শিক্ষা

নির্দেশ না মেনে এসএসসির ফরম পূরণে বাড়তি টাকা আদায়

মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকে (এসএসসি) পরীক্ষার ফরম পূরণ কার্যক্রম শেষ হয়েছে। তবে এ ফরম পূরণের অর্থ আদায়ে দেখা দিয়েছে নৈরাজ্য। শিক্ষা বোর্ড, মন্ত্রণালয় আর আদালতের নির্দেশ অমান্য করেই রাজধানীর বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফরম পূরণে কয়েক গুণ বেশি অর্থ আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

Advertisement

সুনির্দিষ্ট প্রমাণের অভাবে এ ধরনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না বলে দাবি বোর্ডের। তবে অভিযোগের প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন শিক্ষা সচিব।

বোর্ড নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত অর্থ আদায় না করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে একাধিকবার সতর্ক করে দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডগুলো। কিন্তু রাজধানীর বেশিরভাগ স্কুল নানা অজুহাতে ফরম পূরণের নামে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে বোর্ড নির্ধারিত ফির চেয়ে দুই থেকে চারগুণ টাকা।

খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে, এসএসসি পরীক্ষার ফরম পুরণে রাজধানীর বাড্ডা আলাতুন নেছা স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা উইলস লিটলস স্কুল অ্যান্ড কলেজে সাড়ে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা, উদয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা, যাত্রাবাড়ীর একে স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা, মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা, আগারগাঁও তালতলা সরকারি কলোনি উচ্চ বিদ্যালয় ও মহিলা কলেজে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা, বশির উদ্দিন আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে সাড়ে ৩ থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে। ফরম পূরণের সঙ্গে মডেল টেস্ট ও কোচিং ফি বাবদ বাড়তি অর্থ আদায় করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা।

Advertisement

জানা গেছে, ২০১৯ শিক্ষাবর্ষের এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক ফরমপূরণ ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বাইরে কোনো অর্থ আদায় করা যাবে বলেও নির্দেশনা দেয়া হয়। সে হিসাবে এবার বিজ্ঞান বিভাগের জন্য (৪র্থ বিষয়সহ) বোর্ড ফি ১ হাজার ৩৮৫ টাকা ও কেন্দ্র ফি ৪১৫ টাকাসহ মোট ১ হাজার ৮০০ টাকা, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে (৪র্থ বিষয়সহ) বোর্ড ফি ১ হাজার ২৯৫ টাকা ও কেন্দ্র ফি ৩৮৫ টাকাসহ মোট ১ হাজার ৬৮০ টাকা এবং মানবিক বিভাগের জন্য (৪র্থ বিষয়সহ) বোর্ড ফি ১ হাজার ২৯৫ টাকা কেন্দ্র ফি ৩৮৫ টাকাসহ মোট ১ হাজার ৬৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

গত ৭ নভেম্বর থেকে শুরু হয় এসএসসি পরীক্ষার ফরম পুরণ কার্যক্রম। জরিমানা ছাড়া নির্ধারিত ফি পরিশোধ করে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলে। এ ছাড়াও ২১ নভেম্বর পর্যন্ত ১০০ টাকা জরিমানাসহ এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ শেষ হয়েছে।

অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে ফরম পূরণ করা উইল লিটলস ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থী জাগো নিউজকে বলে, ‘বিজ্ঞান বিভাগের জন্য এক হাজার ৮০০ টাকা ধরা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের কাছে যদি ছয় হাজার টাকার কথা বলে তাহলে এ টাকা আমরা দেব কীভাবে? স্যারদের কাছে বললে তাদের কিছু করার নেই বলে জানিয়ে দেন। বাড়তি অর্থ পরিশোধ না করলে ফরম পূরণ করতে দেয়া হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয়েছে।’

বাড্ডা আলাতুন নেছা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) শামছুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাড়তি অর্থ নয়, মডেল টেস্ট পরীক্ষার অর্থ নেয়া হয়েছে। কেউ যদি মডেল টেস্ট দিতে না চায় তবে তার কাছে বাড়তি অর্থ নেয়া হয়নি।’

Advertisement

তবে এ স্কুলের বাণিজ্য বিভাগের এক ছাত্র অভিযোগ করেন, বাণিজ্য বিভাগের জন্য শিক্ষা বোর্ড থেকে ১ হাজার ৬৮০ টাকা ফরম পূরণে ধার্য করা হলেও সাড়ে ৪ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে। মডেল টেস্ট পরীক্ষার কথা বলে এ অর্থ নেয়া হয়েছে। বাড়তি অর্থ ছাড়া ফরম পূরণ করানো হয়নি। তাই বাড়তি টাকা দিতে হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

অজুহাত দেখিয়ে উইল লিটলস ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আবুল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘অতিরিক্ত অর্থ নেয়া হচ্ছে না, অভিভাকদের অনুরোধে ফরম পূরণের সঙ্গে মডেল টেস্ট পরীক্ষার ফি নেয়া হয়েছে। এ বাবদ প্রতিটি শিক্ষার্থীর কাছে অতিরিক্ত ৪ হাজার টাকা ধার্য করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এসএসসি পাবলিক পরীক্ষার আগে পরীক্ষার্থীদের মডেল টেস্ট নেয়া হবে। অভিভাবকদের অনুরোধে বাড়তি অর্থ নেয়া হয়েছে। ফরম পূরণে কোন ধরনের বাড়তি অর্থ নেয়া হয়নি। ’

আগারগাঁও তালতলা সরকারি কলোনি উচ্চ বিদ্যালয় ও মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ হিমাদ্রী শেখর পাল অতিরিক্ত এ অর্থ আদায়ের যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলেন, ‘আপনাদের কাছে বাড়তি মনে হবে কিন্তু আমরা যে পরিশ্রম করেছি, এখানে আমাদের বাড়তি সময় দিতে হচ্ছে। এটা দেখতে হবে তো…। আমাদের যে লম্বা বন্ধ থাকে সেই বন্ধের মধ্যেও আমরা ক্লাস নেই। শিক্ষকরা এবং কমিটি বসে যৌথভাবেই এটা নির্ধারণ করা হয়েছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, ‘এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের ঘটনা মেনে নেয়া হবে না। যারা এ ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন অজুহাতে ফরম পূরণে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত টাকা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি ও এমপিও বাতিল করা হবে। নেয়া হবে আইনগত ব্যবস্থাও।’

এদিকে এসএসসির ফরম পূরণে অতিরিক্ত অর্থ আদায়কারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতোমধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে দুদক অভিযানও চালিয়েছে বলে জানা গেছে।

জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের পক্ষে সব জায়গায় যাওয়া সম্ভব হয় না। আমরা মনিটরিং করি না, তা না। প্রামাণ-কাগজপত্র দিয়ে আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ দেয়নি। আমরা অভিযোগকারীর নাম প্রকাশ করব না এবং অভিযোগ সঠিক হলে কঠোর শাস্তির বিধান আছে, সেটা আমরা প্রতিপালন করব।’

তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা সে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খতিয়ে দেখছি। প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত অর্থ আদায় না করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া হয়েছে কঠোর নির্দেশনা, আছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আদেশও। এতসব আদেশ আর নিষেধের বেড়াজাল পেরিয়ে বিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতিবছরই নানা অজুহাতে নেয়া হচ্ছে বাড়তি ফি। যার কারণ হিসেবে প্রশাসনের নজরদারির অভাব এবং অবহেলাকেই দায়ী করছেন ভুক্তভোগীরা।

এমএইচএম/এনডিএস/জেআইএম