গানের আঙিনায় ক্ষণজন্মা কিংবদন্তি তিনি। ‘আমি তোমাকেই বলে দেবো’, ‘হৃদয়ের দাবি’, ‘আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিলো চাঁদ’, ‘রিকশা’ ইত্যাদি গানে তার ব্যতিক্রমী সব কথা ছুঁয়ে গেছে কোটি মানুষের প্রাণ। তার সুর ও গায়কীর সঙ্গে শ্রোতাদের ঘটেছে অভূতপূর্ব সংগীতের মেলবন্ধন। তিনি গীতিকবি, সুরকার, গায়ক সঞ্জীব চৌধুরী।
Advertisement
বড় অকালেই চলে যাওয়া এই বোহেমিয়ান গান পুরুষের ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর রাত ১২টা ১০ মিনিটে তিনি মারা যান। তার সৃষ্ট অজস্র গান এখনও নবীনদের অনুপ্রেরণা বলে মনে করেন এ প্রজন্মের অনেক সংগীতশিল্পী।
সময়ের স্রোতে অনেক কিছু পুরনো হলেও ফুরায়নি সঞ্জীব চৌধুরীর গানের আবেদন। তার গান এখনো নতুন প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে। এখনো লোকমুখে ফিরে ফিরে বাজে তার গান। নানা অনুষ্ঠান-কনসার্টে নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের মুখে শোনা যায় সঞ্জীবের গাওয়া ‘বায়োস্কোপের নেশায় আমায় ছাড়ে না’, ‘ভাঁজ খোলো আনন্দ দেখাও’ ইত্যাদি সব শিরোনামের গানগুলো।
গানের মানুষ হিসেবেই সমাদৃত হলেও দারুণ মেধাবী সঞ্জীব চৌধুরী পেশায় ছিলেন সাংবাদিক। হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার মাকালকান্দি গ্রামে ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। তবে তার পৈতৃক নিবাস বিশ্বনাথ উপজেলার দাশঘর গ্রামে। সেখানকার স্থানীয় শরৎ রায় চৌধুরী ছিলেন সঞ্জীব চৌধুরীর দাদা। তিনি ছিলেন গোপাল চৌধুরী ও প্রবাসিনী চৌধুরী দম্পতির সপ্তম সন্তান। তিনি ছিলেন খুব মেধাবী ছাত্র।
Advertisement
পঞ্চম শ্রেণি ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছিলেন। স্থানীয় প্রাথমিক শিক্ষালয় শেষে তিনি হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি ১৯৭৮ সালে এসএসসি পাস করে দারুণ রেজাল্ট দিয়ে সবাইকে চমকে দেন। পরে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন ১৯৮০ সালে। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করা সঞ্জীব চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে চান্স পান মেধা তালিকায় নাম উঠিয়ে। কিন্তু গণিতের প্রতি তার কোনো ভালো লাগা ছিলো না।
তাই বিষয় পরিবর্তন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে আশির দশকে। ছাত্র থাকাকালীন বাম ঘরানার ছাত্র রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৭৯-৮০ সালে তিনি ঢাকা কলেজের বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের সংস্কৃতি সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন সঞ্জীব চৌধুরী।
শিক্ষার পর্ব শেষ করেই দৈনিক উত্তরণ পত্রিকায় যোগ দিয়ে সাংবাদিক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি দৈনিক আজকের কাগজ, দৈনিক ভোরের কাগজ ও যায়যায়দিনসহ বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করেছেন।
‘শঙ্খচিল’ নামের দলে সংগীতচর্চা শুরু হয় তার। তিনি পিংক লয়েড, বব ডিলানের গানে প্রভাবিত। তার গানেও এদের ছায়া পড়েছে। বিশেষ করে ফোক গানের প্রতি ছিলো তার ব্যাপক ভালো লাগা। তার গানগুলো শোনলেই সেটি অনুমান করা যায়। পাশাপাশি নিজের লেখার বাইরে গিয়েও তিনি বেশ কিছু ফোক গান করে সেগুলোকে নতুনভাবে জনপ্রিয়তা দিয়েছিলেন।
Advertisement
১৯৯৬ সালে সংগীতশিল্পী বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গে জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘দলছুট’ গঠন করেন। পরবর্তীতে সঞ্জীব চৌধুরীর কথা ও বাপ্পার সংগীতায়োজন দলটিকে ভিন্ন মাত্রা দেয়। তিনি গিটারসহ আরো নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শি ছিলেন।
তার সুর ও গাওয়া জনপ্রিয় অসংখ্য গান রয়েছে। যার মধ্যে ‘সাদা ময়লা রঙ্গিলা পালে আউলা বাতাস’, ‘চোখ’, ‘তখন ছিল ভীষণ অন্ধকার’, ‘আহ ইয়াসমিন’, ‘রিকশা’, ‘কথা বলব না’, ‘কালা পাখি’, ‘কোথাও বাশিঁ’, ‘দিন সারা দিন’, ‘সমুদ্র সন্তান’, ‘সানগ্লাস’ অন্যতম। এছাড়াও তিনি ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইছে’ ও ‘গাড়ি চলে না’ গান গেয়ে মরমী বাউল সাধক শাহ আব্দলু করিমকে সারা দেশের শ্রোতাদের নতুন জনপ্রিয়তায় তুলে ধরেন।
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক গীতিকারই আজকাল তার দ্বারা প্রভাবিত। গানের পাশাপাশি কবিতাও লিখতেন সঞ্জীব চৌধুরী। দেশের প্রায় সব পত্রিকায়ই তার কবিতা ছাপা হয়েছে। তার একমাত্র কাব্যগ্রন্থের নাম রাশপ্রিন্ট। শুধু কবিতা নয়, সঞ্জীব চৌধুরী বেশ কিছু ছোট গল্প ও নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। সঞ্জীব চৌধুরী অভিনীত একমাত্র নাটক সুখের লাগিয়া। তাই অকপটে বলা যায়, সৃজনশীল ও মেধাবী এ মানুষটির মৃত্যুতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সৃজনশীলতার অনেক শাখা।
সঞ্জীব চৌধুরী ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন খন্দকার আলিমা নাসরিন শিল্পীকে। সেই সংসারে কিংবদন্তি নামে এক কন্যা রয়েছে তার। মাকে নিয়ে সে এখন নানু বাড়িতেই বড় হচ্ছে। চলতি বছরের ১৮ মে ১৪ বছরে পা দিয়েছে কিংবদন্তি।
সঞ্জীব চৌধুরীর প্রয়াণ দিবসে তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে তার প্রিয় মানুষ ও ভক্তরা। ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভক্ত-অনুরাগীরা প্রয়াণ দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলী জানাতে স্মরণ করছেন তাদের প্রিয় সঞ্জীব চৌধুরীকে। কেউ কেউ লিখছেন সঞ্জীব চৌধুরীকে নিয়ে স্মৃতিকথা। কেউ ফেসবুকে নিজের প্রোফাইল কিংবা কভারে ব্যবহার করছেন তার ছবি। কেউ লিখছেন তার গানের কথা- হারিয়ে গেছেন গান পাগল। তবু তার বায়োস্কোপের নেশা আজো ছাড়েনি শ্রোতাদের...!
এলএ/এমএস