ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার স্মরণে পরিবারের পক্ষ থেকে মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুক্রবার (৩০ নভেম্বর) বাদ আসর গুলশান কেন্দ্রীয় মসজিদে (আজাদ মসজিদ) এ দোয়া মাহফিল হয়।
Advertisement
দোয়ার আগে মেয়র আনিসুল হকের ছেলে নাভিদুল হক উপস্থিত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমার বাবা সবার কাছে প্রিয় মানুষ ছিলেন।কাজ করতেন মানুষের জন্য, তাই পদে পদে মানুষ উনার জন্য দোয়া করেন। মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি সবসময়, আসলেই তিনি সৌভাগ্যবান। আমার বাবার সঙ্গে আমার শেষবারের যখন কথা হয়েছিল আমি উনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বাবা তোমার কি কোনো দুঃখ আছে- উত্তরে তিনি বলেছিলেন ‘না আমার কোনো দুঃখ নেই’। এটাই ছিল উনার সঙ্গে আমার শেষ কথা। আপনারা সবাই আমার বাবার জন্য দোয়া করবেন।
দোয়া মাহফিলে পরিবারের সদস্য ছাড়া আরও উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম, হা-মিম গ্রুপের মালিক, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এ কে আজাদসহ বিশিষ্টজনরা।
এদিকে গত ২৮ নভেম্বর প্রয়াত আনিসুল হকের গড়া প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদি গ্রুপে আসর নামাজের পর মিলাদ এবং দোয়া হয়। অার ২৯ নভেম্বর যোহর নামাজের পরে তার চেম্বারে কোরআনখানি অনুষ্ঠিত হয়।
Advertisement
২০১৭ সালের ২৯ জুলাই ব্যক্তিগত সফরে সপরিবারে লন্ডন যান আনিসুল হক। সেখানে তিনি সেরিব্রাল ভাসকুলাইটিসে (মস্তিষ্কের রক্তনালীর প্রদাহ) রোগে আক্রান্ত হন। অসুস্থ হয়ে পড়লে ওই বছরের ১৩ আগস্ট তাকে সেখানকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সে বছরই ৩০ নভেম্বর বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ২৩ মিনিটে লন্ডনের ওয়েলিংটন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন আনিসুল হক।
রাজনীতিতে কোনো দলে নাম না লেখানো আনিসুল হক ২০১৫ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঢাকা উত্তর সিটি কপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। রাজধানীকে পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ ও ‘স্মার্ট’ নগরী হিসাবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক বেশকিছু উদ্যোগ নিয়ে আলোচিত ও প্রশংসিত হন তিনি।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনালের সামনের সড়ক দখলমুক্ত করতে গিয়ে বিক্ষুব্ধ চালকদের ক্ষোভের মুখে পড়েন তিনি। পরে ওই সড়ক দখলমুক্ত করেন তিনি। রাতারাতি তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছান।
নগরবাসীর কাছে ঢাকার আকাশ-দেয়াল একরকম অবরুদ্ধ হয়েই ছিল। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার এক বছরের মধ্যেই তিনি ঢাকা শহর থেকে সব বিলবোর্ড উচ্ছেদ করে আকাশকে খুলে দেন, যা এক সময় কেউ চিন্তাও করতে পারেনি।
Advertisement
শ্যামলী থেকে গাবতলী পর্যন্ত রাস্তা বিভিন্ন পরিবহনের যানবাহনের দখলে ছিল। ফলে দীর্ঘসময় যানজটে মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হত। প্রতিশ্রুতি মোতাবেক, ঘোষণা দিয়েই তিনি শ্যামলী থেকে গাবতলী পর্যন্ত রাস্তাকে গতিময় করে তোলেন।
বিভিন্ন এলাকার পার্কগুলো দখলদারদের কাছ চলে গিয়েছিল। আনিসুল হক একের পর এক সেসব পার্ক দখলদারদের কাছ থেকে উদ্ধার করেন। শহরের পথচারীদের জন্য আধুনিক টয়লেট নির্মাণ করেন। এ জন্য মানুষের আস্থার জায়গা তৈরি হয় আনিসুল হককে ঘিরে।
গুলশান, বনানী, বারিধারা ও নিকেতন এলাকায় বিশেষ রঙের রিকশা এবং ‘ঢাকা চাকা’ নামে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসসেবা চালু করেন আনিসুল হক। বিমানবন্দর সড়কে যানজট কমাতে মহাখালী থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সড়কে ইউলুপ করার উদ্যোগ নেন আনিসুল হক।
এ ছাড়া ঢাকার খালগুলো উদ্ধারে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন আনিসুল হক। তার নির্দেশে বনানীর ২৭ নম্বরে যুদ্ধাপরাধী মোনায়েম খানের বাড়ি ‘বাগ এ মোনায়েম’র অবৈধ দখলে থাকা অংশ উদ্ধার করে সড়ক প্রশস্ত করা হয়েছে।
আনিসুল হকের জন্ম নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জে ১৯৫২ সালে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (সম্মান) ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ১৯৮০ দশকে টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘আনন্দমেলা’ ও ‘অন্তরালে’ নামে দুটি অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করতেন। আনিসুল হক একজন সফল ব্যবসায়ীও।
১৯৮৬ সালে তার নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘মোহাম্মদী গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠা করেন। মোহাম্মদী গ্রুপের চেয়ারম্যান আনিসুলের তৈরি পোশাক ছাড়া বিদ্যুৎ, তথ্যপ্রযুক্তি, আবাসন, কৃষিভিত্তিক শিল্প কারখানা রয়েছে। ডিজি যাদু ব্রডব্যান্ড লিমিটেড এবং নাগরিক টেলিভিশনের মালিকানাও তার ব্যবসায়ী গ্রুপের।
২০০৫ থেকে ২০০৬ সাল এই সময়ে বিজিএমইএ’র সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০০৮ সালে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সার্ক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বিআইপিপিএরও সভাপতি ছিলেন। এএস/জেডএ/পিআর