সড়ক-মহাসড়কগুলো যেন পরিণত হয়েছে মৃত্যুফাঁদে। এতে অসংখ্য জীবন যাচ্ছে। অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করছে চিরতরে। এইসব পরিবারের ওপর নেমে আসছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কালোছায়া। অথচ প্রতিকারহীনভাবেই চলছে এই ‘দুর্ঘটনা’ নামক ‘হত্যাযজ্ঞ’। এ নিয়ে অনেক কথা হলেও কাজের কাজ তেমন কিছুই হচ্ছে না। প্রশ্ন উঠেছে এভাবে আর কতোদিন?
Advertisement
এবার সিরাজগঞ্জে বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম সংযোগ মহাসড়কে দুই বাস ও একটি ট্রাকের ত্রিমুখী সংঘর্ষে পাঁচ নারী নিহত হয়েছেন। এতে আহত হয়েছেন আরও অন্তত ২০ জন। বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সদর উপজেলার কড্ডার মোড়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। সকালে ঢাকা থেকে বগুড়াগামী আলিফ পরিবহনের একটি বাস কড্ডার মোড়ে এসে নিয়ন্ত্রণ হারায়। এ সময় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি মিনিবাস ও এর পাশের একটি ট্রাকের সঙ্গে বাসটির সংঘর্ষ হলে আলিফ পরিবহনের বাসটি রাস্তার ওপর ও মিনিবাসটি পাশের খাদে পড়ে যায়।
দেশের কোনো না কোনো স্থানে প্রতিদিনই কারো না কারো জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে ‘দুর্ঘটনা’ নামক দানবের হাতে। এ ধরনের মর্মান্তিক মৃত্যু কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে।
এক হিসেবে দেখা যায়, গত ১৫ বছরে দেশে প্রায় দেড় লাখেরও বেশি সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এতে ৫০ হাজারের বেশি লোক প্রাণ হারায়। আহতের সংখ্যা এর চেয়েও কয়েকগুণ বেশি। সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে প্রতিবছর দেশের ক্ষতি হচ্ছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ২ শতাংশ। নাজুক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোগত সমস্যা, পরিকল্পনা ও নীতির দুর্বলতা, অসচেতনতা ইত্যাদি বিষয় সড়ক দুর্ঘটনা ত্বরান্বিত করছে। তাই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কর্তৃপক্ষকে সেসব সমস্যা দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, এক বছরে প্রায় ২০ হাজার ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনায় ৩ হাজার মানুষ নিহত হয়। আহত হয় এক লাখ। এদের বেশিরভাগই পঙ্গুত্ববরণ করে।
Advertisement
কারণগুলো জানা থাকলেও প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না দুর্ঘটনা। যানবাহনের অধিক এবং বেপরোয়া গতিই কেড়ে নিচ্ছে অনেকের প্রাণ। রংপুরের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও চালকের বেপরোয়া গতিই অন্যতম কারণ। সংঘর্ষে দু’টি বাসের দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া থেকেই বিষয়টি আঁচ করা যায়। কিন্তু দোষী চালককে এজন্য তেমন কোনো শাস্তি পেতে হয় না। কারো শাস্তি হলে হরতাল ধর্মঘট ডেকে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা জিম্মিদশা সৃষ্টি করে। সত্যি বলতে কি নানাভাবেই পরিবহন সেক্টরের কাছে মানুষজন জিম্মি। এই দশা যে কবে কাটবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
সুষ্ঠু ও নির্বিঘ্ন যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিতের জন্য সমন্বিত ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা জরুরি। দুর্ঘটনা রোধে চালক ও পথচারীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। যানবাহনের উচ্চগতি দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। দোষী ব্যক্তির শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। জেব্রা ক্রসিং ও ফুটওভার ব্রিজ ছাড়া রাস্তা পারাপার বন্ধ করতে হবে। যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া যাবে না। ফুটপাথগুলো দখলমুক্ত করে পথচারী চলার উপযোগী করতে হবে। তুলে দিতে হবে মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন। রাস্তা চলাচলে আইন অমান্যের জন্য আরও কঠিন শাস্তি ও জরিমানা আদায় করতে হবে। তাছাড়া রাস্তায় যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং, ফুটপাথ দখল করে ব্যবসাবাণিজ্য পরিচালনা, একই রাস্তায় নছিমন-করিমনসহ বিভিন্ন গতির যানবাহন চলাচল, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি, চালকের মাদকাসক্তি ইত্যাদি কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। কর্তৃপক্ষের সুষ্ঠু ও সমন্বিত পদক্ষেপে দেশ দুর্ঘটনামুক্ত হবে এ প্রত্যাশা সকলের। দেশের মানুষ সড়কে নিরাপত্তা চায়। তারা এ ধরনের করুণ মৃত্যু ও কান্না আর দেখতে চায় না।
এইচআর/এমএস
Advertisement