প্রবাস

তরুণদের জন্য নতুন দুয়ার খুলছে জাপান

জাপানের কলকারখানার চাকা সচল রাখতে বিদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দেশটির সরকার। আর এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশগুলো। শ্রমবাজারে তরুণদের জন্যই এ দুয়ার খুলছে। মেধাবী ও দক্ষরাও দেশটিতে কাজের সুযোগ নিতে পারেন।

Advertisement

‘জন্মহার কমার পাশাপাশি বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে বলে সতর্কবার্তা জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের। সম্প্রতি ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এই সমস্যা এখনই মোকাবেলা করার জন্য সরকারের প্রয়োজনীয় নীতিগুলোকে বেশ জোরে ঠেলা দিতে হবে।

বরাবরই বিদেশি নেওয়ার ব্যাপারে জাপান কিছুটা রক্ষণশীল। ফলে, মেধাবী ও দক্ষ শ্রমিকেরাও দেশটিতে কাজের সুযোগ পান কম। তবে শ্রমিকের ঘাটতি পূরণ করতে চাইলে আর দুয়ার বন্ধ করে রাখা চলে না এটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন আবে। সম্প্রতি কর্মক্ষম মানুষের ঘাটতি পূরণ করতে বিদেশি শ্রমিক নেওয়ার কথা জানিয়েছে জাপান।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স, দ্য ইকোনমিস্ট ও টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটির মন্ত্রিসভা এ সংক্রান্ত একটি খসড়া আইন অনুমোদন করেছে। তবে ঠিক কতজন নেয়া হবে, সে বিষয়ে সরকারি কোনো তথ্য না এলেও দেশটির গণমাধ্যম থেকে জানা গেছে, এ সংখ্যা ৩ লাখ ৪০ হাজারের মতো। ২০১৯ সাল থেকে শুরু করে আগামী পাঁচ বছরে এই কর্ম ভিসা প্রদান করা হবে। এই সিদ্ধান্ত জাপানের জন্য খুবই ব্যতিক্রমী এক সিদ্ধান্ত।

Advertisement

জাপানে প্রতিবছর জন্ম মৃত্যুর ব্যবধান ৪ লাখ। জীবন প্রত্যাশা ৮৪ বছর পর্যন্ত, যা পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। ৬৫ বা তার চেয়ে বেশি বয়সের জনসংখ্যা ২৮ দশমিক ১ শতাংশ। জাতিসংঘের হিসাবে জাপানের এই সংখ্যা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ, যা ইতালিতে ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ, পর্তুগালে ২১ দশমিক ৯ শতাংশ এবং জার্মানিতে ২১ দশমিক ৭ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রের ১৫ ও ভারতের ৬ শতাংশ। জাপানের শতবর্ষী বা তার বেশি মানুষের সংখ্যা বর্তমানে ৬৯ হাজার ৭৮৫ জন। দুই দশক আগের চেয়ে যা ৭ গুণ বেশি।

কল্যাণমূলক রাষ্ট্রটি বয়স্ক মানুষের অবসর ভাতা টানতে টানতে এখন বিপাকে পড়েছে। সরকারি ঋণের পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২৫০ শতাংশ। এখন যেভাবেই হোক, তৃতীয় বৃহৎ অর্থনীতির এই দেশের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তিনটি উপায় আছে আবে সরকারের হাতে ১. বর্তমান কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর কাজের বয়স বাড়ানো, ২. নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো ও ৩. বিদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া।

মানুষ অবসর না নিয়ে সারা জীবনই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকুক। তার সরকার সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য অবসরকালীন ৬০ বছর থেকে বাড়িয়ে ৬৫ করেছে। এ ছাড়া বেসরকারি কোম্পানিগুলোকেও এই নীতি গ্রহণে উৎসাহিত করছে। সরকারের চাহিদামতো অনেক কোম্পানিই অবসর নেওয়ার বয়স বাড়িয়েছে এবং অবসরে যাওয়া কর্মীদের নতুন করে খণ্ডকালীন চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।

বর্তমানে ৬৫ বছরের ওপরে কর্মক্ষম মানুষের হার ২৩ শতাংশ। যা অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি। দেরি করে অবসরের সময় শুরু হলেও অবসর ভাতার পরিমাণ বাড়াচ্ছে সরকার। অবশ্য দীর্ঘ মেয়াদে অন্য পরিকল্পনা আছে আবে সরকারের। রোবট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে শ্রমিকঘাটতি পূরণ করতে চান তিনি।

Advertisement

স্বল্প মেয়াদে সমস্যা মেটাতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছেন আবে। তার ছয় বছরের শাসন আমলে নতুন প্রায় ২০ লাখ নারী কর্মক্ষেত্রে যোগ দিয়েছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও জাপানে কর্মক্ষম নারীর অংশগ্রহণ বেশি। নারীদের সন্তান রাখার সুবিধার জন্য নার্সারির সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। এমনকি আগামী বছর থেকে নার্সারিতে কোনো ধরনের ফি না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বড় বড় কোম্পানি নারীবান্ধব করতে নির্দেশ দিয়েছে সরকার। বর্তমানে মা হওয়ার পর ৫০ শতাংশ নারীই কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসেন। ২০১০ সালে যা ছিল ৩৮ শতাংশ।

বিদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়ার ক্ষেত্রে আবে সরকারের নিজের সমর্থকদেরই তেমন সমর্থন নেই। অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার ভয়ে বিদেশি শ্রমিক নেওয়ার ক্ষেত্রে সব সময় নিরুৎসাহিত বোধ করেন তারা। বর্তমানে জাপানে বিদেশি শ্রমিকের হার মাত্র ২ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে যা ১৭ শতাংশ। এ ছাড়া যারা আছেন বেশির ভাগই হয় ছাত্র না হয় প্রশিক্ষণার্থী। তাই নির্মাণ, হোটেল, নার্সিং, কৃষিসহ ১৪টি খাতে বিদেশি শ্রমিকদের নিয়োগ দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে দেশটি।

ভিসাপ্রত্যাশীরা প্রাথমিকভাবে পাঁচ বছরের ভিসা পাবেন। পরিবার নিয়ে যেতে পারবেন না এবং অবশ্যই জাপানি ভাষা জানতে হবে তাদের।

জাপানের এই বিদেশি কর্মী নেওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ কীভাবে কাজে লাগাতে পারবে, তা জানতে চাইলে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্স ইউনিট (রামরুর) প্রোগ্রাম পরিচালক মেরিনা সুলতানা বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে খুব বড় একটি সুযোগ। জাপান খুবই ভালো একটি বাজার। আমাদের অনেক শিক্ষিত ছেলেমেয়ে দেশে চাকরি পাচ্ছে না। এটা তাদের জন্য একটা সুযোগ। কোনো দেশেই অদক্ষ কর্মী নেয় না। তাই এই শ্রমশক্তি রফতানির মাধ্যমে দক্ষ কর্মী বাহিনী তৈরি হবে। এটা খুবই সম্ভবনাপূর্ণ। যদি বাংলাদেশিরা সেখানে ভালো করে চাহিদা আরও বাড়বে।’

ভাষা শিক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে মেরিনা সুলতানা বলেন, ‘জাপানে শ্রমশক্তি রফতানির বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে সরকার ভাবতে শুরু করেছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ২৪টি ট্রেইনিং সেন্টারে জাপানি ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অবশ্যই আমাদের জন্য এটি সম্ভাবনার খবর।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব রওনক জাহান বলেন, এই বিষয়কে খুবই গুরুত্বসহকারে নেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে সরকারিভাবে জাপানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলা হবে। তিনি বলেন, জাপানে যেনতেনভাবে লোক পাঠানো হবে না। সেখানে মেধাবী ও নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন লোকদের পাঠানো হবে।

এমআরএম/পিআর