আন্তর্জাতিক

মেয়ের জন্য বাবা ভাড়া করেছেন যে মা

মেগুমি একদম বাচ্চা ছিল যখন তার মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়। তার বাবা জীবন থেকে অদৃশ্য হয়ে যান। কিন্তু অনেক বছর পর তার মা তাকে জানান যে মেগুমির বাবা আবার যোগাযোগ করতে চান।

Advertisement

এরপর থেকে মেগুমি ইয়ামাদাকে নিয়মিত দেখতে থাকেন। সে ভেবেছিল ইয়ামাদা তার বাবা আর সেটাই বুঝি তার আসল নাম। কিন্তু পুরো ব্যপারটাই ছিল আসলে বানানো। মেগুমির মা আসাকো বলেন, ছোট থেকেই ওর প্রশ্ন ছিল বাবা কোথায়। ও যেটা জানত তা হলো, ওর জন্মের পরই ওর বাবা চলে গিয়েছিল, আর সেজন্য মেগুমি নিজেকেই দায়ী করত।

অনেক বছর এটা কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু মেগুমির বয়স ১০ বছর যখন হলো, তখন প্রথম আসাকো মেয়ের আচরণে পরিবর্তন দেখতে পান। ‘আমার সঙ্গে মেয়ে প্রায় কথাই বলত না। ও খুব শান্ত হয়ে গিয়েছিল, আর কোন কিছুতে আগ্রহ ছিল না তার।’

আরও পড়ুন : বিমান ধরতে রানওয়েতে দৌড়

Advertisement

আমার অনেক সময় লেগেছিল বুঝতে যে স্কুলে সে ঝামেলায় পড়ছে রোজ। আসাকো ক্রমে বুঝতে পারলেন, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের জন্য মেগুমি কেবল নিজেকেই দায়ী ভাবছে না। বাবা নেই বলে সহপাঠীরা তার সঙ্গে মিশত না, জাপানে সিঙ্গেল প্যারেন্ট বা একলা মা কিংবা বাবার সন্তানদের সমাজ ভালো চোখে দেখে না।

ক্রমে মেগুমি এত অসুখী হয়ে পড়ছিল, সে স্কুলে যেতে চাইত না। সে আমার একমাত্র সন্তান আর তাকে এত বিষণ্ণ দেখে তার বুকটা ভেঙ্গে যেত। বিষয়টি নিয়ে মেয়ের স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শ করে কোন সমাধান পেলেন না আসাকো। তখন তার মাথায় একটা অন্য বুদ্ধি আসলো। ‘আমার কেবল মনে হচ্ছিল, আমি যদি একজন মানুষ বের করতে পারতাম, যিনি দয়ালু আর ভালো মানুষ, যিনি একজন আদর্শ বাবা হবেন, যিনি আমার মেয়েকে আনন্দে রাখতে সাহায্য করবেন।’

আরও পড়ুন : সিআইএর হাতে যুবরাজের নতুন কল রেকর্ড : ‘খাশোগির কণ্ঠ থামিয়ে দাও’

আসাকো পেলেন সমাধান

Advertisement

আত্মীয়দের কাছে আসাকো শুনেছিলেন, জাপানে আত্মীয় ভাড়া করার এজেন্সি আছে। যারা চুক্তিতে একজন অভিনেতাকে পাঠায় যিনি কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে যান কিংবা ডেটিংয়ে সঙ্গ দিতে যান কোন নিঃসঙ্গ মানুষকে। আসাকো এক এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে চান, তারা একজন নকল বাবা পাঠাতে পারবে কিনা।

পাঁচজন আগ্রহী প্রার্থীর অডিশন নেবার পর তাকাশি নামে একজনকে বেছে নেন আসাকো। ‘তার সঙ্গে কথা বলা বেশ সহজ মনে হচ্ছিল আমার। উনি বেশ দয়ালু আর মিষ্টি মানুষ, ফলে আমি আমার মনের বিবেচনার ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিলাম।’

তাকাশি একটা রেন্টাল এজেন্সি চালান, যেখানে ২০ জন মানুষ নিয়মিত কাজ করেন, আর বিভিন্ন বয়সের এক হাজারের ওপর নারী-পুরুষ ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেন। তারা যেকোনো ধরণের পরিস্থিতিতে, যেকোনো নাম এবং বেশ ধারণ করে চাহিদামত চরিত্রে অভিনয় করেন। তাদের প্রায় সময়ই মিথ্যা কথা বলতে হয়, কিন্তু সেটা কোনোভাবেই আইন ভঙ্গ না করে করেন তারা।

বাবা চরিত্রের প্রস্তুতি

তাকাশি নিজেও একজন অভিনেতা, বিভিন্ন সময় তিনি ছেলেবন্ধু, ব্যবসায়ী, বন্ধু এবং বাবার চরিত্রে ভাড়ায় অভিনয় করেছেন। এমনকি পাঁচটি অনুষ্ঠানে বর পর্যন্ত সেজেছেন তিনি। এবার তিনি হলিউডের দুটি সিনেমা দেখে বাবার চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তুতি নিয়েছেন। একটি অস্কারজয়ী সিনেমা লিটল মিস সানসাইন, যেখানে এক অকার্যকর পরিবার একসঙ্গে বেরাতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে নতুন করে বন্ধন তৈরি হয়।

আরও পড়ুন : ধূমপান নিষিদ্ধ সেই কফি হাউসে

আরেকটি দ্য ডিসেন্ডেন্টস, এই সিনেমায় জর্জ ক্লুনি একজন উদাসীন বাবা চরিত্রে অভিনয় করেন, আকস্মিক স্ত্রী বিয়োগের পর হঠাৎ সন্তান পরিপালনের পুরো দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়ে। ‘এসব সিনেমা দেখে আমি সেখানে ব্যবহৃত লাইন এবং বিভিন্ন শব্দবন্ধ মুখস্থ করে ফেলি। ভিন্ন ভিন্ন পরিবার কীভাবে কথা বলে বা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে, একজন নির্দিষ্ট বাবা বা স্বামী হবার জন্য কী প্রয়োজন সেগুলো খেয়াল করতে থাকি।’

সিনেমা দুইটি আমাকে ভিন্ন ভিন্ন পরিবার এবং সম্পর্ককে বুঝতে সাহায্য করেছে- তাকাশি বলেন। আসাকো তাকাশির সঙ্গে কয়েকবার দেখা করেন, তিনি কেমন বাবার অভিনয় প্রত্যাশা করছেন সেটি বুঝিয়ে বলেছেন। ‘আমার চাওয়া ছিল খুব সহজ। প্রথমত, আমি চেয়েছিলাম এতদিন মেগুমির জীবনে অনুপস্থিত থাকার জন্য তার বাবা তার কাছে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করবে। আর মেয়ে যা যা বলতে চায় বাবাকে, সব সে মন দিয়ে শুনবে।’

এরপর আসাকো মেয়েকে একদিন বললেন, যে তার বাবা আবার বিয়ে করেছেন এবং তার সংসার আছে। কিন্তু তিনি মেয়েকে দেখতে চান। তার বাবা একজন ‘অভিনেতা’ বলে মেয়েকে জানান আসাকো। মেগুমি মায়ের কথা শুনে কষ্ট পেলেও রাজি হলো বাবার সঙ্গে দেখা করতে।

আর এর মাধ্যমেই প্রায় ১০ বছর আগে তাকাশির জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ চরিত্রে রূপদান শুরু হলো। আর তিনি তাকাশি থেকে ইয়ামাদা হয়ে যান।

আরও পড়ুন : শ্রমিকের ছেলে থেকে ৭০০ কোটি ডলারের মালিক

মেগুমির জীবনে পরিবর্তন

প্রথম দেখায় আগে দেখতে আসেনি কেন বলে বাবার কাছে জবাব চায় মেগুমি। তাকাশি বুঝতে পারছিলেন তার মেয়ের কষ্ট। এরপর থেকে তাকাশি মাসে কয়েকবার করে মেগুমি আর তার মায়ের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময়ে তারা বাইরে কোথাও বেরাতে যান কিংবা সিনেমা দেখতে যান একসঙ্গে এবং জন্মদিনে একসঙ্গে সময় কাটাতে থাকেন।

খুব অল্প সময়ের মধ্যে মেয়ের আচরণে পরিবর্তন দেখতে পান আসাকো। ‘আমি দেখলাম মেগুমি আগের মত আর বিষণ্ণ না, কথা বলা শুরু করেছে সে। আর সে এত প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠেছে! সে হাসতে আর মানুষের সঙ্গে মিশতে শুরু করে। আমার তখন মনে হয় আমার কষ্ট সার্থক।’ এক প্যারেন্টস ডেতে বাবা-মাকে একসঙ্গে দেখে মেগুমি এত খুশী হয়েছিল, তার খুশী দেখে আসাকো কেঁদে ফেলেছিলেন।

বাবা সাজার ফি

তাকাশির সার্ভিস মোটেও সস্তা নয়। প্রতিবার যখনই তাকাশি মেগুমির সঙ্গে দেখা করতে আসে, আসাকোকে দশ হাজার ইয়েন মানে ৯০ মার্কিন ডলার করে দিতে হয়। যদিও আসাকো ভালো চাকরি করেন, তবু তাকে এই পয়সাটা প্রতিমাসে জমাতে হয়।

আরও পড়ুন : ৬৫ দিন সূর্য উঠবে না আলাস্কার এক শহরে

কিন্তু যখনি তিনি ভাবেন তার মেয়ে আগে কত অসুখী ছিল, তখন পয়সা ঠিক জায়গায় যথার্থভাবে খরচ করা হচ্ছে বলে তার মনে হয়। তাকাশিও মেগুমির মধ্যে পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন- বিষণ্ণ, চুপচাপ, দ্বিধাগ্রস্ত বাচ্চা মেয়েটি থেকে মেগুমি এখন সুখী আর আত্মবিশ্বাসী তরুণী হয়ে উঠছে।

কিন্তু বিষয়টিকে কীভাবে বিচার করেন তাকাশি? ‘এ কাজের জন্য একেকবার নিজের ব্যক্তিত্ব আর পরিচয় বদলে ফেলা জরুরী। কিন্তু আমি মিথ্যা বলবো যদি আমি বলি যে আমার কোন অসুবিধা হয় না একটা ছোট্ট বাচ্চাকে মিথ্যা করে বলতে যে আমি তাকে ভালোবাসি।

কিন্তু আমার কাছে এটা একটা কাজ, আমাকে সেটা রোজ করতে হয় এবং নিজের পরিচয় সেভাবে রাখতে হয়। আসাকোও বোঝেন যে সবাই তার সিদ্ধান্তকে সমর্থন নাও করতে পারে। কিন্তু গত প্রায় দশ বছরে আসাকো তার ভাড়া করা স্বামীর ওপর মানসিকভাবে অনেকটাই নির্ভর করতে শুরু করেছেন।

আমরা একসঙ্গে সময় কাটাই, আমাদের জীবনে সে অনেক বছর ধরেই তো আছে, এখন আমি তাকে বিয়ে করতে চাই, আর সত্যিকারের একটা পরিবার হয়ে উঠতে চাই। তাকাশি তাতে রাজি নয়। এটা তার কাছে কেবলই একটি চাকরি।

আরও পড়ুন : কলকাতার প্রথম মুসলিম মেয়র হচ্ছেন ফিরহাদ হাকিম

কিন্তু তারপরেও আসাকো এই বন্দোবস্ত কখনো শেষ করতে চান না। কিন্তু যদি মেগুমি জেনে যায়? সেই সম্ভাবনার কথা আসাকো কখনো ভাবেননি। ডিভোর্সের পর আর কোনদিনই তার সাবেক স্বামীর সঙ্গে আসাকোর যোগাযোগ হয়নি। ফলে হঠাৎ করে মেগুমির বাবার হাজির হবার কোন সম্ভাবনাই দেখেন না আসাকো। ‘কিন্তু সে হঠাৎ কোনদিন হাজির হলেও আমার ধারণা মেগুমি ইয়ামাদাকেই বাবা হিসেবে বেছে নেবে।’

মিথ্যার ডালপালা বাড়তে থাকবে

তাকাশি জানে এই মিথ্যার ডালপালা বাড়তে থাকবে। মেগুমি বিয়ে করলে তার স্বামী ভাববে তাকাশি তার শ্বশুর, তাদের সন্তানেরা ভাববে তাকাশি তাদের নানা। ক্রমে ডালপালা ছড়াতে থাকবে এই মিথ্যা। কিন্তু আসাকো এবং তাকাশি দু’জনই প্রায়ই খুব শংকা নিয়ে ভাবেন মেগুমি যেদিন জেনে যাবে এই মিথ্যার বেসাতি, সেদিন কী কষ্টই না পাবে বাচ্চা মেয়েটা!

আসাকো বলছেন, আমার অবস্থা পৃথিবীতে প্রথম না, আরো কত মা আরো হয়ত বড় বড় মিথ্যার ঝুঁকি নিয়েছেন, নিজের সন্তানকে একটু খুশী করার জন্য! হয়তো মেগুমি সেটা বুঝতে পারবে। বিবিসি বাংলা।

এসআইএস/পিআর