আগের দিন ২ উইকেটে ৭৬। ব্রেন্ডন টেলর ৪ এবং শন উইলিয়ামস ২ রান নিয়ে উইকেটে। বারবার-বহুবার সব সময়ই বলা হয়, ক্রিকেটে নিশ্চিত বলে কিছু নেই। অনিশ্চয়তায় ভরা এক খেলা। সেটা যে শুধু সীমিত ওভারের ফরম্যাটে, তা নয়। টেস্ট ক্রিকেটের পরতে পরতেও ওঠা নামার পালা। সেশন ভেদে রং বদলায়। সকালে এক দল চালকের আসনে, তো দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামতেই সে দল ব্যাকফুটে! এমন নজির আছে ভুরি ভুরি।
Advertisement
যত অনিশ্চয়তায় মোড়ানো আর ওঠা নামার পালা থাকুক না কেন, ঢাকা টেস্টে বাংলাদেশের জয় একরকম নিশ্চিতই ছিল। শেষ দিন ৩৬৭ রানের দরকার থাকলেও টেস্ট জিততে জিম্বাবুয়ের প্রয়োজন ছিল মোট ৪৪৩। চতুর্থ ইনিংসে এত বড় টার্গেট ছোঁয়ার রেকর্ড নেই কারো। ফর্মের চুড়ায় থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড কিংবা শ্রীলঙ্কাও আগে কখনো অত রান তাড়া করে জেতেনি।
তাই অতিবড় জিম্বাবুয়ে সমর্থকও জয়ের কথা ভাবেননি। তবে দেখার বিষয় ছিল সিলেটে ১৫১ রানে জেতা মাসাকাদজার দল শেষ অবধি পরাজয় এড়িয়ে ম্যাচ ড্র করতে পারে কি না? জিম্বাবুয়ের জন্য ড্র‘ই হতে পারতো জয়ের সামিল। কারণ প্রথম টেস্ট জিতে থাকার সুবাদে এ ম্যাচ ড্র রাখতে পারলে সিরিজ বিজয়ের কৃতিত্বটা তাদেরই থাকতো।
আর ঘরের মাঠে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মত বিশ্ব শক্তিকে হারানো, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মত বড় দলের সাথে লড়াই করে টেস্ট ড্র রাখা বাংলাদেশ ডুবতো সিরিজ পরাজয়ের লজ্জায়। একটা ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে থাকতো এ সিরিজ। সমালোচকরা আবার নড়ে চড়ে বসতেন। বড় গলায় বলতেন, বাংলাদশ টেস্ট খেলতে পারে না।
Advertisement
আগে যাও পারতো, এখন দিনকে দিন যেন ভুলে যাচ্ছে। তাইতো জিম্বাবুয়ের মত র্যাংকিংয়ে সবার নিচের দলের কাছে টেস্ট সিরিজ হারা। লজ্জা, গ্লানির চেয়ে টেস্ট সামর্থ্য হতো প্রশ্নবিদ্ধ। একটা বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্রেক ঘটতো তখন। সমালোচনার মুখে পড়তে হতো অনেক। উঠতে বসতে কথা শুনতে হতো।
টাইগাররা সীমিত ওভারের ফরম্যাটটাই ভাল পারে। কিন্তু আসল খেলাটা এখনো ভাল মত রপ্ত করতে পারেনি। তারচেয়ে বড় আইসিসির কাছে ভাবমূর্তিটা যেত কমে। আর বড় বড় দলগুলো টেস্ট খেলার ব্যাপারে এমনিতেই উন্নাসিকতা দেখায়। সেটাও যেত বেড়ে। বলতো, আরে যারা নিজ মাটিতে জিম্বাবুয়ের মত দলের কাছে সিরিজ হারে, তাদের সাথে আর কি খেলবো? এতে করে প্রতিষ্ঠিত শক্তিগুলোর সাথে পারষ্পরিক সমঝোতা ও আলাপ আলোচনায় টেস্ট যেত কমে।
মোটকথা জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ পরাজয়টা বাংলাদেশের জন্য রীতিমত বিব্রতকর হয়ে থাকতো। আর সে বিড়ম্বনা ও বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতেই ঢাকা টেস্টে জয়টা ছিল খুব জরুরি। দরকারী। আশার কথা সে কাজটা হয়েছে। বাংলাদেশ বেশ সহজেই জিম্বাবুয়েকে ২১৮ রানের বড় ব্যবধানে জিতে সব প্রতিকুলতা, সমালোচনা ও বিব্রতকর পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে।
এখন আবার সমালোচকদের মুখ বন্ধ হবে। তারা বলবেন নাহ, আসলে দুই অন্যতম চালিকাশক্তি তামিম-সাকিব ছাড়া সিলেটে প্রথম টেস্টে বাংলাদেশ নিজেদের খুঁজে পায়নি। ক্রিকেটাররা প্রকৃত সামর্থ্যের পরিচয় দিতে পারেননি। তবে শেরে বাংলায় দ্বিতীয় টেস্টে মুশফিক, মুমিনুল, অধিনায়ক রিয়াদ, মিরাজ আর তাইজুলরা জানিয়ে দিলেন, শুধু ওয়ানডে নয়, আমরা টেস্টেও খারাপ খেলি না।
Advertisement
ক্রিকেটের এই দীর্ঘ পরিসরের ফরম্যাটেও আমরা পারি। তবে সেটা কালে-ভদ্রে। এই ভাল খেলার মাত্রাটা বাড়াতে হবে। কয়েক সিরিজ খারাপ খেলে হারার পর হঠাৎ আলোর ঝলকানির মত জ্বলে উঠে আবার নিভে গেলে হবে না। টেস্টে আরও ধারাবাহিক হতে হবে। ব্যাটিংটা যেমন-তেমন, বোলিং সামর্থ্য বাড়ানো খুব জরুরি। সম্বল, অবলম্বন ও অস্ত্র সেই স্পিনাররা। পেসাররা টেস্ট মানে এখনো দুর্বল। কমজোরি। অকার্যকর। ব্যাটসম্যানদের ধারাবাহিকতা বৃদ্ধি যেমন খুব জরুরি, একইভাবে পেস বোলিংটা আরও ধারালো করাও যে খুব দরকার। না হয়, দিনকে দিন পিছিয়েই পড়তে হবে।
আজ শেষ দিন গোটা বাংলাদেশ তাকিয়েছিল দুই স্পিনার তাইজুল ইসলাম ও মেহেদি হাসান মিরাজের দিকে। এ দুই স্পিনারও জানতেন, তারাই আশা ভরসার কেন্দ্রবিন্দু। দল জেতাতে, জিম্বাবুইয়ানদের হাত থেকে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে চাই তাদের সময় মত জ্বলে ওঠা। তাই তো প্রথম ইনিংসে তাইজুল ইসলামের পর দ্বিতীয় ইনিংসে বল হাতে জ্বলে উঠেছেন মেহেদি মিরাজ। তার অফস্পিন ভেলকিতে লাঞ্চের ঘণ্টা সোয়া ঘণ্টা পর ২২৪ রানে অলআউট হয়েছে মাসাকাদজার দল। মিরাজ একাই জিম্বাবুয়ে ইনিংসের অর্ধেকটার পতন ঘটিয়েছেন।
ভালই তো প্রথমবার তাইজুল ৫ উইকেট আর এবার মিরাজ ৫ উইকেট। তার মানে দুই স্পিনার নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। দল ও দেশ আমাদের দিকে তাকিয়ে, আমাদের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করতে হবে। এই দৃঢ় প্রত্যয়, সংকল্প এবং দায়িত্ব-কর্তব্যবোধটাও ছিল। আর তাই দু’ইনিংসে তাইজুলের নামের পাশে ৭ উইকেট। আর মিরাজের ৮ উইকেট। তার মানে দুই স্পিনার মিলেই পতন ঘটালেন ১৫ উইকেটের।
মাসল ক্র্যাম্প করায় প্রথম ইনিংসের মত এবারও ব্যাট করতে পারেননি জিম্বাবুয়ে পেসার চাতারা। তার মানে দুই ইনিংসেই জিম্বাবুয়ের সমান ৯ উইকেট করে পতন ঘটেছে। যার ১৫ টি দুই স্পিনার তাইজুল-মিরাজের। একজন রান আউট (এ ইনিংসে চিভাবা রান আউট)।
আর বাকি দুই উইকেট জমা পড়েছে পেসার আরিফুল ও মোস্তাফিজের পকেটে। বাংলাদশ বন্দনার মাঝেও চলে আসছে জিম্বাবুয়ান তারকা উইলোবাজ ব্রেন্ডন টেলরের কথা। উভয় ইনিংসে শতরানের দূর্লভ কৃতিত্ব দেখালেন টেলর। প্রথম ইনিংসে ১১১ রান করা টেলর এবার একাই লড়ে ১০৬ রানে অপরাজিত।
৪৬৭ রানের টার্গেটের পিছু ধেয়ে আগের দিন শেষ সেশনে ২ উইকেটে ৭৬ (ব্রেন্ডন টেইলর ৪*, শন উইলিয়ামস ২*) রান করা জিম্বাবুয়ে আজ পঞ্চম দিনে আর ১৪৮ রানে হারিয়েছে আট উইকেট।
সকালে লাঞ্চের আগে দুই উইকেট হারালেও পঞ্চম উইকেটে মুরকে সাথে নিয়ে প্রথম ইনিংসের মত ঘুরে দাড়ানোর প্রাণপন চেষ্টা করেছেন ব্রেন্ডন টেলর। কিন্তু লাঞ্চের পর মিরাজের বিষাক্ত স্পিন ছোবলে সব প্রতিরোধ শেষ জিম্বাবুয়ের। ব্রেন্ডন টেলর একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন আসা-যাওয়ার পালা। ১৮৬ রানে পঞ্চম উইকেট পতনের পর বাকি ৫ উইকেট পড়লো ৩৮ রানে।
যার তিনটিই নিলেন মিরাজ। আগের দিন অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের শতরানের পর সিজদাহ্ দিয়ে টিমমেট হিসেবে নিজেকে অন্যভাবে মেলে ধরা মিরাজ আজ বল হাতে ৫ উইকেট শিকার করে জানান দিলেন, ‘আমি শুধু সহযোদ্ধা, অধিনায়কের আবেগের সঙ্গীই হই না। পারফরমও করতে জানি। দলের প্রয়োজনে ব্যাট ও বল হাতে জ্বলে ওঠার সামর্থ্যও আছে।’ সেটাই যে খুব দরকার টিম বাংলাদেশ হওয়ার জন্য!
এআরবি/আইএইচএস/জেআইএম