প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েছে। গত ১০ দিনে ঢাবির ৩ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। শুধু তাই নয়, চলতি বছরে ৯ মাসে (মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত) ৮ শিক্ষার্থী এ আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের এমন আত্মহননে উদ্বিগ্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
Advertisement
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষণ্নতা যখন চেপে ধরে তখন মানুষ মুক্তি চায়। কিন্তু মুক্তি পেতে গিয়ে তারা যে জীবনকে ধ্বংস করে দিচ্ছে তা বুঝে না।পরিবার থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধবদের ভূমিকাই এ ধরনের আত্মবিধ্বংসী পথ থেকে হতাশাগ্রস্থ ব্যক্তিকে রক্ষা করতে পারে। আপন মানুষের সান্নিধ্যই আত্মহত্যা রুখতে পারে।
আত্মহত্যাকারী ঢাবির ৮ শিক্ষার্থীর মধ্যে চাকরি না পাওয়ার হতাশা, একাডেমিক চাপ, পারিবারিক অভাব ও প্রেমে ব্যর্থ হওয়ায় মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা রয়েছে।
সর্বশেষ গতকাল (২১ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার) রাজধানীর অদূরে টঙ্গীতে নিজ বাসায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হুজাইফা রশিদ। পরিবারের ধারণা, একাডেমিক হতাশা থেকে সে আত্মহত্যা করতে পারেন।
Advertisement
গত ১৬ নভেম্বর (শুক্রবার) যশোরে গ্রামের বাড়িতে আত্মহত্যা করেন ঢাবির ২০১০-১১ সেশনের প্রাক্তন ছাত্রী মেহের নিগার দানি। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে বন্ধুদের এড়িয়ে চলতেন। বন্ধুদের ভাষ্যমতে, দানি একা একা ও বিষণ্নতার মধ্যে থাকতেন।
প্রেম ঘটিত কারণে চলতি মাসের ১২ তারিখে (নভেম্বর) রাজধানীর ফার্মগেটে একটি হোস্টেলে ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করেন বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ফাহমিদা রেজা সিলভি।
এছাড়া চলতি বছরের শুরুতে ১৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর হাজারীবাগের নির্মাণাধীন একটি ভবনের ছাদ থেকে নীচে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন স্যার এ এফ রহমান হলের আবাসিক ছাত্র ফিন্যান্স বিভাগের তরুণ হোসেন। তার বন্ধুরা জানান, বিভাগের পড়ার চাপ ও সাদামাটা জীবনযাপনের জন্য সবার নিগ্রহ তাকে হতাশাগ্রস্ত করে। শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেই জীবনের ইতি টানেন।
গত ৩১ মার্চ বিজনেস ফ্যাকাল্টির এমবিএ ভবনের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন সান্ধ্য কোর্সের শিক্ষার্থী তানভীর রহমান। দীর্ঘদিন ধরে চাকরি না পাওয়ার হতাশা থেকে তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন বলে তার সহপাঠী ও পরিবারের সদস্যরা জানান।
Advertisement
১৫ আগস্ট রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় আত্মহত্যা করেন সংগীত বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মুশফিক মাহবুব। আত্মহত্যার আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি দেশের শিক্ষা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেয়া স্ট্যাটাসটি ছিল- ‘আই ওয়ান্ট ফ্রিডম অ্যাজ এ বাংলাদেশি ইভেন ইফ ইট কিলস মি ফর দ্য রিজন’।
এ ছাড়া ১০ সেপ্টেম্বরে রাজধানীর রামপুরায় নিজ বাসায় ফ্যানের সঙ্গে ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস দেন আফিয়া সারিকা নামের এক ছাত্রী। যিনি মার্কেটিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত ছিলেন। নিহতের পরিবারের ধারণা, প্রেম সংক্রান্ত কোনো কারণে সারিকা আত্মহত্যা করতে পারেন।
গত ১৫ অক্টোবর গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র জাকির হোসেন। পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারেন বলে ধারণা তার বন্ধুদের।
এদিকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হঠাৎ আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় এক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। বৃহস্পতিবার আয়োজিত আত্মহত্যা প্রতিরোধে করণীয় শীর্ষক -এ সেমিনারে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন বিশেষজ্ঞরা।
সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, কোনো শিক্ষার্থীর মৃত্যুই স্বস্তিদায়ক নয়। শিক্ষক হিসেবে এটি আমাদের জন্য অনেক বেশি পীড়াদায়ক। এটা তো (আত্মহত্যা) কোনো সমাধান নয় -এ জিনিসটা ছাত্র-ছাত্রীদের বুঝতে হবে। শিক্ষার্থীর পরিবার, বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার, বন্ধু-বান্ধব সবার আন্তরিক প্রচেষ্টাই পারে এ থেকে মুক্তি দিতে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শদান দফতরের পরিচালক ও অ্যাডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মেহজাবিন হক বলেন, আমরা সবাই সচেতন হলে ঘটনাগুলো কমানো সম্ভব। কারো যদি আত্মহত্যা করার মত অবস্থা হয়, তাহলে তার বন্ধুদের উচিত গায়ে হাত রাখা এবং তাকে বুঝানো যে পৃথিবীতে তোমার বেঁচে থাকা কতটা দরকার।
তিনি আরও বলেন, আত্মহত্যাই একমাত্র সমাধান নয়। বরং সেটি নিজেকে একেবারেই শেষ করে ফেলে। তাই বিষণ্নতা থেকে উত্তরণের পথ বের করতে হবে এবং তাদের সেদিকে পরিচালিত করতে হবে। বিশেষ করে পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধব ও শিক্ষকদের এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
এমএইচ/আরএস/এমএস