টিন, গ্লাস, প্লাস্টিক প্যাকেজিং, মোড়ক, বোতল, ক্যানসহ যেসব পণ্য ব্যবহারের পর ফেলে দিতে হয় (ডিসপোজেবল) এমন পণ্য প্রস্তুতকারীদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষকে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। এমন বিধান রেখে ‘কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০১৮’ এর খসড়া প্রণয়ন করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।
Advertisement
খসড়া বিধিমালা অনুযায়ী, কেউ বিধিমালা লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধ ফের করলে প্রতিবার সর্বোচ্চ চার হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা দিতে হবে।
এছাড়া পরিচ্ছন্নতা তথা পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের জন্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলকভাবে প্রতি বছর ভালো কাজের স্বীকৃতি দিতে পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের জন্য কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি গুরুতর সমস্যা। দ্রুত নগরায়ন, বিক্ষিপ্ত শিল্পায়ন, বিপুল জনসংখ্যা ইত্যাদি কারণে আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের কঠিন বর্জ্যের বিপুল অংশ উন্মুক্ত জায়গায়, রাস্তার দু’পাশে বা নদী-নালায় নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। ফলে শহরের নিম্নাঞ্চল, জলাভূমি, এমনকী শহরে পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতির সম্মুখীন। এ প্রক্রিয়ায় ঢাকা মহানগরীকে বেস্টন করে প্রবাহমান চারটি নদীর জনপ্রবাহ মারাত্মক দূষণের শিকার।
Advertisement
তিনি আরও জানান, এক গবেষণার ফলাফল মতে, বাংলাদেশে শহরাঞ্চলে ১৯৯১ সালে যেখানে প্রতিদিন নয় হাজার ৮৭৩ টন বর্জ্য উৎপাদিত হতো সেখানে ২০০৪ সালে ১৬ হাজার ৩৮২ টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এ হারে বাড়তে থাকলে ২০২৫ সালে উৎপাদিত বর্জ্যের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৭ হাজার ৬৪ টন।
বাংলাদেশে কঠিন বর্জ্যের গঠন প্রকৃতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে খাদ্য এবং শাকসবজি, কাগজ দ্রব্যাদি, প্লাস্টিক, লেদার, রাবার, মেটাল, গ্লাস ও সিরামিক, কাঠ/খড়/পাতা, মেডিসিন/কেমিক্যাল, পাথর, ধুলি বিবিধ।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, ‘কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা প্রণয়নের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। তবে পরে যোগাযোগ করলে এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানাতে পারব।’
বিভিন্ন ডিসপোজেবল পণ্য প্রস্তুতকারী বা ব্র্যান্ডের মালিকদের দায়িত্বের বিষয়ে বিধিমালায় বলা হয়েছে, সকল ডিসপোজেবল (পরিত্যজনযোগ্য) পণ্য (যেমন-টিন, গ্লাস, প্লাস্টিক প্যাকেজিং, মোড়ক, বোতল, ক্যান ইত্যাদি) প্রস্তুতকারী বা এ জাতীয় পণ্যের ব্র্যান্ড মালিকরা সুষ্ঠু পৌর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার জন্য স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দেবে।
Advertisement
জৈবিকভাবে অপচনশীল ডিসপোজেবল পণ্যের ব্র্যান্ড মালিকরা তাদের পণ্যের মাধ্যমে সৃষ্ট প্যাকেজিং (মোড়ক/বোতল/ক্যান ইত্যাদি) বর্জ্য গ্রাহক পর্যায় থেকে সংগ্রহ করে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পুনঃচক্রায়নসহ ডিসপোজেবলের সুষ্ঠু ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে।
এছাড়া স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ডায়াপার প্রস্তুতকারী বা এ জাতীয় পণ্যের বাজারজাতকারী মালিকদের পণ্যের সঙ্গে ডিসপোজেবল থলে বা মোড়ক সরবরাহ করবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, ডিসপোজেবল পণ্য প্রস্তুতকারী বা ব্র্যান্ড মালিকরা সুষ্ঠু পৌর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রতিষ্ঠায় জনগণের করণীয় বিষয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান এবং এর বাইরে বসবাসরত স্থায়ী ও অস্থায়ী বাসিন্দাদের দায়িত্বের বিষয়ে বলা হয়েছে, নিজ নিজ কর্মস্থল বা আবাসস্থল বা অবস্থানস্থলে সৃষ্ট সকল বর্জ্য ও উচ্ছিষ্ট সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত পদ্ধতিতে ফেলবে।
ডিসপোজেবলের আগে জৈবিকভাবে পঁচনশীল কঠিন বর্জ্য (যেমন- রান্না করা বা রান্না না করা খাদ্য বর্জ্য বা উচ্ছিষ্ট, গাছের ছোট ডাল, লতা, পাতা, গৃহপালিত পশু-পাখির বর্জ্য, ইত্যাদি জৈবিক বর্জ্য) এবং জৈবিকভাবে অপঁচনশীল কঠিন বর্জ্য (যেমন- কাগজ, প্লাস্টিক, কাঁচ, কাপড়, রাবার, কাঠ, ধাতব বস্তু, ইত্যাদি অজৈব বর্জ্য) কমপক্ষে এই দুই শ্রেণিতে আলাদা আলাদা পাত্রে নিজের আঙিনায় রাখতে হবে।
নির্মাণ ও ভাঙন থেকে সৃষ্ট বর্জ্য পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাছে হস্তান্তর না করা পর্যন্ত নিজের জায়গায় এমনভাবে আলাদা করে রাখতে হবে যে ওই বর্জ্য অন্য কিছুর সঙ্গে মিশতে না পারে বা ওই বর্জ্যের কোনো অংশ থেকে কোনো ধুলাবালি বাতাসে উড়ে যেতে না পারে।
বর্জ্য নিজস্ব আঙ্গিনা ছাড়া রাস্তায়, সরকারি খোলা জায়গায়, ড্রেনে বা পানিতে নিক্ষেপ, পোড়ানো বা মাটি চাপা দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। সকল বর্জ্য সৃষ্টিকারীকে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে নির্ধারিত ফি পরিশোধ করতে হবে।
রাস্তার হকার, তার কর্মকাণ্ডের সময় উৎপন্ন বর্জ্য (যেমন- উচ্ছিষ্ট খাদ্য, পরিত্যাজনযোগ্য প্লেট, কাপ, ক্যান, মোড়ক, নারকেল খোল, উদ্বৃত্ত খাদ্য, শাকসবজি, ফল ইত্যাদি) সংগ্রহের জন্য যথোপযুক্ত পাত্র রাখবে। পরে এ ধরনের বর্জ্য নির্ধারিত বর্জ্য সংগ্রহ কন্টেইনার বা ভ্যানে জমা রাখবে।
প্রত্যেক সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভাসহ ও অন্যান্য স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের দায়িত্বের বিষয়ে বিধিমালায় বলা হয়েছে, বর্জ্য হ্রাস, পুনঃব্যবহার ও পুনঃচক্রায়নসহ কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে জাতীয় কৌশলের আলোকে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে।
স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় বা নিয়োজিত ব্যক্তি/ঠিকাদার/সমিতি/প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিটি বাড়ি থেকে জৈবিকভাবে পঁচনশীল কঠিন বর্জ্য ও জৈবিকভাবে অপচনশীল কঠিন বর্জ্য- এ দুই শ্রেণিতে আলাদাভাবে সংগ্রহ করতে হবে। পরবর্তীতে সক্ষমতা বৃদ্ধি-সাপেক্ষে ওই দুই শ্রেণির সঙ্গে আলাদাভাবে গৃহস্থলীর বিপদজনক বর্জ্য সংগ্রহ করতে হবে। বিভিন্ন শ্রেণির বর্জ্য পরিবহন করা যায় সেজন্য ভ্যান বা গাড়িতে আলাদা কামরা থাকতে হবে। শ্রেণিভিত্তিক পৃথকাবস্থায় পরিবহন নিশ্চিত করা এবং আচ্ছাদিত ব্যবস্থায় পরিবহনকালে বর্জ্য বা এর কোনো অংশ যেন দৃশ্যমান না হয়, পড়ে না যায় এবং যেন দুর্গন্ধ না ছড়ায় তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিবহনের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি/ঠিকাদার/সমিতি/প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় ফি নির্ধারণ করবে স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ। বিধিমালার উদ্দেশ্য পূরণে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে জাতীয় কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটি গঠন করা হবে। স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষ এ বিধিমালা অনুযায়ী কাজ করবে। তবে নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে না পারলে কমিটি ব্যাখ্যা চাইলে তা দিতে হবে। ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হলে বা ব্যাখ্যা না দিলে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করা যাবে।
বর্জ্য সৃষ্টির উৎস থেকে চূড়ান্ত পরিত্যাজনের (ডিসপোজাল) আগে ক্রমানুসারে পরিহার, হ্রাসকরণ, পুনঃব্যবহার, পুনঃচক্রায়ন, পুনরুদ্ধার, পরিশোধন- এ সব ধাপসমূহ অনুসরণ করতে হবে। কেউ এ বিধান লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধ ফের করলে প্রতিবার সর্বোচ্চ চার হাজারে টাকা পর্যন্ত জরিমানা দিতে হবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে, সরকার কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিচ্ছন্নতা তথা পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের জন্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলকভাবে প্রতি বছর ভালো কাজের স্বীকৃতি দিতে পদক্ষেপ নেবে। পরিবেশ, বন মন্ত্রণালয় ভালো কাজের স্বীকৃতি দেয়ার শর্তাবলী নির্ধারণসহ এ সংক্রান্ত একটি পৃথক নির্দেশিকা প্রণয়ন করবে।
আরএমএম/এমএআর/এমএস