খেলাধুলা

অভিষেকেই ‘টেস্ট টেম্পামেন্টে’র প্রদর্শনী সাদমানের

উদ্বোধনী জুটি হতাশ করছে বারবার। তাই কার্যকর জুটি পেতে চলছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আজ লিটন, কাল সৌম্য তো পরশু আরেকজনকে দিয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে। এ যেন রোগ ভাল করতে ঔষধ বদলের মত। এক ঔষধে কাজ হচ্ছে না, তাই অন্য মেডিসিন প্রয়োগ। সে চিন্তায় চলতি ঢাকা টেস্টে সাদমানকে খেলানো।

Advertisement

তারপরও কারো কারো মনে প্রশ্নের উদ্রেক ঘটেছিল। কিন্তু কেন সাদমান? ব্যাটসম্যান কোটায় না হোক, স্পেশালিষ্ট কিপার হিসেবে মুশফিকের ব্যাকআপ হিসেবে লিটন দাস তো একাদশে, তাহলে তাকে ওপেনার হিসেবে না খেলিয়ে সৌম্যর সঙ্গী কেন সাদমান? যারা এ প্রশ্ন সামনে রেখে খেলা দেখতে বসেছিলেন, তাদের মুখ বন্ধ।

সাদমান দেখিয়ে দিয়েছেন, যেমনটা খোঁজা হচ্ছে- আমি ঠিক তেমন। তামিম নেই। ইনজুরি মুক্ত হয়ে এ ম্যাচেও ফেরা হয়নি দেশসেরা ওপেনারের। বাকি কারো অবস্থাই বিশেষ ভাল না। দেশের মাটিতে স্লো ট্র্যাকেও ইমরুল, লিটনের ব্যাট কথা বলছে না। তারা ইনিংসের সূচনা করতে নেমে রানও করতে পারছেন না। যে কারণে ওপেনিং জুটি বড় হচ্ছে না। শুরুর পরপরই বালির বাঁধের মত ভেঙ্গে যাচ্ছে।

এখন উদ্বোধনী জুটি স্থিতিশীল করতে দরকার একজন ‘গ্রাফটার’, যে বা যিনি অন্যদের মত চটকদার, আকর্ষণীয় শটস খেলার চেয়ে একদিক আগলে রাখার কাজটি ভাল পারবেন এবং উইকেটে টিকে থাকাই হবে যার ব্রত- এমন এক ওপেনার খুঁজে পেতেই যে সাদমান ইসলাম অনিককে নেয়া।

Advertisement

যারা সাদমানকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, ঘরোয়া ক্রিকেটে সব ফরম্যাটে তার ব্যাটিং দেখেছেন- তারা আশায় বুক বেঁধেছিলেন ড্যাশিং সৌম্যর সাথে সাদমানের রসায়নটা ভাল হতে পারে। কারণ তার সম বয়সী সৌম্য, লিটনদের মত স্ট্রোক প্লে’র চেয়ে সাদমান অনেক বেশী ধীর-স্থির। ব্যাটিং টেকনিক অনেক বেশী পরিপাটি ও সাজানো-গোছানো। বলের পিছনে শরীর ও পা এনে খেলার চেষ্টা বেশী। আর টেস্ট তথা দীর্ঘ পরিসরের ফরম্যাটে যা সবচেয়ে বেশী দরকার, সেই ধৈর্য্যটা আছে।

সেটা কতটা? এরই মধ্যে দর্শক, বাংলাদেশ ভক্ত ও সমর্থকরা তা দেখে ফেলেছেন, জেনেও গেছেন। তবে আরও একটি উক্তি শুনুন, তাহলে জানাটা আরও পরিষ্কার হবে।

‘আরে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্যাপ্টেন আর বোলাররা তো জানে না যে, সাদমানের মাথা কত ঠান্ডা? তাকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা বৃথা। কোন ফাঁদ পেতে লাভ নেই। সে তার মতই খেলবে। মিড অন ওপরে তুলে গুডলেন্থে বা থ্রি কোয়ার্টার লেন্থে যতই বল ফেলে তাকে মিডঅন ফিল্ডারের মাথার ওপর দিয়ে তুলে মারায় প্রলুব্ধ করা হোক না কেন- সে মাটিতে খেলবে। ভুলেও তুলে মারতে যাবে না।’- ওপরের কথাগুলো হাবিবুল বাশারের। আজ সকালের সেশন শেষে লাঞ্চ ব্রেকে টিভি চ্যানেলে বিশেষজ্ঞ মতামত দিতে শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের প্রেস বক্সে এসে সাদমান ইসলাম অনিক সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে ওপরের মন্তব্য জাতীয় দলের নির্বাচক বাশারের।

এই ২৩ বছর তরুণকে খুব বেশী যারা জানেন না, তার খেলা তেমন দেখেননি- তারাও জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক এবং দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সব সময়ের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান বাশারের ঐ একটি মন্তব্য শুনেই সাদমান সম্পর্কে একটা ধারণা পাবেন। অবশ্য সাদমান ঠিক সৌম্য, লিটন দাসের মত নন। একটু ভিন্ন ধাতুতে গড়া।

Advertisement

যার কাছে চটকদার মার, বাহারি স্ট্রোক প্লে, বাউন্ডারি- ছক্কা হাকানোর চেয়ে উইকেটে টিকে থাকা, বলের মেধা ও গুণ বিচার করে অফ স্টাম্পের বাইরের বল ছেড়ে, ভাল বলকে সমীহ দেখিয়ে ডিফেন্স করা আর একদম আলগা বলে শটস খেলাটাই বড় কথা। আজ শেরে বাংলায় ওয়েষ্ট ইন্ডিজের সাথে টেস্ট অভিষেকে ঠিক অমন ব্যাটিংই করেছেন সাদমান।

এমন নয়, ব্যাট হাতে প্রথম দিনই মাঠ মাতিয়েছেন। ঠিক তাকে যে চিন্তায় নেয়া হয়েছিল, তা ষোল আনা পূর্ণ করতে না পারলেও অন্তত বারো আনা মিটিয়ে দিয়েছেন। একদম প্রথম ইনিংসেই দেখিয়ে দিয়েছেন, আমি লম্বা দৌড়ের ঘোড়া। শুরুতে খুব দ্রুত দৌড়ে অল্প দূরে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ার পাত্র না।

সেঞ্চুরি করতে পারেননি, খেলেছেন ৭৬ রানের এক ইনিংস। বাংলাদেশের ওপেনারদের মধ্যে টেস্ট অভিষেকে তার চেয়ে বেশী রান আছে আরও তিন জনের। ওপেনারদের মধ্যে টেস্ট অভিষেকে সবচেয়ে বেশী রান জাভেদ ওমর বেলিমের। পুরোন ঢাকার জাভেদ টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ৮৫। ঐ ইনিংস সাজাতে জাভেদ উইকেটে ছিলেন ২৭৭ মিনিট। বল খেলেছিলেন ১৬৮।

দ্বিতীয় সর্বাধিক রান তামিম ইকবালের। দেশের এক নম্বর ওপেনার প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ৮৪ (১৭৫ মিনিটে ১২৮ বল খেলে)। তৃতীয় সর্বাধিক ৭৮ রানও চট্টগ্রামের আরেক ওপেনার নাজিমউদ্দীনের। ২৬৩ মিনিটে ১৮৭ বল খেলে ঐ রান করেছিলেন নাজিম। তাদের চেয়ে কম রান করেও সাদমান অনেকেরই মন জয় করে নিয়েছেন।

কারণ একটাই- টিম বাংলাদেশের বেশীর ভাগ ওপেনারই মারকুটে। লম্বা সময় উইকেটে থাকা আর দীর্ঘ ইনিংস খেলার চেয়ে যারা শটস খেলতে আর চটকদার মার মারতেই বেশী পছন্দ করেন। তাই একজন ঠান্ডা মাথার ওপেনারের দরকার ছিল। যিনি একদিক আগলে রাখবেন। অন্যদের মত দূর থেকে ব্যাট পেতে দেবেন না। বলের পিছনে যতটা সম্ভব শরীর ও পা নিয়ে খেলবেন।

ঝুঁকিপূর্ণ শট খেলার চেয়ে অপেক্ষায় থাকবেন আলগা বলের। কেবল হাফ ভলি, ওভার পিচ আর খাট লেন্থের বল গুলো থেকেই রান তোলায় তৎপর থাকবেন। আর ভাল বলকে সমীহ দেখিয়ে আর অফষ্টাম্পের আশপাশের বলগুলোকে অযথা তাড়া না করে ছেড়ে দেবেন।

প্রায় পৌনে চার ঘন্টা (২২০ মিনিট) উইকেটে থেকে রানের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি ১৯৯ বল খেলে ৭৬ রান করার পথে বাউন্ডারি মাত্র ছয়টি। ফিফটিও করেছিলেন একই ছন্দ ও লয়ে ব্যাট করে করে ১৫৭ মিনিটে ১৪৭ বলে। পুরো ইনিংসে সাদমান কতটা সতর্ক- সাবধানী ও সংযমী ছিলেন, তা একটা ছোট্ট পরিসংখ্যানেই মিলবে তার প্রমাণ।

৭৬ রানের অর্ধেক ৩৮ রান করেছেন সিঙ্গেলস দিয়ে, ছয় বাউন্ডারিতে ২৪ আর সাত ডাবলস থেকে ১৪। সব মিলে ৭৬। ৫১ টি স্কোরিং শটস। বাকি ১৪৮ বলে রান করেননি। অফস্টাম্পের বাইরে ও আশপাশে কিছু বল ছেড়ে দিয়েছেন। আর ৬০ ভাগ ডেলিভারি ডিফেন্স করেছেন।

সবচেয়ে বড় কথা এক মুহূর্তের জন্যও তাকে আড়ষ্ট মনে হয়নি। জীবনের প্রথম টেস্ট খেলছেন- তা মনেই হয়নি। একদম আত্মবিশ্বাস ও পূর্ণ আস্থা নিয়েই ব্যাট করেছেন। যখন ডিফেন্স করেছেন একদম প্যাড ও ব্যাট একসাথে নিয়ে বলের ঠিক পিছনে এসেছেন। আর অফ ও অন সাইডে ড্রাইভ করার সময় ডান পা বাড়িয়ে যতটা সম্ভব মাটিতে রেখে ড্রাইভ খেলেছেন। তুলে মারার চেষ্টা ছিল খুবই কম।

মোদ্দা কথা, একদম গাণিতিক ও প্রথাগত ব্যাটিং। টেস্টে তামিম ইকবালের সাথে যে এমন কাউকেই দরকার। নিজের অভিষেক ইনিংসের এই টেস্ট টেম্পারমেন্ট যদি আগামীতেও ধরে রাখতে পারেন সাদমান, তবে উদ্বোধনী জুটি নিয়ে বাংলাদেশ দলের চিন্তা দূর হয়ে যাবে বলাই যায়।

এআরবি/এসএএস/পিআর