ভোট-জোট-জট। সংসদ নির্বাচনের আগে শব্দ তিনটা খুব বেশি শোনা যাচ্ছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ার আগে এটাই বাস্তবতা। নির্বাচন নিয়ে সংশয় ছিল। কিন্তু সেটা দূর হয় সংলাপের মধ্যে দিয়ে। প্রধানমন্ত্রীর সাথে বিরোধী দলগুলোর একাধিকবারের সংলাপে জনমনে স্বস্তি ফেরে নির্বাচন ঘিরে।
Advertisement
তারপর শুরু হয় নির্বাচনী তোড়জোড়। আর এই তোড়জোড়ের মধ্যে ঝড়ো হাওয়ার মত শুরু হয় নির্বাচনের আগে দলবদল। এক সময় ঢাকার ফুটবল, ক্রিকেট লীগের দলবদল নিয়ে যে রকম উৎসাহ- উদ্দীপনা-উত্তেজনা-উন্মাদনা শুরু হত তার রাজনৈতিক সংস্কার দেখা গেলো এবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে!
রাজনীতিবিদদের এই দল-বদল নির্বাচনের আগে একেবারে নতুন কিছু নয়। তবে এবার সেই দলবদলে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। তার বড় একটা কারণ, নির্বাচন ঘিরে বড় দুটো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে জোট, ফ্রন্ট গঠন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট ছিল আগেই। তাঁর কলেবর বৃদ্ধি করতে গিয়ে গঠন করা হয়েছে মহাজোট। জাতীয় পার্টির পাশাপাশি আর একটা যুক্তফ্রন্ট যোগ দিয়েছে মহাজোটে। সংগে থাকছে কিছু ইসলামী জোট।
Advertisement
অন্যদিকে, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হওয়ার পর সেখানে আবার শুরু হয় যোগ-বিয়োগের নতুন সমীকরণ। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকাকালীনই সেখানে শুরু হয় টানা পোড়েন। সেখান থেকে বেরিয়ে আসে সাবেক রাষ্ট্রপতি, এক সময় বিএনপির প্রভাবশালী নেতা, যার নামে বিএনপির নিবন্ধন সেই অধ্যাপক বি চৌধুরীর বিকল্পধারা। ঐক্য ফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে বিকল্প পথ খুঁজে নেয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে।
তার আগে তারা আবার দলে ভিড়িয়েছেন বেশ কয়েকজন সাবেক বিএনপি পন্থী ওজনদার প্রার্থীকে। লক্ষ্য একটাই যাতে মহাজোটের কাছ থেকে কিছু বেশি আসন নিয়ে দরকষাকষি করা যায়। এক সময় বেগম জিয়ার অন্যতম বিশ্বস্ত এবং বৈদেশিক বিষয়গুলো যিনি দেখাশোনা করতেন সেই শমসের মোবিন চৌধুরী, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি থেকে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন গোলাম সারোয়ার মিলন এক এগার পরবর্তী সময়ে যিনি আবার রাজনীতির ময়দানে সরব হয়েছিলেন ফেরদৌস কোরেশীর নেতৃত্বে। তিনিও যোগ দিয়েছেন বিকল্প ধারায়! আবার স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচন করে মৌলভী বাজার থেকে সাংসদ হয়ে যিনি বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন সেই সাবেক এমপি শাহীন এবার বিএনপি ছেড়ে বিকল্প ধারায়! এদের লক্ষ্য এবার নৌকায় চড়ে নির্বাচন করা।
আবার উল্টো চেহারা ঐক্যফ্রন্টেও। সারাজীবন আওয়ামী লীগ করেছেন। মন্ত্রী হয়েছেন সেই অধ্যাপক আবু সাঈদ যোগ দিয়েছেন গণফোরামে। আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থমন্ত্রী ড. এ এস এম কিবরিয়ার ছেলে ড. রেজা কিবরিয়াও যোগ দিয়েছেন গণ ফোরামে। তাঁরা আওয়ামী লীগে উপেক্ষিত, মনোয়ন বঞ্চিত হওয়ার পর তারা গণফোরামে যোগ দিয়েছেন। তারাও প্রার্থী হবেন ঐক্য ফ্রন্টের! নির্বাচনে তারা হয়তো ধানের শীষ নিয়েই প্রার্থী হবেন! রসিকজনরা রাজনীতিবিদদের এই দল বদলকে জার্সি বদল হিসেবে দেখছেন!
ফুটবলার-ক্রিকেটাররা জার্সি বদল করেন টাকা-পয়সার কারণে। কখনো ক্লাবে তাদের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেলে তারা অন্য ক্লাব খুঁজে নেন। কিংবা ক্লাবই তাঁদের অন্যক্লাবে বিক্রি করে দেন। কিন্তু রাজনীতিতে জার্সি বদল! এটা কী শুধুই ক্ষমতার জন্য! নীতি-আদর্শহীন রাজনীতি সমাজ-রাষ্ট্রে জেঁকে বসলে এটাই হয়। আমাদের রাজনীতিতে এখন শেষ কথা ক্ষমতা। এখানে নীতি-আদর্শ-মূল্যবোধ এসব শুধুই মূল্যহীন মুখের কথায় পরিণত হয়েছে। তার নমুনা দেখা যাচ্ছে নির্বাচনী জোট গঠনের সময়।
Advertisement
নির্বাচনী জোট গঠনের কারণে প্রার্থী জটও দেখা দিয়েছে। এক আসনে জোটের একাধিক প্রার্থী। বিশেষ করে বিএনপির প্রার্থী অন্যদের ছাড়িয়ে গেছে সংখ্যায়। চূড়ান্ত হবে হয়তো প্রতীক বরাদ্দের সময়। কিন্তু তার আগে তারা বলছেন এটা কৌশলগত কারণে।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও একাধিক আসনে একাধিক প্রার্থী। তাদের ভাষায়, এটা স্ট্র্যাটেজির কারণে। প্রতিপক্ষের প্রার্থী দেখে নিজেদের জোটের প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে! যুক্তিটা রাজনৈতিক ব্যাখ্যায় খুব বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। দেশের সবচেয়ে বড় এবং প্রাচীন দল তাঁদের প্রার্থী চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ার কথা অনেক আগে। তাছাড়া তারা ক্ষমতায়। তাদের মহাজোটে প্রার্থী জট হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সেখানেও জট!
জোট-মহাজোট-ফ্রন্ট-ঐক্যফ্রন্ট গঠনে আদর্শ-নীতি যখন খুব একটা গুরুত্ব পায় না , তখন প্রার্থীতা গুরুত্ব পাবে কীসের ভিত্তিতে! উত্তর একটাই যিনি জয়ী হতে পারবেন। আর বাংলাদেশর রাজনীতিতে জয়ী হওয়ার রসায়ন এখন জোট-মহাজোট , ফ্রন্ট, ঐক্যফ্রন্ট গঠন। এবং অর্থ আর পেশি শক্তি থাকলে নির্বাচনে জয়লাভ করা সহজ হয়ে যায় এই দেশে। যে কারণে আমাদের গণতন্ত্র স্বাধীনতার এত বছর পরো খুব শক্ত কোন ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারলো না।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে মীমাংসিত হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ নামের দেশটা পরিচালিত হবে গণতান্ত্রিকভাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমরা বার বার সামরিক শাসকের শাসন দ্বারা শাসিত হয়েছি। সেখানে গণতন্ত্রের বিকাশ শুধু একটা নির্বাচনে হবে তা আশা করা ঠিক নয়। তাই আমাদের রাজনীতিবিদদের কাছেও আদর্শ, নীতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা , গণতন্ত্র এসব শব্দ শুধুই মুখের বুলি ছাড়া অন্য কিছু নয়!
লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।
এইচআর/এমএস