য নেতার বৈঠকের ব্যপারটাও ছিল একই রকম দ্বন্দ্বপূর্ণ।
একদিকে, তাকে কেউ উপেক্ষা করেননি। অনেক নেতা বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো এবং দক্ষিণ আফ্রিকার নেতৃবৃন্দ এগিয়ে এসে তার সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, কথা বলেছেন। সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বেশ তাড়াহুড়া করে সেসব ছবি টুইটারে পোষ্ট করেছেন।
Advertisement
তবে, সবার কাছ থেকে সবুজ সংকেত পাননি এমবিএস। খাশোগি হত্যাকাণ্ডের পর এমবিএসের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে সরাসরি ওই প্রসঙ্গেই কথা বলেছেন। মে'র এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, তুর্কি তদন্ত দলের সঙ্গে সৌদি আরব যেন পূর্ণ সহযোগিতা করে প্রধানমন্ত্রী যুবরাজকে সেই আহ্বান জানিয়েছেন। মে বলেছেন, জবাবিদহিতা নিশ্চিত করার জন্য স্বচ্ছ তদন্ত করতে হবে এবং কে দায়ী সেটা খুঁজে বের করতে হবে।
এছাড়া ইয়েমেনের সঙ্গে সংকট সমাধানে রাজনৈতিক সংলাপ শুরুর তাগিদ দিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী।সম্মেলনের ফাঁকে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এমবিএসের সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি সেসময় জামাল খাশোগির হত্যাকারীদের খুঁজে বের করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানান।
যদিও ভিডিও ফুটেজ দেখে মনে হয়েছে, ম্যাক্রোঁর কথা শুনছিলেন না এমবিএস। তবে, এই সম্মেলনের মাধ্যমে যে সত্যটা বেরিয়ে এসেছে তা হলো জামাল খাশোগি হত্যার সঙ্গে যুবরাজের সংশ্লিষ্টতা থাকার যে অভিযোগ- তাতে বিশ্বনেতাদের অনেকে ক্রুদ্ধ হলেও সেই ক্ষোভ কেউ প্রকাশ করেননি।
কারণ বেশির ভাগ নেতাই জানেন নিজ নিজ দেশের জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা করে অনেককেই সৌদি আরবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতে হয়। বাণিজ্য এবং গোয়েন্দা সম্পর্ক রয়েছে যেসব দেশের সঙ্গে, তাদের সে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হবে এবং সেজন্য কথা বলার সম্পর্ক যাতে নষ্ট না হয় সেটা ভাবতে হয়েছে অনেককে।
ফলে কৌশলগত দূরত্ব বা কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার কোন কঠোর বার্তা এমবিএসকে এই সম্মেলন থেকে দেয়া হয়নি।তবে এটাও পরিষ্কার বোঝা গেছে যে, এমবিএসের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে সময় লাগবে, আর তা নির্ভর করবে তুরস্কের তদন্ত দলকে তিনি কীভাবে সহযোগিতা করেন তার ওপর।
গত ২ অক্টোবর ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশের পর নিখোঁজ হন জামাল খাশোগি। এই ঘটনা সৌদি আরবকে পুরো বিশ্বের সামনে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
টিটিএন/জেআইএম