মতামত

বদির বদলে বধূ, লাউয়ের বদলে কদু

অন্তত ১৩ হাজার লোক দিন দশেক ধরে টেনশনে ঘুমাতে পারছিলেন না। এরা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, গণফোরামসহ বিভিন্ন দলের মনোনয়ন চেয়ে ফরম কিনেছিলেন। তারপর থেকেই তাদের নির্ঘুম অপেক্ষা, দৌড়াদৌড়ি, তদ্বির চলছিল; চলছিল সাক্ষাৎকার। দলগুলোর নেতারাও দিনের পর দিন বৈঠক করে হাজার হাজার ফরম থেকে যোগ্য লোককে বেছে নিতে গলদঘর্ম হচ্ছিলেন।

Advertisement

বিএনপির নেতৃত্বের কেন্দ্রে থাকা বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে, তারেক রহমান লন্ডনে। তাই দলটির মনোনয়ন ফরম কেনা ৪ হাজার ৫৮০ জন প্রত্যাশী কখনো গুলশান, কখনো নয়াপল্টন, কখনো নেতাদের বাসায় বাসায় ঘুরছিলেন। তবে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার কেন্দ্রে একজনই- শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের ফরম কেনা ৪ হাজার ২৩ জনের সব চেষ্টা তাই গণভবন ঘিরে।

আওয়ামী লীগই প্রথম প্রার্থীদের চিঠি দেয়া শুরু করেছে। রোববার রাতে অন্তত ২৩০ জনের আরামে ঘুম হওয়ার কথা। কারণ তারা দলের 'প্রেমপত্র' পেয়েছেন। তবে অতি আনন্দে কারো কারো ঘুম নাও হতে পারে। অবশ্য অন্তত ১১ আসনে একাধিক প্রার্থীকে চিঠি দিয়ে আওয়ামী লীগ তাদের টেনশন আরো বাড়িয়ে দিল। আর যারা মনোনয়ন চেয়েও পাননি, তাদের মন খারাপের রাত আরো দীর্ঘ হলো। বাকি ৭০ আসন আওয়ামী লীগ রেখেছে ১৪ দল এবং মহাজোটের শরিকদের জন্য।

পরপর দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা একটি দলের মনোনয়ন নিয়ে দলের ভেতরে এবং বাইরে দারুণ কৌতূহল থাকে। সেই কৌতূহলে কার্যত জল ঢেলে দিল। আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালিকায় কোনো চমক নেই। চমক থাকতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থেকে যাদের চর্বি জমে গেছে, যারা জনগণ থেকে অনেক দূরে সরে গেছেন; দলের স্বার্থে তাদের এবার বাদ দেয়া হবে; এমন কথা শোনা যাচ্ছিল। ৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগ ধ্বংস হয়ে যেতে পারতো। হয়নি তাদের তৃণমূলের নেতাদের অসামান্য ত্যাগ আর মাটি কামড়ে পড়ে থাকার মানসিকতার কারণে।

Advertisement

১৯৮১ সালে দেশে ফিরে সেই তৃণমূলকে সঙ্গে নিয়ে দলকে পুনর্গঠিত করেন। কিন্তু গত ১০ বছরের ক্ষমতায় থাকার প্রক্রিয়ায় সেই তৃণমূল আজ উপেক্ষিত, দিশাহীন, কোন্দল জর্জরিত। মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় তৃণমূলের মতামত নেয়ার যে রীতি, তাও এবার অনুসরণ করা হয়নি। মনোনয়ন প্রত্যাশীরা পাননি সংসদীয় বোর্ডে সাক্ষাৎকার দেয়ার সুযোগ। বলছিলাম তৃণমূলের কথা।

আওয়ামী লীগের তৃণমূলের এই ছন্নছাড়া দশার কারণ স্খানীয় নেতৃত্ব। বিষেশ করে এমপিরা কর্মীদের মূল্যায়ন করেননি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তো বটেই, এমনকি নিজ দলের প্রতিপক্ষদেরও এমপিদের অনেকে কোণঠাসা করেছেন নিষ্ঠুরভাবে। তাছাড়া চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, মাস্তানি, আত্মীয়করণ, টাকা নিয়েও চাকরি না দেয়া, মারধোর, দুর্ব্যবহার ইত্যাদি এন্তার অভিযোগে এমপিদের অনেকেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়া আত্মঘাতী অন্তর্কোন্দলও দলটির জন্য উদ্বেগের।

অনেক এলাকায় এমপিদের 'অবাঞ্ছিত' ঘোষণা করার প্রবণতা শুরু হয়েছিল। দলের কঠোর নির্দেশে তা বন্ধ হয়েছিল। এমনকি আওয়ামী লীগ নেতারা গণভবনে এসে প্রধানমন্ত্রীর সামনে দলীয় এমপির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেন। আওয়ামী লীগের তৃণমূল এবং সাধারণ মানুষের আকাঙ্খা ছিল এইসব জনবিচ্ছিন্ন, দুর্নীতিবাজ, মাস্তানদের এবার বাদ দেয়া হবে। যাদের কারণে শেখ হাসিনার অসাধারণ নেতৃত্বে উন্নয়নের অসামান্য অর্জন ম্লান হতে বসেছে; তাদের বাদ দেয়ার আকাঙ্খাটা উঠে এসেছিল বিভিন্ন জরিপেও।

এবার মনোনয়নে তৃণমূলের মতামত নেয়া না হলেও বিভিন্ন সময়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে মাঠপর্যায়ে জরিপ চালানো হয়। সেই সব জরিপ সমন্বয় করেই এবার মনোনয়ন দেয়ার কথা। মাস দুয়েক আগেও নানা সূত্রে শোনা গেছে, বিভিন্ন জরিপ মিলিয়ে অন্তত ১০০ জন এমপিকে জনবিচ্ছিন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাদের মধ্যে অন্তত ৭০ জন বাদ পড়বেন বলে শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার কিছুই হয়নি। যে কজন বাদ পড়েছেন, তারা হয় বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা বা তীব্র অন্তর্কোন্দলের কারণে।

Advertisement

জরিপে জনবিচ্ছিন্ন, সমালোচিত কাউকেই বাদ দেয়া হয়নি। চিহ্নিত ৭০ জনকে বাদ দেয়া হলে সারাদেশে একটা ইতিবাচক বার্তা যেতে পারতো যে, আওয়ামী লীগ দুর্নীতিবাজ বা মাস্তানদের সমর্থন দেয় না। কিন্তু আওয়ামী লীগ করেছে উল্টোটা। সবার সব অপকর্মের দায় দল হিসেবে কাঁধে নিয়েছে। এদের বাদ দিলে নাকি তাদের অপকর্ম স্বীকার করে নেয়া হতো, যেটা নাকি তাদের সমালোচনার সুযোগ করে দিতো। কী হাস্যকর ভাবনা। ভুল স্বীকার করার মধ্যে কোনো গ্লানি নেই। সমালোচিতদের বাদ দিলেই বরং দলের ও সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতো। রানিং এমপিরা প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন, এই বিবেচনাতেই খুব বেশি বদলানো হয়নি। কিন্তু এই বিবেচনাটাই অগ্রহণযোগ্য। প্রশাসনে প্রভাব বিস্তারের ভাবনাটা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ধারণাকেই আরো বিতর্কিত করবে।

২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনেও আগের মন্ত্রিসভার ৬ সদস্য বাদ পড়েছিলেন। এবার বাদ পড়েছেন মাত্র একজন। ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়ের অপকর্ম এতটাই আকাশ ছুঁয়েছিল, তাকে বাদ না দিয়ে উপায় ছিল না। অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত বাদ পড়েননি, অবসরে গেছেন। কিন্তু মহা গুরুত্বপূর্ণ সিলেট-১ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন তার ভাই এম এ মোমেন। বাদ পড়ে আলোচিত চার কেন্ত্রীয় নেতা। দুই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আব্দুর রহমান এবং দুই সাংগঠনিক সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম ও বি এম মোজাম্মেল বাদ পড়েছেন।

নানককে বাদ দেয়াটা অনিবার্য ছিল। তার নির্বাচনী এলাকায় বার্নিকাটের গাড়িতে হামলা হয়েছিল। তার দায় তিনি এড়াতে পারেননি। বাকি তিন নেতা বাদ পড়েছেন তীব্রতম দলীয় কোন্দলের কারণে। তবে এই মনোনয়নের চমক হলো ফরিদপুর-১ আসন। ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমানকে ঠেকাতে তৎপর ছিলেন অনেকেই। মনোনয়নের ব্যাপারে সিরিয়াস ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদার, কৃষক লীগের সহ-সভাপতি আরিফুর রহমান দোলন ও স্বর্ণ ব্যবসায়ী কাজী সিরাজ। কিন্তু মনোনয়ন পেয়েছেন যিনি কোনো আলোচনায়ই ছিলেন না, সাবেক সচিব মঞ্জুরুল ইসলাম বুলবুল।

মনোনয়নপ্রাপ্তের জন্য আলোচিত পটুয়াখালী-৩। ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী খ ম জাহাঙ্গীর এই আসনের পাঁচবারের সাংসদ। তাকে বাদ দিয়ে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে অপরিচিত ও অরাজনৈতিক ব্যবসায়ী এস এম শাহজাদাকে। তার একমাত্র যোগ্যতা, তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার ভাগ্নে। কী আশ্চর্য, সিইসির ভাগ্নেকে কেন নির্বাচন করতে হবে?

আওয়ামী লীগ গত ১০ বছর ধরেই ডিজিটাল বাংলাদেশ আর তারুণ্যের জয়গান গেয়ে আসছেন। এক ঝাঁক তরুণ মনোনয়নের আশায় মাঠে ছিলেন নানাভাবে। কিন্তু তাদের অনেকেরই ঠাঁই হয়নি। বয়সের ভারে ন্যুব্জ রাজিউদ্দিন রাজু, রেবেকা মোমেনরাই মনোনয়ন পেয়েছেন। মোশতাক মন্ত্রিসভার সদস্য প্রয়াত আব্দুল মোমেনের স্ত্রীকে কেন বারবার মনোনয়ন দিতে হবে, কেন সেখানে একজন বিকল্প নেতাকে তৈরি করা হয়নি।

চট্টগ্রামের সাতকানিয়া জামায়াতের ঘাঁটিতে কাটা দিয়ে কাটা তোলার নীতিতে সাবেক জামায়াত নেতা আলী রেজা নদভীকে আবারও মনোনয়ন দেয়া নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। আবার মাশরাফি বিন মোর্তাজার মনোনয়ন সাড়া ফেলেছে দেশজুড়ে। মেয়র মহিউদ্দিনের ছেলে মহিবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের ছেলে নিজামউদ্দিন জলিল জন, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, সাবেক সভাপতি এনামুল হক শামীম, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সাইফুজ্জামান শিখর, ইকবাল হোসেন অপু, সাবেক আইজি নূর মোহাম্মদ, শেখ হেলালের ছেলে সুদর্শন শেখ তন্ময়, শেখ হেলালের ভাই শেখ জুয়েল, নিটোল-নিলয় গ্রুপের সেলিমা আহমেদ প্রথম মনোনয়ন পেয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন।

তবে দুইজনের বাদ পড়া নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা হয়নি, হাসাহাসি হচ্ছে। খুনের দায়ে কারাগারে থাকা আমানুর রহমান খান রানা মনোনয়ন পাননি। এই খবরে উল্লাসের বদলে মুচকি হাসছেন সবাই, কারণ রানার আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন তার বাবা আতাউর রহমান খান। সবচেয়ে হাস্যকর হয়েছে আবদুর রহমান বদি ও মিসেস বদির মধ্যে চোর-পুলিশ খেলাটা। বদি ইয়াবা চোরাচালানের মূল হোতা। পুলিশের সব তালিকায় তার নাম সবার ওপরে। দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনার মুখে তাকে এবার মনোনয়ন দেয়া হয়নি। কাকে দেয়া হয়েছে? মিসেস বদি শাহীন আক্তার চৌধুরীকে। আওয়ামী লীগ বুঝি মানুষকে এতই বোকা ভাবে?

আমার স্ত্রী মুক্তি শিকদারের একমাত্র ছোট ভাই রাসেল শিকদার। তার মানে তাকে আমি প্রকাশ্যে শালা ডাকতে পারি। এই শালা দারুণ এক প্রতিভা, রাসেল ভালো লিখে, গায়। প্রতিভার নিদারুণ অপচয় আমার এই একমাত্র আপন শালা। বদির বদলে তার স্ত্রীর মনোনয়ন পাওয়ার আলোচনার সময় তিনি ফেসবুকে একটি ছড়া লিখেছেন। সেটি দিয়েই আজকের লেখা শেষ করছি,বদির বদলে বধূলাউয়ের বদলে কদু।২৬ নভেম্বর, ২০১৮

এইচআর/পিআর