বিদেশে মূলধারার রাজনীতিতে ক্রমেই বাংলাদেশিদের পদচারণা বেড়েই চলেছে। বাহিরের রাজনীতিতে বাংলাদেশ কথাটি আসলেই ব্রিটেনের রুশনারা আলী নামটি সামনে আসে। তিনিই প্রথম ব্রিটিশ বাংলাদেশি এমপি। এরপরই নির্বাচিত হন টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক, রুপা হক।
Advertisement
এ ছাড়াও বিভিন্ন দল থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন আরো অনেকেই। শুধুমাত্র ব্রিটেন নয় বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পার্লামেন্টে বর্তমানে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতে বাড়ছে বাঙালি প্রজন্মের অংশগ্রহণ।
তেমনই এক তরুণ রাজনীতিবিদ মাহমুদুর রহমান। অস্ট্রিয়ান মূলধারার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে ২৩ বছর বয়সী এই তরুণ বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপকালে মাহমুদুর রহমানের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়া এবং অস্ট্রিয়ান রাজনীতির বিষয়ে নানা কথা জানান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নাঈম হাসান পাভেল।
বাংলাদেশের এক বিস্ময়কর বালক মাহমুদুর রহমান। অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় জন্ম হলেও মাত্র একবছর পর পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশে চলে আসেন। কাটে ১০ বছর। এরপর আবারো অস্ট্রিয়ায় যাত্রা। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পরিবেশে দশ বছর পর মাহমুদুর রহমানকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। নতুন ভাষা, ভিন্ন সহপাঠী, ভিন্ন পরিবেশ।
Advertisement
দ্রুত আয়ত্ব করে নেন অস্ট্রিয়ান ভাষা। হাইস্কুল শেষ করে মাহমুদ সরকারি টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে পড়ার সুযোগ পান। সেখানে নিজেকে ভিন্ন মাহমুদ হিসেবে আবিষ্কার করেন। স্কুলে মাল্টিকালচারাল পরিবেশে পড়াশোনার পাশাপাশি মাহমুদ তার আশপাশের সমস্যাগুলো নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করেন। স্কুলের যেকোনো সমস্যা নিয়ে তিনি সমাধানের কথা বলতেন। পরিবর্তন চাইতেন এবং উন্নয়নে নজর দিতেন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই সরকারি ইনস্টিটিউটের ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে ছাত্র সংসদে পর পর দুইবার সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করে। স্কুল, ইনস্টিটিউটের উন্নয়ন ও ছাত্রদের নানা বিষয়ে নেতৃত্ব দিতে দিতে এক সময় মাহমুদ অল অস্ট্রিয়ান ছাত্র সংসদের সভাপতি নির্বাচিত হন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে মাহমুদের এমন অর্জন ছিল গৌরবের।
ইনস্টিটিউটে পড়া শেষে মাহমুদ উচ্চশিক্ষায় পাড়ি দেন ব্রিটেনে। আইটি বিষয়ে পড়ার তীব্র আগ্রহ থেকে ব্যাচেলর প্রোগ্রামে ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ল্যাঙ্কাশায়ারে। আইটি বিষয়ে ব্যাচেলর স্টাডি শেষে এমএসসি শেষ করেন ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিষয়ে।
২০১৫ সালে তখন উচ্চশিক্ষা গ্রহণে মাহমুদ অবস্থান করছিলেন ব্রিটেনে। সেখানে অবস্থান করলেও অস্ট্রিয়ান পিপলস পার্টির যুব ইউনিটের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি যখন ব্রিটেনের ল্যাঙ্কাশায়ারে অধ্যায়নরত তখনই প্রথমবারের মতো পিপলস পার্টি থেকে তার জন্য একটি বার্তা আসে। ভিয়েনা সিটি কাউন্সিলর নির্বাচনে ভিয়েনা ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলর হিসেবে মনোনয়ন পান মাহমুদুর রহমান।
Advertisement
অপ্রস্তুত মাহমুদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যায়নের ফাঁকে সময় করে এসে নির্বাচনে অংশ নেন। সেবার তিনি নির্বাচিত হতে পারেননি। তবে নির্বাচনী ক্যাম্পেইন ও পরবর্তীতে বিপুল সংখ্যক তরুণদের তিনি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করেন। তার আশপাশের নানা ইস্যু নিয়ে ব্যাপক পরিবর্তনের ডাক দেন। অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে তিনি দাবি আদায়ে সমর্থ হন।
অস্ট্রিয়ান তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সিবাস্তিয়ান ক্রুজ পিপলস পার্টির তরুণ নেতৃত্ব মাহমুদুর রহমানকে অস্ট্রিয়ান ইন্ট্রিগ্রেশন অ্যাম্বাসেডর হওয়ার জন্য প্রস্তাব দেন মাহমুদ সেটি সাদরে গ্রহণ করেন। এখনো পর্যন্ত তিনি বহাল রয়েছেন।
তরুণ মাহমুদুর রহমানের জন্য সবচেয়ে বড় চমকটি হাজির হয় ২০১৭ সালে। অক্টোবরে অনুষ্ঠেয় অস্ট্রিয়ান জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অস্ট্রিয়ান পিপলস পার্টির ভিয়েনা ডিস্ট্রিক্টের প্রধান ভিয়েনা ডিস্ট্রিক্ট ২৩ নম্বর আসন থেকে মাহমুদের এমপি পদে মনোনয়ন দিতে মাহমুদের নাম প্রস্তাব করেন। সেন্ট্রাল নমিনেশন বোর্ড মাহমুদুর রহমানকে এমপি পদে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেয়।
অক্টোবরের সেই নির্বাচনে মাহমুদুর রহমান বর্তমান বিরোধীদল সোশ্যাল ডেমোক্রেট পার্টির প্রার্থীর কাছে মাত্র ৩০০০ ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। কিন্তু তার দল অস্ট্রিয়ান পিপলস পার্টি ৩১ বছর বয়সী সাবাস্তিয়ান ক্রুজের নেতৃত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ক্ষমতায় আসে। মাহমুদুর রহমান নির্বাচিত হতে পারেননি তবুও ২২ বছর বয়সে মনোনয়ন সেটাও বিরাট চমক ছিল। জিতলে হয়তো নতুন ইতিহাস হতো, অস্ট্রিয়ান সংসদেও পৌঁছে যেতো বাংলার প্রতিনিধি।
মাহমুদুর রহমান নির্বাচন পরবর্তী সময়ে অস্ট্রিয়ান তরুণদের আরো বেশি পরিমাণে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করেন। তরুণদের মাঝে রাজনৈতিক সচেতনতা, তরুণদের মাঝে রাজনৈতিক ধারণা আরো পরিষ্কার করতে মাহমুদ রাজনৈতিক বিভিন্ন ক্যাম্পেইনে অংশ নেন, রাজনীতিতে তরুণদের অগ্রাধিকার দেয়ার দাবি জানান।
পরবর্তীতে ২০১৮ সালে অস্ট্রিয়ান পিপলস পার্টির অন্যতম ইউনিট অস্ট্রিয়ান পিপলস পার্টি যুব ইউনিটের রাজধানী ভিয়েনা শাখার সভাপতি হিসেবে মনোনীত হন বাংলাদেশি মাহমুদুর রহমান।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা হিসেবে মাহমুদুর রহমানের ইচ্ছে ২০২০ সালে তিনি আবারো পিপলস পার্টি থেকে ভিয়েনা সিটি নির্বাচনে ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার হিসেবে নির্বাচন করবেন। আর এমপি পদে নির্বাচন প্রশ্নে মাহমুদ জানান, সেটি নির্ভর করছে দলের সেন্ট্রাল মনোনয়ন বোর্ডের ওপর। তবে সুযোগ পেলে তিনি আবারো নির্বাচন করতে চান।
এমপি ক্যাম্পেইনে অংশ নিয়ে মাহমুদুর রহমান একবার একটি ইনস্টিটিউটে তার অস্ট্রিয়ান জীবন সম্পর্কে বলেন, সেখানে অস্ট্রিয়ান এক ছাত্র তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন ‘মাহমুদ তোমার মতো যদি সবাই ডেডিগেটেড হতো তাহলে আজ ইন্ট্রিগেশন নিয়ে আমাদের আর কোনো আলোচনা থাকতো না। সে’দিনের ক্যাম্পেইনে প্রধানমন্ত্রী সাবাস্তিয়ান ক্রুজ অংশ নিলেও উপস্থিত সবার বেশি নজর এবং প্রশ্ন ছিল মাহমুদুর রহমানের কাছে।
প্রবাসে থাকা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে বেড়েওঠা তরুণদের নিয়ে মাহমুদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশি তরুণরা নিজেদের কমিউনিটিতে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি স্থানীয় কমিউনিটিতে সম্পৃক্ত হওয়া জরুরি। স্থানীয় কমিউনিটিতে সম্পৃক্ত হয়ে সে’দেশের ভাষা, সংস্কৃতি জানা। এ ছাড়াও স্থানীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক ও খেলাধুলা বিষয়ক বিভিন্ন সংগঠনে সম্পৃক্ত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে মাহমুদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের গতানুগতিক রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনতে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদগুলোতে তরুণদের অগ্রাধিকার দিয়ে রাজনীতিতে সুযোগ করে দিতে হবে। নতুন ব্যবসা এবং চাকরির ক্ষেত্রে দুর্নীতি মুক্ত করা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়াও গতানুগতিক পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে বাইরে এসে জনগণের জন্য রাজনীতি হতে হবে।
এমআরএম/জেআইএম