মতামত

নির্বাচনী আচরণবিধি ও কয়েকটি খুচরা কৌতূহল

১. জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় সরকার বিরোধী বৃহত্তর ঐক্য গড়ার উদ্যোগের সময় বিকল্পধারার সেকেন্ড ম্যান মাহি বি চৌধুরী বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে শরীকদের জন্য ১৫০ আসন চেয়েছিলেন। চাওয়ার কারণটা খুব যৌক্তিক।

Advertisement

জোটবদ্ধ নির্বাচনে বড় দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেলে ছোট দলগুলোকে আর পাত্তা দেয় না। তাই তিনি ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে কোনো দলই যাতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ না পায়, তা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। উদ্দেশ্য মহৎ, সন্দেহ নেই। কিন্তু বিএনপির সাথে বনেনি বি চৌধুরীদের।

বিকল্পধারার নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট এখন আওয়ামী লীগের মহাজোটের আশ্রয়ে। কিন্তু আমার কৌতূহল হলো, আওয়ামী লীগের সাথে জোট করার সময় কি মাহি বি চৌধুরী শরিকদের জন্য ১৫০ আসনের দাবিটি করতে পেরেছিলেন? নাকি ভুলে গিয়েছিলেন? নাকি সাহসই পাননি? নাকি খাদে পড়া হাতিকেই কেবল লাথি মারা যায়? শুনছি, যুক্তফ্রন্ট এখন গোটা তিনেক আসন পেলেই খুশি।

২. জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার শুরুর দিকে মাহমুদুর রহমান মান্না বেশ কয়েকবার বলেছিলেন, তারা ক্ষমতায় গেলে প্রথম দুই বছর ঐক্য প্রক্রিয়া দেশ চালাবে, পরের তিনবছর চালাবে বিএনপি। যাতে ক্ষমতা হারালেও আওয়ামী লীগকে বিএনপির প্রতিহংসার শিকার হতে না হয়, সে জন্যই এই ২+৩ বছরের হিসাব।

Advertisement

উদ্দেশ্য মহৎ সন্দেহ নেই। কিন্তু মান্না এখন আর সেই হিসাবটি বলেন না। তাহলে ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতায় গেলে কে দেশ চালাবে? ঐক্য প্রক্রিয়ার শুরুর দিকে শোনা যাচ্ছিল, তারা ক্ষমতায় গেলে বি চৌধুরী রাষ্ট্রপতি আর ড. কামাল প্রধানমন্ত্রী হবেন। বি চৌধুরী পল্টি মেরে এখন নৌকায় উঠতে চাইছেন। আর ড. কামাল বলে দিয়েছেন, তিনি নির্বাচনও করবেন না, কোনো পদও নেবেন না। তাহলে ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতায় গেলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন?

৩. আওয়ামী লীগ যখন চারদিন ধানমন্ডি অচল করে মনোনয়ন ফরম বিক্রি করলো, তখন নির্বাচন কমিশন সচিবের কাছে সেটা নির্বাচনী উৎসব মনে হয়েছে। কিন্তু বিএনপি যখন একই কাজ শুরু করলো, তখন টনক নড়লো নির্বাচন কমিশনের। সেই সচিবের কাছেই বিএনপির রাস্তা আটকে মনোনয়ন বিক্রিকে আচরণবিধি লঙ্ঘন মনে হয়েছে। দুই দলের ক্ষেত্রে দুই রকম বিবেচনা, খেলার মাঠটা কি সমতল হলো মাননীয় সচিব মহোদয়?

৪. মনোনয়ন বিক্রির সময় রাস্তা আটকে রাখার ঘটনায় পুলিশের সাথে বিএনপি কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিএনপি কর্মীরা পুলিশের দুটি গাড়িতে আগুন দিয়েছে।। যথারীতি দুইপক্ষ পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছে। মির্জা ফখরুল অভিযোগ করেছেন, ছাত্রলীগ আগুন লাগিয়েছে। ছাত্রলীগ আগুন লাগাতে পারে না, এমন দাবি আমি করছি না।

বরং গত ১০ বছরে হেন কোনো অপকর্ম নেই, যা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা করেনি। কিন্তু বিএনপি অফিসের সামনে হাজার হাজার নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে ছাত্রলীগের কোনো নেতা গিয়ে পুলিশের গাড়িতে আগুন লাগিয়ে ফিরে আসতে পারবে বলে মনে হয় না। ছাত্রলীগে এমন সাহসী কোনো নেতা আছে বলে মনে হয় না।

Advertisement

৫. জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এক মাস নির্বাচন পেছানোর দাবি করলেও নির্বাচন কমিশন পিছিয়েছে এক সপ্তাহ। এই দাবি নিয়ে পরে ঐক্যফ্রন্ট প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে সাক্ষাৎও করে। তখন তাদের দাবি বিবেচনার আশ্বাসও দিয়েছিলেন সিইসি। কিন্তু বিবেচনা শেষে জানিয়ে দিয়েছেন, নির্বাচন আর পেছানো সম্ভব নয়।

নির্বাচন পেছানো না পেছানো নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার। কিন্তু তারা নির্বাচন না পেছানোর যেসব অজুহাত দেখাচ্ছেন, তা অযৌক্তিক। সিইসি বলেছেন, ২৯ জানুয়ারির মধ্যে সংসদ বসতে হবে। কিন্তু সংবিধানে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

সংসদের অধিবেশন ডাকার এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির। সংবিধান অনুযায়ী, মেয়াদপূর্তির পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে বা মেয়াদপূর্তির আগেই সংসদ ভেঙ্গে গেলে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। সে হিসেবে ৩০ অক্টোবর ২০১৮ থেকে ২৮ জানুয়ারি ২০১৯এর মধ্যে যে কোনো দিন নির্বাচন করা সম্ভব।

নির্বাচন না পেছানোর আরেকটি অজুহাত ছিল বিশ্ব ইজতেমা। ইতিমধ্যে ইজতেমা স্থগিত করা হয়েছে। ঐক্যফ্রন্টের দাবি মানতে হবে, নির্বাচন পেছাতে হবে; এমন দাবি আমি করছি না। নির্বাচন কমিশন চাইলে বলতে পারে, আমাদের ইচ্ছা আমরা নির্বাচন পেছাবো না। তাও যেন তারা খোড়া অজুহাত না দেন।

৬. শেখ হাসিনা একাধারে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। গণভবন প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন। প্রধানমন্ত্রী অনেক অনুষ্ঠান করেন এখানে, দলীয় অনুষ্ঠানও হয়। কিন্তু নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর গণভবনে দলীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন কি নির্বাচনী আচরণবিধির আওতায় পড়ে? গত ১৪ নভেম্বর দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন গণভবনেই।

৭. ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি ভুল করেছে, সেটা তারা কখনো প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি। তবে আড়ালে-আবডালে, নিজেদের ঘরোয়া মূল্যায়নে সেটা স্বীকার করেছে। এই প্রথম নিজেদের ভুলটি ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেনের মুখ দিয়ে স্বীকার করিয়ে নিল বিএনপি।

ড. কামাল হোসেন বলেছেন, একবার বয়কট করে অনেক ভুগতে হয়েছে, আর নির্বাচন বয়কট করবো না। দেরিতে হলেও এই শুভবুদ্ধির জন্য ঐক্যফ্রন্ট তথা বিএনপিকে ধন্যবাদ। অত্যাচার, নির্যাতন, মামলা, হামলা যাই হোক লড়াইয়ের মাঠ কখনো ছাড়া যাবে না।

৮. গত ৮ নভেম্বর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। আর নির্বাচনী প্রচার সামগ্রী পোস্টার, ব্যানার সরানোর শেষ দিন ছিল ১৮ নভেম্বর। ৬ মাসেরও বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের রঙিন ব্যানার-পোস্টারে ছেয়ে গেছে গোটা দেশ। কিন্তু যেহেতু জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তথা বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে তফসিল ঘোষণার পর। তাই মাঠে তাদের কোনো প্রচার-প্রচারণা ছিল না।

আমি নিশ্চিত শেষ দিনেও সারাদেশের প্রচার সামগ্রী সরানো হবে না। যদি সরানো হয়ও, তাহলেও তো প্রচারণায় এগিয়ে থাকলো আওয়ামী লীগ। তাহলে প্লেয়িং ফিল্ডটা লেভেল হলো কিভাবে? তফসিল ঘোষণার আগে প্রচার-প্রচারণার ব্যাপারে আচরণবিধি কী বলে?

এইচআর/জেআইএম