সংলাপের ফল যা-ই হোক আসন্ন নির্বাচন পর্যন্ত এই সংলাপের একটা ইতিবাচক প্রভাব রয়ে যাবে। এই সংলাপের সবচেয়ে ইতিবাচক ফল হচ্ছে বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্ট ইতোমধ্যেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। যদিও বিএনপি আলাদা করে নির্বাচনে আসার ঘোষণা দেয়নি। কিন্তু মির্জা ফখরুলই ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র হিসেবে ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনে আসার ঘোষণা দিয়েছেন। এদিকে ২০ দলের সমন্বয়ক কর্নেল অলিও বিশ দলের নির্বাচনে আসার ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে দেশ এখন পুরোপুরি নির্বাচনমুখী।
Advertisement
সংলাপ থেকে সরকারবিরোধী পক্ষ কোনো কিছু আদায় করতে পারেনি। ঐক্যফ্রন্টের সাত দফার কোনো দফাই সরকার মেনে নেয়নি। এদিকে নির্বাচন কমিশন তার সাংবিধানিক ও আইনি এখতিয়ার প্রয়োগ করে তার সুবিধামতো তফসিল ঘোষণা করেছে। নির্বাচন কমিশন তার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তফসিল ঘোষণা করবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ, নির্বাচন কমিশন সংবিধান ও আইনের অধীন।
সংবিধানানুযায়ী সংসদের মেয়াদ এর প্রথম অধিবেশন থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর পর্যন্ত বহাল থাকে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নতুন একটি বিধান যোগ করা হলো যেখানে বলা হয়েছে, পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ না হলে পরবর্তী সংসদ সদস্যগণ স্বপদে বহাল হবেন না। তার মানে সংসদ সদস্যদের আসন পাঁচ বছরের একদিন আগেও খালি হওয়ার সুযোগ নেই।
তফসিল অনুযায়ী নির্বাচন আগে হয়ে যাওয়ার কারণে নতুন নির্বাচিত সাংসদদের মাস খানেক অপেক্ষা করতে হবে পুরনোদের মেয়াদ শেষ হওয়ার জন্য। এরকম পরিস্থিতি সাধারণত অন্য কোনো সাংবিধানিক ব্যবস্থায় দেখা যায় না। আমাদের দেশেও এর আগে এমনটি হয়নি। এ সাংবিধানিক ব্যবস্থায় একটি সাংবিধানিক ভ্রান্তি ও আরেকটি রাজনৈতিক সমস্যা দৃশ্যমান।
Advertisement
প্রথমত: একটি সংসদ থাকতে আরেকটি সংসদ নির্বাচন সাংবিধানিক কাঠামোর রেওয়াজ বিরোধী। সাধারণত কোনো সাংবিধানিক ব্যবস্থায় এমনটি হয় না। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কয়েকদিন আগেই রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দেন। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলের জন্যও এটি একটি সমস্যার কারণ হতে পারে। তার কিছু ইঙ্গিতও ইতিমধ্যে দেখা গেছে। বিদ্যমান সংসদের সব সদস্যরাই যে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন পাবেন সেটি নাও হতে পারে।
ফলে বর্তমান সাংসদরা মনোনয়নপ্রাপ্তদের বিরোধিতা করতে পারেন। যদিও মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হলে তারা মনোনয়নপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধেই কাজ করেন স্থানীয়ভাবে। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হলে ব্যর্থ প্রার্থীরা বিএনপির পক্ষে কাজ করে আর বিএনপির মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হলে নেতারা আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করে। পঞ্চদশ সংশোধনী এ রাজনৈতিক সমস্যাটিকে অনেকটা স্থায়ী করলো।
সে কারণেই ওবায়দুল কাদের দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কেউ কাজ করলে তাদেরকে বহিষ্কারের হুমকি দিয়েছেন। এটি দুই দলের জন্যই সত্য। আওয়ামী লীগের অনেক পুরনো সদস্য এবার মনোনয়ন পাবেন না। এমতাবস্থায় নির্বাচনে তারা কী ভূমিকা পালন করেন সেটিই এখন দেখার বিষয়। ফলে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের বিষয়টি আওয়ামী লীগের নতুন এমপি প্রার্থীরাই বেশি অনুভব করবেন। বিএনপির এ সমস্যাটি বেশি হবে না কারণ তারা সংসদেই নেই। বিএনপির জন্য প্লেয়িং ফিল্ডের দাবিটি একটি সাধারণ রাজনৈতিক ও নির্বাচনী দাবি। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এটি একটি সর্বজনীন দাবি।
ঐক্যফ্রন্টের অনেক দাবি ছিল। তাদের দাবির মূল কথা হলো একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এর বাইরে বিএনপির কিছু রাজনৈতিক দাবি এর মধ্যে ঢুকেছে। সেগুলো ভিন্ন বিষয়। যদিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঐক্যফ্রন্টের দাবি মেনে নেননি। কিন্তু তিনি একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তার ওপর আস্থা রাখতে বলেছেন। এ বিশ্বাস ও আস্থার প্রথম নিদর্শন হলো নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রতিষ্ঠা। এটি নিশ্চিত হলে ভোট সুষ্ঠুভাবে গ্রহণ, গণনা ও প্রকাশের বিষয়টি আসে।
Advertisement
নির্বাচনে এই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের প্রথম শর্তই হচ্ছে সংসদে ভেঙে দেয়া। সেটি দুই দলের প্রার্থীদের জন্যই জরুরি ছিল। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ীও রাষ্ট্রপতির সংসদ ভেঙে দেয়ার বিধান আছে। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করলেই সেটি সম্ভব ছিল। সংসদ ভেঙে দিলেই যে প্রধানমন্ত্রীকে তার অন্য মন্ত্রীদের নিয়ে পদত্যাগ করতে হতো বিষয়টি সেরকম নয়। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই নির্বাচনকালীন সরকার হতে পারতো।
শুধু সংসদ না থাকলেই তা অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের রেওয়াজের মতো হতো। সেই সাথে সব দলের সব প্রার্থীর জন্য প্লেয়িং ফিল্ডও অনেকটা নিশ্চিত হতো। কিন্তু তারপরও নির্বাচনে এখনও প্লেয়িং ফিল্ডও নিশ্চিত করা সম্ভব। কারণ, প্লেয়িং ফিল্ডও প্রতিষ্ঠা করতে আইন জরুরি নয়। প্লেয়িং ফিল্ডও নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আইন কোনো বাধা নয়। প্লেয়িং ফিল্ডও করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের কিন্তু এটি নিশ্চিত করার ক্ষমতা আছে সরকারের হাতে। কমিশনের হাতে যতটুকু ক্ষমতা আছে তার প্রয়োগ করলেও এটি অনেকটা নিশ্চিত হতে পারে। প্লেয়িং ফিল্ডও নিশ্চিত করা না করা সরকারের সদিচ্ছারই প্রতিফলনমাত্র।
আসন্ন নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। নতুন সাংবিধানিক কাঠামোর মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু সম্ভব এটি প্রমাণ করার দায়িত্ব আওয়ামী লীগের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সে চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেছেন বলেই মনে হয়। তিনি বলেছে, আমার ওপর আস্থা রাখুন। বিএনপি ২০১৪ সালে আস্থা রাখেনি। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের পর বিএনপি রাজপথে যে রাজনৈতিক বিরোধের ফয়সালা করতে চেয়েছিল, তাতে তারা সফলতো হয়ইনি বরং ব্যর্থ হয়েছে।
২০১৪ সালের নির্বাচন ঠেকাতে গিয়ে তারা আগুনসস্ত্রাস করেছে। কিন্তু এবার আস্থা রাখার সাহস দেখিয়েছে। বিএনপি ঐক্যফ্রন্টের ছাতার তলে নির্বাচনে আসার একটা এন্ট্রি রুট খুঁজে পেয়েছ। ২০১৪ সালে দাবি আদায় করে তারা নির্বাচনে যেতে পারেনি। এবার একই দাবি তাদের ছিল (তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচন তদারকির সরকার) কিন্তু এবারও সেটি তারা আদায় করতে পারেনি। উপরন্তু এর সঙ্গে যোগ হয়েছে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি।
২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় খালেদা জিয়া মুক্ত ছিলেন। কোনো মামলায় তার তখনো সাজা হয়নি। তারেকেরও তখন কোনো মামলায় সাজা হয়নি। ২১ আগস্ট, চ্যারিটেবল ও অরফানেজ ট্রাস্টের মামলা-সব মামলার রায়ই ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরে হয়েছে। ফলে বিএনপির জন্য আগের দাবির সাথে আরো অন্তত দুটি দাবি যোগ হয়েছে-খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তারেকের সাজা মওকুফ। বিএনপি কোনো দাবি পূরণ না হওয়ার পরেও নির্বাচনে এসেছে। কথায় আছে, ‘সেই তো নাচ দেখালি, তবে কেন লোক হাসালি।’ বিএনপির আজকের এই পরিস্থিতির জন্য সরকারের কট্টর অবস্থান যেমন দায়ী তেমনি তাদের ভুল সিদ্ধান্ত ও অবস্থানও কম দায়ী নয়।
তবে তারপরও বিএনপির এবারের নির্বাচনে আসার সিদ্ধান্ত তাদের শুভবুদ্ধিরই পরিচায়ক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই নির্বাচনকে সরকার কতটুকু সুষ্ঠু করতে চায়? যদি বিএনপিকে নির্বাচনে এনে সরকার আগের মতো একটি নির্বাচন করে তাকে বৈধতা দিতে চায়, সেটি আওয়ামী লীগের জন্য আপাত সুফলদায়ক মনে হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা দলটিকে একটি বড় প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাবে। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের দায় থেকে আওয়ামী লীগ মুক্ত হতে পারবে কি? আপাতত নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারলেও ইতিহাসের দায়মুক্তি খুব সহজ কাজ না।
বিএনপি এ দায় থেকে এখনও মুক্ত হতে পারেনি। দাবি পুরণের অংশ হিসেবে বিএনপি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করেছে। কিন্তু সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার সে নির্বাচনের দায় থেকে বিএনপি আজও মুক্ত হতে পারেনি। মুক্ত হতে পারেনি মাগুরার নির্বাচনের দায় থেকে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো একাধিক নির্বাচনের দায় থেকে বর্তমান সরকার তবে মুক্ত থাকবে কি করে?
সে কারণেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চান। এটি তার দূরদর্শী ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞারই পরিচায়ক। ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন সরকার আর করতে চায় না। সেটি আওয়ামী লীগের মতো একটি রাজনৈতিক দলের জন্য হবে একটি আদর্শিক ইউটার্ন। কিন্তু সরকার সংবিধান পরিবর্তনও করতে চায় না। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের অধীনেই এবার একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের নজির সৃষ্টি করতে চান। কারণ, এ সংবিধান তিনিই পরিবর্তন করেছেন। তাই এ সংবিধানের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব সেটি প্রমাণ করার দায়ভারও তারই।
এ দায়ভার তিনি অনুভব করছেন। এবং বর্তমান সংবিধানের অধীনে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হলে সেটি আমাদের জন্য হবে একটি আশীর্বাদ। কারণ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আর সংবিধান কাটাছেঁড়া করতে হবে না, আন্দোলন, জ্বালাও-পোড়াও করতে হবে না। রাজনৈতিক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের একটি নজির সৃষ্টি হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমরা সে আস্থাই রাখতে চাই।
লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট।
এইচআর/আরআইপি