আন্তর্জাতিক

সাপের দংশনের পর ডায়েরি লেখা শুরু করেছিলেন তিনি, অতঃপর...

সাপ। নামটি শুনলেই যেন শরীর কিলবিল কিলবিল করে ওঠে। সরীসৃপ এই প্রাণিটিকে ভয় পান না এমন লোক বোধহয় খুব কমই আছেন। আর সাপটি যদি হয় বিষাক্ত তাহলে তো কথায় নেই। সাধারণত দেখা যায়, সাপ দংশন করলে দ্রুত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দেয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। তবে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম এমন এক ব্যক্তির সন্ধান দিয়েছে যাকে বিষাক্ত সাপ দংশন করলে চিকিৎসা না নিয়ে উল্টো ডায়েরি লেখা শুরু করেছিলেন তিনি।

Advertisement

১৯৫৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ঘটনা। শিকাগোর লিঙ্কন পার্ক চিড়িয়াখানার পরিচালক শহরের ফিল্ড মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে একটি সাপ পাঠিয়েছিলেন গবেষণার জন্য। ৭৬ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের সরীসৃপটি পরীক্ষা করার কথা কার্ল প্যাটারসন স্মিথ নামে একজন সাপ গবেষকের। ওই মিউজিয়ামে তিনি দীর্ঘ ৩৩ বছর কাজ করেছেন।

‘কোরাল স্নেক’ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ স্মিথ ১৯৫৫ সালে মিউজিয়ামের মুখ্য তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে অবসরে যান এবং ততদিনে তিনি সরীসৃপ বিষয়ক বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংগ্রহশালাগুলোর একটি গড়ে তোলেন।

সাপটির মাথা উজ্জ্বল রঙের নকশায় ঢাকা ছিল এবং এর মাথার আকৃতি ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার গেছো সাপের মতো, যেগুলো বুমস্ল্যাং নামেও পরিচিত। সাপটিকে পাওয়ার পর তিনি যেটি করেছিলেন তা অবাক করার মতো।

Advertisement

তিনি সাপটিকে আরও নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করবার জন্য নিজের কাছাকাছি তুলে ধরেন। সঙ্গে সঙ্গে সাপটি তাকে আক্রমণ করে এবং তার বা হাতের বুড়ো আঙ্গুলে দংশন করে, ফলে সেখানে দুটো ছোট রক্ত-চিহ্ন দেখা যায়।

কিন্তু কোনো ধরনের চিকিৎসা সহায়তা না নিয়ে তার বদলে স্মিথ নিজের আঙ্গুল থেকে রক্ত চুষে নিতে শুরু করেন। তার নিজের ওপর বিষের প্রভাব কী হচ্ছে- তা লেখার জন্য তিনি নোটখাতার দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন। ২৪ ঘণ্টার কম সময় পর তিনি মারা যান।

স্মিথ সম্ভবত তার সম-সাময়িক অন্য আরও অনেক সাপ বিশেষজ্ঞের মতই মনে করতেন যে, এই ধরনের বুমস্ল্যাং মানব মৃত্যুর কারণ হওয়ার মতো যথেষ্ট বিষ উৎপাদন করতে পারে না। ফলে তার মৃত্যুর আগের কয়েক ঘণ্টা সময়ে তিনি বাড়িতে ছুটে যান এবং তার শরীরের বিষের কী প্রভাব হচ্ছে সেটি রেকর্ড করেন।

মার্কিন রেডিও পিআরআই-এর ‘সায়েন্স ফ্রাইডে’ নামে একটি অনুষ্ঠানে একটি ভিডিও প্রকাশ করে যার শিরোনাম ডায়েরি অব এ স্নেকবাইট ডেথ অর্থাৎ সাপের দংশনে মৃত্যুর ডায়েরি। যেখানে ডক্টর কার্ল পি স্মিথের জীবনের শেষ কয়েক ঘণ্টার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন।

Advertisement

বুমস্ল্যাং প্রজাতির সাপের দংশনে মানুষের শরীরের রক্ত জমাট বাধতে পারেনা, ফলে দংশিত ব্যক্তির রক্তপাতে মৃত্যু হয়।

তিনি ডায়েরিতে লিখেছেন-বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে সাড়ে ৫টা: প্রচণ্ড গা গুলাচ্ছে কিন্তু বমি হয়নি। শহরতলীর একটি ট্রেনে চেপে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম। বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে সাড়ে ৬টা : প্রচণ্ড ঠাণ্ডা এবং কাঁপুনি দিয়ে ১০১.৭ ডিগ্রি জ্বর। মুখ দিয়ে কফের সঙ্গে রক্ত বেরোতে শুরু করেছে ৫:৩০ মিনিটের দিক থেকে, বেশিরভাগই মাড়ি থেকে।

রাত সাড়ে ৮টা। দুই টুকরো মিল্ক টোস্ট খেলাম। রাত ৯টা থেকে ১২:২০ মিনিট। ভালোই ঘুমালাম। ১২:২০ মিনিটের দিকে প্রস্রাব করলাম, মূলত রক্তই গেল, তবে পরিমাণ অল্প। ৪:৩০ মিনিটের দিকে এক গ্লাস পানি পান করলাম, প্রচণ্ড গা গুলানো এবং বমি বমি ভাব, হজম না হওয়া খাবার পাকস্থলী থেকে বেরিয়ে এলো। এরপর কিছুটা ভালো লাগছিল এবং ভোর সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ঘুমালাম।

স্মিথকে তার মৃত্যুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে চিকিৎসা সহায়তা করার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি যে সমস্ত উপসর্গ তিনি অনুভব করছিলেন সেগুলো যদি না বুঝতে না পারেন সে আশংকায় মেডিকেল হেল্প নেননি তিনি।

চিকিৎসা না নিয়ে নিজের বৈজ্ঞানিক কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে সকালের নাশতার পর চমৎকার নোট লিখেছিলেন এই বিশেষজ্ঞ। ২৬ সেপ্টেম্বর। ভোর ৬:৩০ মিনিট। তাপমাত্রা ৯৮.২. সিরিয়াল এবং টোস্টের সঙ্গে ডিম পোচ, আপেল সস এবং কফি দিয়ে সকালের নাশতা খেলাম। প্রতি তিন ঘন্টায় প্রস্রাব নয়, এক আউন্স করে রক্ত বের হচ্ছে । মুখ এবং নাক দিয়ে রক্ত ঝরেই যাচ্ছে, তবে খুব বেশি নয়।

আর এটিই ছিল স্মিথের লেখা সর্বশেষ কথা। বলছে সায়েন্স ফ্রাইডে। দুপুর দেড়টার দিকে মধ্যাহ্নভোজের পর তিনি বমি করেন এবং স্ত্রীকে ডাকেন। যখন তাকে সহায়তা দেয়া শুরু হলো ততক্ষণে তিনি অচেতন হয়ে হয়ে গেছেন এবং তার শরীরের প্রচণ্ড ঘামে ভিজে গেছে।

ডাক্তার ডাকা হলো এবং তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। বিকেল তিনটার মধ্যে তাকে মৃত ঘোষণা করা। ফুসফুসে রক্তক্ষরণের কারণে তার শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হচ্ছিল। চোখ, ফুসফুস, কিডনি, হৃৎপিণ্ড এবং মস্তিস্কে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের কারণে তার মৃত্যু হয়।

স্মিথ-এর মৃত্যুর পর দুই দশক ধরে চলা নানা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে, বুমস্ল্যাং গোছের সাপ আফ্রিকান অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সাপের অন্যতম যার অত্যন্ত টক্সিক বিষ রয়েছে। এর কামড়ে রক্ত জমাট হওয়ার ক্ষমতা থাকে না ফলে রক্তপাতের শিকার হয়ে মানুষ মারা যায়। এই গেছো সাপ মধ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকা এলাকায় দেখা যায় এবং পূর্ণবয়স্ক একেকটি সাপ ১০০ থেকে ১৬০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। কোনো কোনোটি ১৮৩ সেন্টিমিটারও হয়।

স্মিথ এবং তার সহকর্মীরা কেউই এই সাপটির দংশনকে খুব একটা গুরুতর বলে আমলে নেননি। কারণ বুমস্ল্যাংটি ছোট ছিল এবং দংশিত ব্যক্তি ছিলেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। কিন্তু অন্যরা লিখেছেন স্মিথের জানবার কথা যে, সে সময় বুমস্ল্যাংএর অ্যান্টিভেনম ওষুধ সহজলভ্য ছিল না ।

স্মিথের জীবনের জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ শেষ মুহূর্তগুলোতে তার মনের ভেতর যা-ই চলুক না কেন, নিজের মৃত্যুর কাছাকাছি সময়ে পৌঁছেও পিছু হটেননি তিনি। সায়েন্স ফ্রাইডে অনুষ্ঠানের প্রযোজক টম ম্যাকনামারা সেটা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘অজানা জগতে ঝাঁপ দিয়েছেন’ স্মিথ।

এসআর/জেআইএম