আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) একের পর এক অভিযোগ ও দাবি জানিয়েছে বিএনপি, ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, হয়রানি, গায়েবি মামলা, রিটার্নিং কর্মকর্তা, পুলিশ সুপারসহ ৯২ জন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহারসহ নানা দাবি ছিল সরকারবিরোধী এই পক্ষের।
Advertisement
এ প্রসঙ্গে ইসি বলছে, এখন এ বিষয়ে তাদের কিছুই করার নেই। নির্বাচনের এই সময়ে আর দলীয় অভিযোগ আমলে নেয়া হবে না। এখন প্রার্থীদের অভিযোগের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হবে।
তফসিল ঘোষণার পর প্রায় প্রতিদিনই নানান অভিযোগ নিয়ে ইসিতে যায় বিএনপি, ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এমনকি নির্বাচন কমিশন সচিবের প্রত্যাহার ও বিচারও চাওয়া হয়েছে। রিটার্নিং কর্মকর্তাদের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ব্রিফিংয়ের অভিযোগও আনা হয়। নিজদলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের হত্যার হুমকি, মামলা, হামলা ও বিভিন্ন হুমকির অভিযোগও করা হয়।
তবে বসে ছিল না আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটও। বিএনপির বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগও আনে ক্ষমতাসীন দল। বিএনপি নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করছে বলেও অভিযোগ করে দলটি।
Advertisement
সরকারবিরোধী পক্ষের দাবি ও অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বুধবার জাগো নিউজকে বলেন, বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের দাবিগুলো সুনির্দিষ্ট নয়। তাই কিছু করা যাচ্ছে না। তবে এ বিষয়ে পুলিশকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এখন থেকে দলীয় কোনো অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে না। প্রার্থী কোনো অভিযোগ করলে সেটি আমলে নেয়া হবে।
তিনি বলেন, ‘দলগুলোর সব অভিযোগ পর্যালোচনা করা হয়েছে। মামলা-মোকদ্দমার বিষয়ে পুলিশের কাছে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে, অধিকাংশ অভিযোগের বিষয়ে কিছুই করার নেই ইসির, যা করার রয়েছে তার প্রত্যেকটি নিয়ে কমিশন কাজ করছে।’
ইসিতে যত অভিযোগ ও দাবি
গত ৮ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ভোট পেছানোর দাবি জানায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলে এতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। এরই মধ্যে ১২ নভেম্বর ভোটের পুনর্নির্ধারিত তারিখ জানানো হয়। পূর্বঘোষিত ২৩ ডিসেম্বরের তারিখ পিছিয়ে ৩০ ডিসেম্বর করা হয় ভোটের দিন। বিএনপি ও অন্য বিরোধী পক্ষের দাবি এবং আওয়ামী লীগের সম্মতির ফলে এটি মেনে নেয় ইসি।
Advertisement
১৪ নভেম্বর বিকেলে ও সন্ধ্যায় ইসির সঙ্গে আলাদা বৈঠকে বসে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগ। ভোট আবারও পেছাতে বলে ঐক্যফ্রন্ট। আওয়ামী লীগ বলে, কোনোভাবেই আর ভোট পেছানো যাবে না, একদিন এমনকি এক ঘণ্টাও ভোট পেছানো যাবে না।
এদিন ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব দেন ড. কামাল হোসেন আর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেন নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো চেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম। ঐক্যফ্রন্ট ইভিএমের (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) বিরোধিতা, সেনা মোতায়েন, প্রশাসনে রদবদল, ভোট পেছানোসহ নানা দাবি জানায়। আর আওয়ামী লীগ অভিযোগ করে ‘ষড়যন্ত্রের’ অংশ হিসেবে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সংঘাত ঘটানো হয়েছে, ভোটের তারিখ পেছানোর দাবি তোলা হয়েছে।
জিয়া অরফানেজ স্ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি দণ্ডিত হন তারেক রহমান। তিনি গত ১৮ নভেম্বর বিএনপির মনোনয়ন বোর্ডে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ে প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নেয়ায় ইসিতে অভিযোগ দেয় আওয়ামী লীগ।
‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরিতে বিভিন্ন অভিযোগ ও দাবি নিয়ে ২০ নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদাকে পাঁচটি চিঠি দেয় বিএনপি।
২২ নভেম্বর ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপি ১৩ দফা দাবি নিয়ে ইসিতে চিঠি দেয়। এর মধ্যে জনপ্রশাসন ও পুলিশের ‘দলবাজ’ কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার, ‘পুলিশের তথ্য অনুযায়ী’ ভোটগ্রহণে কর্মকর্তা নিয়োগ না দেয়াসহ ইসি সচিবের বিরুদ্ধেও নালিশ দেয়া হয়।
নির্বাচন সামনে রেখে প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রত্যাহারে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দাবির ও এই জোটের বিরুদ্ধে ২৩ নভেম্বর ইসিতে পাল্টা অভিযোগ জানায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল। অপরদিকে এদিন সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক ইসির সঙ্গে বৈঠক করে ৮ দফা দাবি তুলে ধরেন।
২৫ নভেম্বর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ১৩ দফা দাবি নিয়ে কমিশনে বৈঠক করেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ।
এ বৈঠকে ২০ দলীয় জোটের পক্ষে দাবি করা হয়, ভোটকে সামনে রেখে ‘গায়েবি মামলা বা অজ্ঞাত আসামিসহ মামলাগুলো’ ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘সাসপেন্ড’ রাখা, শুধু পক্ষপাতদুষ্ট কর্মকর্তাদের সাময়িকভাবে ভোটের দায়িত্ব থেকে বিরত রাখতে হবে; বিতর্কিতদের এক জেলা থেকে অন্য জেলায় বদলি করতে হবে।
২৬ নভেম্বর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তিন দাবিতে ইসিতে চিঠি দেয়। সরকারি দলকে বিশেষ সুবিধা দিতে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহ, সরকারি চিঠিপত্রে আওয়ামী লীগের দলীয় স্লোগান ব্যবহার এবং ব্যাংকের সিএসআর (সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম) ফান্ডের টাকায় কেনা ত্রাণসামগ্রী সংসদ সদস্যদের দিয়ে বিতরণ বন্ধের দাবিতে ইসিতে এদিন চিঠি নিয়ে যান বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা বিজন কান্তি সরকারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল।
সরকারবিরোধী পক্ষের এসব দাবি ও অভিযোগের বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রহুল কবির রিভজী জাগো নিউজকে বলেন, সরকারের একটি আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে ইসি। তাদের আচরণ পক্ষপাতমূলক। তারা আমাদের কোনো দাবিই মানছেন না। আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ নষ্ট করছে। প্রশাসন দলীয়করণ করা হচ্ছে। অথচ এসব ব্যাপারে ব্যবস্থা নিচ্ছে না ইসি। এতে আমরা শঙ্কিত। উল্লেখ্য, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ৩০ ডিসেম্বর। মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ২৮ নভেম্বর (বুধবার)। মনোনয়নপত্র বাছাই শুরু হবে ২ ডিসেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহার ৯ ডিসেম্বর, আর প্রতীক বরাদ্দ হবে ১০ ডিসেম্বর।
এইচএস/জেডএ/এমএস