বিশেষ প্রতিবেদন

স্বাধীনতার পর ১৪১৪ আইন পাস, কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন

>> স্বাধীনতার পর ২৭৩ বেসরকারি বিল বা আইন উত্থাপন; পাস ৯টি>> দশম সংসদে সংবিধানের সংশোধনী ১৭ বার, ২৩টি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহীত>> ৪১০ কার্যদিবসে প্রধানমন্ত্রীর রেকর্ড সংখ্যক উপস্থিতি ৩৩৮ দিন>> এমপিরা সরাসরি ১৬টি বিল আনলেও পাস হয়নি একটিও

Advertisement

স্বাধীনতার পর ১০টি সংসদে মোট দুই হাজার ৫৭০ কার্যদিবস পার করেছে। এ সময়ে পাস হয়েছে এক হাজার ৪১৪টি আইন। সংসদ সদস্যদের (এমপি) প্রধান কাজ আইন তৈরি হলেও মন্ত্রীদের ছাড়া এমপিদের আনা আইনগুলো পাত্তা পায়নি সংসদে। তাই স্বাধীনতার পর ২৭৩টি বেসরকারি বিল বা আইন উত্থাপিত হলেও পাস হয়েছে মাত্র নয়টি।  

দশম সংসদে এমপিদের আনীত একটি আইনও পাস হয়নি। এর মধ্যে সংবিধানের সংশোধনী আনা হয়েছে ১৭ বার। সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে ২৩টি। তবে ধন্যবাদ প্রস্তাবের নামে ব্যক্তিবন্দনা হয়েছে আটবার। বিদায়ী সংসদে পাস হয়েছে ১৯৩টি আইন। বিরোধীদলীয় এমপিদের আনা সংশোধনী গ্রহণ করা হয়েছে মাত্র কয়েকটি।  

স্বাধীনতার পর সংসদের ২৫৭০ কার্যদিবসে ১৪১৪ আইন পাস 

Advertisement

স্বাধীনতার পর সংসদ চলেছে দুই হাজার ৫৭০ দিন। আইন পাস হয়েছে এক হাজার ৪১৪টি। দুদিনে প্রায় একটি করে আইন পাস হয়েছে। দশম জাতীয় সংসদের ২৩ অধিবেশন ১৯৩টি আইন পাস হয়। পাস হওয়া এসব আইন এবং এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। 

সূত্র জানায়, প্রথম সংসদের (১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল হতে ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত) মেয়াদ ছিল দুই বছর ছয় মাস। এ সংসদে ১৩৪টি কার্যদিবস ছিল। এ সময়ে ১৫৪টি আইন পাস হয়। দিনে একটিরও বেশি করে আইন পাস হয়। স্বাধীনতার পর নতুন আইনের দরকার ছিল বলেই এতগুলো আইন পাস হয়েছে বলে সংসদের কর্মকর্তারা জানান।

আরও পড়ুন >> সংসদীয় কমিটির খরচ ১০ কোটি, উপস্থিতি অর্ধেক

দ্বিতীয় সংসদের মেয়াদ দুই বছর ১১ মাস (১৯৭৯ সালের ২ এপ্রিল হতে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত)। এ সংসদের ২০৬টি কার্যদিবস ছিল। আইন পাস হয় ৬৫টি।  

Advertisement

তৃতীয় সংসদের মেয়াদ ছিল এক বছর পাঁচ মাস (১৯৮৬ সালের ১০ জুলাই হতে ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত)। ৭৫টি কার্যদিবসে আইন পাস হয় ৩৯টি।  

চতুর্থ সংসদের মেয়াদ ছিল দুই বছর সাত মাস (১৯৮৮ সালের ১৫ এপ্রিল হতে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত)। ১৬৮ কার্যদিবসে আইন পাস হয় ১৪২টি।  

পঞ্চম সংসদের মেয়াদ ছিল চার বছর আট মাস (১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল হতে ১৯৯৫ সালের ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত)। মোট ৪০০ কার্যদিবসে আইন পাস হয় ১৭৩টি। 

ষষ্ঠ সংসদের মেয়াদ ছিল মাত্র ১২ দিন (১৯৯৬ সালের ১৯ মার্চ হতে ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত)। মোট চার কার্যদিবসে সংবিধান সংশোধ করে নির্দলয়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আনা হয়। এ অধিবেশনে সংবিধান সংশোধন ছাড়া আর কোনো আইন পাস হয়নি।  

সপ্তম সংসদের মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর (১৯৯৬ সালের ১৪ জুলাই হতে ২০০১ সালের ১৩ জুলাই পর্যন্ত)। মোট ৩৮২ কার্যদিবসে আইন পাস হয় ১৯১টি। 

অষ্টম সংসদের মেয়াদও ছিল পাঁচ বছর (২০০১ সালের ২৮ অক্টোবর হতে ২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত)। ৩৭৩ কার্যদিবসে আইন পাস হয় ১৮৫টি।  

নবম সংসদের মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর (২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি হতে ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত)। ৪১৮ কার্যদিবসে আইন পাস হয় ২৭১টি।  

এ বিষয়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের দেশের সরকারগুলো খুব সহজেই আইন পাস করে। আমরা দেখেছি, ব্রিটিশ আমলে দীর্ঘ সময় নিয়ে একটা আইন পাস হতো। সেসময় পাস হওয়া পেনাল কোড, ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড (সিআরপিসি), সিভিল প্রসিডিউর কোড (সিপিসি) কিন্তু এখনও বিদ্যমান। এগুলোর কোনো সংশোধনের প্রয়োজন মনে হয় না, হলেও রেয়ার।’  

“বাংলাদেশ হওয়ার পর আমাদের পার্লামেন্ট অনেক আইন পাস করেছে। আইনগুলো পাসের আগে ‘ল’ কমিশনের সঙ্গে আলোচনা-পর্যালোচনা কিংবা পরামর্শ করা উচিত। কিন্তু তা করা হয় না। উন্নত দেশে কোনো আইন পাস করতে দীর্ঘ সময় লাগে কিন্তু আমাদের দেশে আইন পাস হয় খুব অল্প সময়ে। আইন পাসের পর বারবার সংশোধন করতে হয়। সর্বোপরি যে উদ্দেশ্যে আইন পাস হয় সেটি কাজে আসে না। উল্টো মামলার সংখ্যা বেড়ে যায়। কিন্তু যাদের জন্য আইন করা (দেশের সাধারণ নাগরিক), তারা এর সুফল ভোগ করেন না।“

সরকারের ছায়াতলে বিরোধী দল 

দশম সংসদে বিরোধী দল আসলে কী ভূমিকা পালন করেছে- তা নিয়ে তাদের (বিরোধী দল) মধ্যেই হীনমন্যতা রয়েছে। মূলত পাঁচ বছরই সরকার বিরোধী দলের আর বিরোধী দল সরকারের প্রশংসা করে কাটিয়েছে। এ নিয়ে সমালোচনার মুখে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আকুতি জানিয়ে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী, দয়া করে আপনার মন্ত্রিসভা থেকে জাতীয় পার্টির মন্ত্রীদের বাদ দিন। আর তা না হলে আপনি আমাদের দলের সবাইকে মন্ত্রী বানান। আপনি বলতে পারেন, দেশে কি বিরোধী দল আছে? আমরাও বলতে পারি ‘না’। কোথাও গেলে কথা বলতে পারি না। লজ্জা লাগে। আমি তো দেশে-বিদেশে কোথাও জোর গলায় বলতে পারি না যে, জাতীয় পার্টি বিরোধী দল।”

আরও পড়ুন >> জোর গলায় বলতে পারি না জাতীয় পার্টি বিরোধী দল : রওশন

স্বাধীনতার পর ২৭৩ বেসরকারি বিল উত্থাপন; পাস ৯টি 

দশম সংসদে মন্ত্রী ছাড়া এমপিরা সরাসরি ১৬টি বিল আনলেও পাস হয়নি একটিও। শুধু এ সংসদ কেন বিগত নয়টি সংসদে এমপিদের আনা বিলগুলোর পাসের নজির খুবই নগণ্য। দশটি সংসদে এখন পর্যন্ত ২৭৩টি বিল আসলেও পাস হয়েছে মাত্র নয়টি। প্রথম সংসদে এ ধরনের কোনো বিল পাওয়া যায়নি। তবে পঞ্চম জাতীয় সংসদে সবচেয়ে বেশি বিল আনা হয়েছিল। এ সংসদে ৭৪টি বিল আনা হলেও পাস হয় মাত্র একটি। নবম সংসদে সবচেয়ে বেশি বিল পাস হয়। ওই সংসদে ২১টি বিল আনা হয়, পাস হয় তিনটি।  

দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে ৪৭টি বিলের মধ্যে পাস হয় দুটি। তৃতীয় জাতীয় সংসদে পাঁচটি বিলের মধ্যে পাস হয় একটি। চতুর্থ জাতীয় সংসদে ছয়টি বিল আনা হলেও পাস হয়নি একটিও। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে বেসরকারি কোনো বিলই পাওয়া যায়নি। সপ্তম জাতীয় সংসদ ৫১টি বিল আনা হলেও পাস হয় একটি। অষ্টম সংসদে ৫৪টি বিলের মধ্যে একটি পাস হয়। নবম সংসদে ২১টি বিলের মধ্যে পাস হয় তিনটি আর দশম সংসদে ১৫টি বিল আনা হলেও আলোর মুখ দেখেনি একটিও। তবে স্বতন্ত্র সদস্য মো. রুস্তম আলী ফরাজীর (পিরোজপুর-৩) আনা সংবিধান (সপ্তদশ সংশোধন) বিল, ২০১৭ এর আইডিয়া নিয়ে আরেকটি নতুন বিল আনে সরকার। 

গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, সংসদ নির্বাচনে এক প্রার্থী সর্বোচ্চ তিনটি আসন থেকে নির্বাচন করতে পারবেন। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী একাধিক আসনে নির্বাচন করতে পারবেন। এই বৈপরীত্য দূর করার জন্য পিরোজপুর-৩ আসনের স্বতন্ত্র এমপি মো. রুস্তম আলী ফরাজী বিগত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সংবিধান (সপ্তদশ সংশোধন) বিল, ২০১৭ (সংবিধানের ৭১ অনুচ্ছেদ সংশোধন) নামে একটি বিল এনেছিলেন। কিন্তু আজও তা পাস হয়নি। যদিও গত মাসে বিলটি সংসদে উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় সংসদীয় কমিটি।  

বিলগুলো পাস হওয়া উচিত কিনা- এ প্রশ্নের জবাবে রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, অনেক বিল আছে যা পাস করলে রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। এগুলো পাস করা যায়। আর পাস করলে সংসদ অর্থবহ, প্রাণবন্ত ও ফলপ্রসূ হয়।    

প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার রেকর্ড 

বিদায়ী সংসদের ২৩তম অধিবেশন পর্যন্ত এর কার্যদিবস ছিল ৪১০টি। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা হাজির ছিলেন ৩৩৮ কার্যদিবসে। বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ হাজির ছিলেন ২৪১ দিন। নবম সংসদের কার্যদিবস ছিল ৪১৮ দিন। সেই সংসদে ১৯টি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন ৩৩৬ দিন। বিএনপি চেয়ারপারসন ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া উপস্থিত ছিলেন মাত্র ১০ দিন।  

সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ 

২০১৪ সালের ৩ জুলাই (দ্বিতীয় অধিবেশন) জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ (ঢাকা-৬) একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব আনেন। পরে তা পাসও হয়। তার সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি ছিল- ‘যুদ্ধকালীন আদর্শিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা বিএলএফ-এর ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যদের তালিকাটি জরুরি ভিত্তিতে আনা হউক।’ কিন্তু আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। 

২০১৫ সালের ২৯ জানুয়ারি (পঞ্চম অধিবেশন) আওয়ামী লীগের মো. মনিরুল ইসলাম (যশোর-২) আরেকটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব আনেন। তার প্রস্তাবটি ছিল, ‘অবিলম্বে মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনাদের একটি তালিকা করিয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হউক।’ তবে এ সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের পর এনিয়ে কাজ শুরু করলেও তা শেষ করা যায়নি।  

২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর (১২তম অধিবেশন) আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত নারী আসনের বেগম ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি আরেকটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব আনেন। ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের এবং যুদ্ধাপরাধীদের ও সকল মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের সকল স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হউক’। এ সিদ্ধান্ত প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য আইন করার দরকার হলেও সেই উদ্যোগও নেয়া হয়নি। 

২০১৭ সালের ৪ মে (১৫তম অধিবেশন) আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত নারী আসনের বেগম ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি আরেকটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব আনেন। ‘গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারীদের শাস্তির জন্য আইন প্রণয়ন করা হউক’। সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি পাস হলেও আইন করা হয়নি।  

সংসদের কার্যাপ্রণালী বিধি ১৪৩ এর (২) ধারা অনুযায়ী, গৃহীত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সে বিষয়ে পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী সংসদকে জানাবেন। কিন্তু অনেক দিন আগে ওই চারটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব পাস হলেও এ সম্পর্কে মন্ত্রীরা কে কি করেছেন তা সংসদে জানানো হয়নি।  

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জাগো নিউজকে বলেন, সবগুলোর যে কাজ হয়নি তা নয়, কিছু কিছু কাজ হয়েছে। সবগুলো বাস্তবায়ন হলেই সংসদকে অবহিত করা হবে। 

দুবার সংবিধান সংশোধন 

২০১৪ সালে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানটি তুলে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে বিচারকের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে পুনরায় ফিরিয়ে দেয়া হয়, যেটি ১৯৭২ সালের সংবিধানেও ছিল। যদিও হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের এ সংশোধন অবৈধ হিসেবে রায় দেন। ষোড়শ সংশোধন নিয়ে হওয়া মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার পরই প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করেন। 

নারী আসনের বিধান আরও ২৫ বছর বাড়িয়ে সংবিধান সংশোধন করা হয়। ‘সংবিধান (সপ্তদশ সংশোধন) বিল-২০১৮’ নামে বিলটি পাস হয় উত্তাপহীনভাবে। এ বিলে কেউ বিরোধিতা করেননি।  এর আগে পর্যায়ক্রমে সংবিধানের ৬৫ (৩) অনুচ্ছেদ আরও চারবার সংশোধনীর মাধ্যমে নারী আসনের মেয়াদ ও সংখ্যা বাড়ানো হয়। চলতি সংসদের মেয়াদান্তে এ বিধান অব্যাহত রাখতে সংশোধনী বিলটি পাস করা হয়। বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যমান নারী আসনের মেয়াদ শেষ হতো। কিন্তু সপ্তদশ সংশোধনী বিল পাস হওয়ায় পরবর্তী সংসদ থেকে তাদের মেয়াদ আরও ২৫ বছর হবে। 

ধন্যবাদ, নিন্দা ও শোক প্রস্তাব  

সংসদের নোটিস শাখা সূত্র জানায়, সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ১৪৭ ধারা অনুযায়ী দশম সংসদে ৩০টি ধন্যবাদ প্রস্তাব আনা হয়েছিল। এর মধ্যে ১৬টির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। অন্যগুলোর কোনোটি বাতিল, কোনোটি তামাদি আর অন্যগুলো ১৫১ বিধি অনুসারে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ বিধিতে মূলত কোনো অর্জন নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়। এরপর তা ভোটে দিয়ে ধন্যবাদ প্রস্তাব হিসেবে পাস করা হয়। 

দশম সংসদে এ ধরনের আলোচনার আটটিই প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও নেতৃত্বগুণ নিয়ে। এছাড়া অন্যগুলো হলো- গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলের বর্বরোচিত হামলার জন্য বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন; স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সিপিএ-এর নির্বাহী কমিটির চেয়ারপার্সন এবং সাবের হোসেন চৌধুরীর আইপিইউ-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় ধন্যবাদ প্রস্তাব, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তিন নারী ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব কমন্স-এর সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় ধন্যবাদ প্রস্তাব, গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলায় নিন্দা, ঈদের দিন কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় এবং পবিত্র নগরী মদিনা ও ফ্রান্সের নিস শহরে সন্ত্রাসী জঙ্গি হামলায় নিন্দা প্রস্তাব আনা হয়। 

এছাড়া ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস ঘোষণা, সংবিধান ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী Ultra Vires ঘোষণাকে বাতিল ও প্রধান বিচারপতি কর্তৃক জাতীয় সংসদ সম্পর্কে এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যে অসাংবিধানিক, আপত্তিকর ও অপ্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে তা বাতিলের জন্য আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ; মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অব্যাহত নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধ, তাদের নিজ বাসভূম থেকে বিতাড়ন করে বাংলাদেশে পুশইন করা থেকে বিরত থাকা এবং রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিয়ে নাগরিকত্বের অধিকার দিয়ে নিরাপদে বসবাসের ব্যবস্থা গ্রহণে মিয়ানমার সরকারের ওপর জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের জোরালো কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের আহ্বান এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কোর ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে’ যুক্ত হওয়ায় UNESCO-সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানানো হয়। 

ঢাকায় সিপিএ ও আইপিইউ সম্মেলন  

দশম সংসদ আরও দুটি ঘটনার জন্য ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। এই সংসদের দুজন সদস্য আন্তর্জাতিক দুটি ফোরামের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (সিপিএ) সভাপতি নির্বাচিত হন। এছাড়া ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) সভাপতি নির্বাচিত হন সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী। যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে। ওই দুটি সংগঠনের সম্মেলনও ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। ফলে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হয়।  

দশম জাতীয় সংসদ নিয়ে ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়া বলেন, ‘আমার দৃষ্টিতে দশম সংসদ একটি ফলপ্রসূ সংসদ। আমি ১৯৮৬ সালের পর থেকে সংসদে আছি, ওই সময়ের পর এবারের সংসদেই সবচেয়ে প্রাণবন্ত কার্যক্রম চলেছে।’  

তিনি বলেন, ‘২০০১ সালে সংসদে বিরোধী দলকে প্রায় কথা বলতেই দেয়া হয়নি। প্রায় ২০০ আইন প্রণয়নসহ সার্বিক কার্যক্রম বিবেচনায় দশম সংসদ অন্ত্যন্ত সফল।’ 

এইচএস/এমএআর/পিআর