পাহাড়িদের অধিকার আদায়ে ১৯৭২ সালের ১৬ মে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার নেতৃত্বে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। তার পরের বছর ১৯৭৩ সালে গঠিত হয় জেএসএসের সামরিক শাখা কথিত শান্তি বাহিনী। আর তখনই অশান্তির দাবানল জ্বলে ওঠে সবুজ পাহাড়ে। মানুষের বাড়িতে আগুন দেয়া থেকে শুরু করে গণহত্যাও চালায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) গেরিলা সংগঠন ‘শান্তি বাহিনী’।
Advertisement
দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় ধরে চলা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রথম মেয়াদে সরকার এবং জ্যোতিরিন্দ্র বোধি প্রিয় লারমার (সন্তু লারমা) নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে অবসান হয় সশস্ত্র গেরিলা আন্দোলন।
চুক্তিতে সরকারের পক্ষে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পক্ষে স্বাক্ষর করেন সাবেক গেরিলা নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা প্রকাশ সন্তু লারমা। এই চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে তিন পার্বত্য জেলায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দীর্ঘ অধ্যায়ের অবসান ঘটে।
কিন্তু ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির পর ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন চাই’ স্লোগানে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর রাজধানীতে সম্মেলনের মাধ্যমে প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে জন্ম নেয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)।
Advertisement
এদিকে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা প্রকাশ সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’ থেকে বেরিয়ে রূপায়ণ দেওয়ান সুধাসিন্ধু খীসাদের নেতৃত্বে ২০০৭ সালে জন্ম নেয় ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা)’। যা জেএসএস (সংস্কার) নামে অধিক পরিচিত।
দীর্ঘদিন ধরে ইউপিডিএফ ও জেএসএস (এমএন লারমা) সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে গেলেও ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠার ১৯ বছরের মাথায় তপন জ্যোতি চাকমার (বর্মা) নেতৃত্বে ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর খাগড়াছড়ি জেলা সদরের একটি কমিউনিটি সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের’। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন সময় ইউপিডিএফের শীর্ষ নেতাদের দলচ্যুতির ঘটনা ঘটলেও এদিন ইউপিডিএফ ভেঙে দুই ধারায় বিভক্ত হয়।
কিন্তু এখনও বিবদমান এ চার সংগঠনের ক্ষমতা ও আধিপত্যের দ্বন্দ্বে অশান্ত পাহাড়। ভাঙা-গড়ার খেলায় পাহাড়ে থামেনি খুন, গুম আর অপহরণ। সমানতালে চলছে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর চাঁদাবাজিও।
পার্বত্য শান্তি চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারার পূর্ণ বাস্তবায়নের পাশাপাশি ১৫টি ধারা আংশিক এবং ৯টি ধারা বাস্তবায়নাধীন থাকলেও পাহাড়ের ‘শান্তি’ অধরাই রয়ে গেছে। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে সবুজ পাহাড় রক্তাক্ত হয়েছে।
Advertisement
বিতর্ক কাটেনি, বেড়েছে অবিশ্বাস
বিগত ২১ বছরে অমিমাংসিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পাহাড়ে বেড়েছে অবিশ্বাস, টানাপোড়েন আর শঙ্কা। ফলে শান্তি চুক্তির পুরোপুরি সুফল আসেনি বলে মনে করছেন পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিজেএসএস) নেতা-কর্মীরা।
অপরদিকে সরকারের ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে এই একুশ বছরে পাল্টে গেছে পাহাড়ের চিত্র। আর তার সুফল ভোগ করছেন স্থানীয়রা। এমনটাই মনে করছেন সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা। তবে বাঙালি সংগঠনগুলো বলছে, শান্তিচুক্তির কারণে শুধু পাহাড়ে একটা জাতিগোষ্ঠীর ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। বাঙালিসহ অন্য জাতিসত্তাগুলোর তেমন কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না। পাহাড়ে সমতার ভিত্তিতে উন্নয়ন করা গেলে শান্তি চুক্তির সুফল আসবে। জেএসএস নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, পর্যটন, মাধ্যমিক শিক্ষা, উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয় এখনও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ হস্তান্তর করেনি।
এছাড়াও অস্ত্র জমা দেয়া জনসংহতি সমিতির সদস্যদের পুনর্বাসন, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী এবং যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে যারা আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হয়েছে তাদেরও পুনর্বাসন করা হয়নি বলে দাবি জনসংহতি সমিতির।
এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য প্রযোজ্য আইনসমূহ সংশোধন হয়নি, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি বলে মনে করছেন জনসংহতি সমিতির উচ্চপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা ।
এ ব্যাপারে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বান্দরবান জেলা শাখার সভাপতি উছোমং মার্মা জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি আর বাঙালিদের প্রত্যাশা ছিল পার্বত্য চুক্তির যথাযথ আর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন। কিন্তু বাস্তবে ৭২টি ধারার মধ্যে ২৭টি ধারা পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে। ৪৮টি ধারা পূর্ণাঙ্গ ও আংশিকভাবে বাস্তরবায়ন হয়েছে। আর বাকি ২৪টি ধারা যেগুলো মূল বিষয় সেগুলো সরকার বাস্তবায়ন করার জন্য এগিয়ে আসেনি।
চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে তিনি আরো বলেন, যে সরকারই আসুক পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন চাই। পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হলে পাহাড়ি আর বাঙালিদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়বে।
বান্দরবান জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী অ্যাডভোকেট উবাথোয়াই মারমা বলেন, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তির মাধ্যমে সারা দেশের মানুষ মনে করেছিল পার্বত্য এলাকায় শান্তি বিরাজ করবে। তাই দেশের মানুষ এই চুক্তিকে শান্তি চুক্তি বলে অবহিত করেছিল। কিন্তু ২১ বছর পেরিয়ে গেলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনও শান্তি আসেনি।
ভূমি কমিশনের কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি জানান, পাহাড়ের মূল যে ভূমি সমস্যা সেটি এখনও নিরসন হচ্ছে না। ভূমি কমিশন গঠিত হয়েছে, আইন সংশোধিত হয়েছে কিন্তু বিধিমালা এখনও পাইনি। আমরা আশা করছি এই সমস্যা অচিরেই সমাধান হবে।
জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লক্ষীপদ দাশ বলেন, শান্তিচুক্তি বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় সাফল্য। ইতোমধ্যে অধিকাংশ চুক্তিই বাস্তবায়িত হয়েছে। আশা করছি, সরকার ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে আগামীবার শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হবে। বান্দরবান পার্বত্য নাগরিক পরিষদের সভাপতি আতিকুর রহমান বলেন, পাহাড়ে অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। সেইসঙ্গে যে ধারাগুলোতে বাঙালিদের বৈষম্যে ফেলা হয়েছে সেগুলো বাতিল করতে হবে। এছাড়া কোটা প্রথার মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া জাতিকে এগিয়ে আনার কথা বলা হলেও শুধুমাত্র চাকমা সম্প্রদায়কে এগিয়ে আনা হচ্ছে। এতে অন্য জাতি বিশেষ করে চাক, ম্রো, খ্যাং, বাঙালিরা পিছিয়ে আছে।
মুজিবুর/সৈকত/এফএ/এমএস