সময় মানুষের সবকিছু বদলে দেয়। মানুষ সময়ের কাছে বড্ড অসহায়। সময়ের পরিবর্তনে কাছের মানুষ দূরে চলে যায় আর আপন হয়ে অজানা অপিরিচত কতশত জন। তবুও মানুষকে বেঁচে থাকতে হয় সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। ভাগ্যের নির্মম পরিোসে নির্মম জীবন যাপন করছেন ৭৬ বছরের এক বৃদ্ধা।
Advertisement
আত্মীয়-স্বজন সবই আছে তার। কিন্তু পাশে কেউ নেই। তাই গত কয়েক বছর ধরে স্টেশনের চত্বর হয়ে গেছে তার বাড়িঘর। পরনে দীর্ঘদিনের না কাচা শাড়ি। পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে এক পা প্রায় অচল। অন্য পা দিয়েই একমুঠো ভাতের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পাততে হচ্ছে তাকে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না।
আরও পড়ুন>> খাশোগির লাশ টুকরো করার ছবি ফাঁস
হাওড়ার বিজয়কৃষ্ণ গার্লস কলেজের কলা বিভাগের স্নাতক ডিগ্রিধারী ওই বৃদ্ধার নাম সবিতা মুখোপাধ্যায়। বাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলায়। একসময় নিজের ঘর-সংসার আর সন্তান সবই ছিল তার। বিয়ে হয়েছিল উচ্চপদস্থ এক সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে। চার ছেলে-মেয়ে নিয়ে বেশ ছিল তাদের সুখের সংসার।
Advertisement
কিন্তু ঘটনাচক্রে এক দিন খুন হন তার স্বামী। মূলত এর পরেই ভাঙন ধরে পরিবারে। কী ভাবে এমন হলো প্রশ্ন করতেই কয়েক মিনিট নীরব থাকার পর কিছু বলার চেষ্টা করতেই বৃদ্ধার ঝাপসা চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন>> টানা ১৪ ঘণ্টা শারীরিক সম্পর্ক!
মাথা নিচু করে ময়লা আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ধরা গলায় তার জীবনের নির্মম গল্প বলা শুরু করলেন। স্বামীর মৃত্যুর পরে সংসারের পাট চুকিয়ে রুজির সন্ধানে হাওড়ায় বাবার বাড়িতে ফিরে আসেন।
সেখান থেকেই চাকরি খোঁজা শুরু করেন। অবশেষে অনেক চেষ্টা করে হাওড়া স্টেশনের শৌচাগার দেখভালের দায়িত্ব পান। বেতন ঠিক হয় মাসিক ছয় হাজার টাকা।
Advertisement
আরও পড়ুন>> এ যেন আরেক রসু খাঁ : দিনে দর্জি, রাতে ভয়ঙ্কর খুনি
এদিকে তার মুখের পানে চেয়ে থাকত আরও চারটি মুখ। তাই সবকিছু সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছিল সবিতাদেবীর পক্ষে। এরই মধ্যে দুই ছেলে ও এক মেয়ে অসুস্থ হয়ে মারা যায়। স্বামী আর তিন সন্তানের মৃত্যুযন্ত্রণা সহ্য করে একমাত্র মেয়েকে নিয়ে তিনি চলে যান হুগলির কোন্নগরে। সেখানেই ঘর ভাড়া করে থাকতে শুরু করেন। নিজে কষ্ট করে রোজগার করে মেয়েকে পড়ালেখা করান।
এক দিন সেই মেয়েরও বিয়ে হয়ে যায়। স্বামীর সঙ্গে মেয়ে চলে যায় গোহাটিতে। এরপর আরও একা হয়ে পড়েন তিনি। তবে সবিতাদেবীর আক্ষেপ, বিয়ের পরে মেয়ে তার সঙ্গে একবারের জন্যও যোগাযোগ করেননি।
আশি ছুঁই ছুঁই বৃদ্ধা বলে চলেন, ‘চাকরি করে যে সামান্য বেতন পেতাম, তাই দিয়ে কোন্নগরের ঘর ভাড়া দিয়ে আমার একার কোনোমতে দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু রেলস্টেশন সাজানোর সময়ে শৌচাগার ভাঙা পড়লে আমার সেই কাজও চলে যায়।’
আরও পড়ুন>> ‘ট্রাম্প টয়লেট ব্রাশ’ কেনার হিড়িক যুক্তরাষ্ট্রে
ভাড়া বাকি পড়ে থাকায় বাড়িতে ফেরার পথও এক সময় বন্ধ হয়ে যায়। উপায় না পেয়ে হাওড়া স্টেশনেই আশ্রয় নেন। কিছু দিন স্টেশনে নিমের দাঁতন বিক্রি করেন। কিন্তু পুঁজির অভাবে তাও বন্ধ হয়ে যায় েএক সময়। এরপর পক্ষাঘাতে অসুস্থ হওয়ায় হাঁটাচলাও বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকে ভিক্ষাবৃত্তিই তার জীবন যাপনের একমাত্র উপায় অবলম্বন।
এত লড়াইয়ের পরেও ফের বাস্তুহারা হওয়ার আশঙ্কা করছেন তিনি। বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলার সময়ে পাশে দাঁড়ানো এক যুবক বলেন, ‘আরপিএফ আর রেলওয়ে পুলিশের (জিআরপি) ভয় তো আছেই। তবে আমরা সবাই তার পাশে আছি। মাকে কিছুতেই এখানে থেকে সরাতে দেব না।’ স্টেশনের ফেরিওয়ালা ও রেলওয়ের সাদা পোশাকের পুলিশকর্মীরাই এখন তার ছেলে-মেয়ের মতো। তাদের সম্পর্কে জানতে চাইলে করুণ হেসে বললেন, ‘ওরা আমাকে মা বলে ডাকে। ওদের দেখে আমি আমার কষ্ট ভুলে থাকি।’
আরও পড়ুন>> বিয়ের পরপরই পরীক্ষার হলে দে দৌড় কনের
হাওড়া রেলপুলিশ সুপার নীলাদ্রি চক্রবর্তী বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা নজরে এলে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। প্রয়োজনে আশ্রয়হীনকে কোনও হোমে পাঠানো হয় কিং-বা পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলে আমরা ঠিক করব কী করতে পারি তার জন্য।’
সূত্র: আনন্দবাজার
এসএ/এমএস