খেলাধুলা

প্রিয় শট ‘স্লগ সুইপ’ ছাড়াই ২১৯ মুশফিকের!

তার পরিপাটি ব্যাটিং টেকনিক, ধীর-স্থির স্বভাব, ধৈর্য্য ধরে উইকেটে থাকা, বলের মেধা ওগুন বিচার করে খেলার মানসিকতা দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটের সাথে যায় পুরোপুরি। কারো কারো চোখে তাই মুশফিকুর রহিমই টেস্টে বাংলাদেশের এক নম্বর ব্যাটিং পারফরমার।

Advertisement

রেকর্ড যদিও তামিম ইকবালের কথা বলবে, সবচেয়ে বেশী টেস্ট রান, শতক, অর্ধশতক সবই তামিমের। তারপরও অসীম ধৈর্য্য, সাজানো-গোছানো ব্যাটিং শৈলি এবং দলের প্রয়োজনে হাল ধরাকে মানদন্ড ধরলে মুশফিক অনন্য, অদ্বিতীয়।

ভাল খেলার অদম্য স্পৃহা তার। নিজের পারফরম্যানসকে প্রতিনিয়নত ওপরের দিকে টেনে তোলার আকুতি, চেষ্টার কথা বলে শেষ করা যাবে না। নিজেকে শতভাগ সুস্থ্য রাখা ফিটনেস অটুট রাখা, অনুশীলনে সবার আগে মাঠে চলে আসা, বাড়তি শ্রম-ঘাম ঝড়ানোয় তার জুড়ি মেলা ভার।

জাতীয় দলের কার্যক্রম থাকুক আর নাই থাকুক- একা একা নিবিড় অনুশীলন করার কাজটিও মুশফিকই সবচেয়ে বেশী করেন। মোটা দাগে বাংলাদেশের সবচেয়ে উদ্যমী, উৎসাহী ও ভাল খেলতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ক্রিকেটারের নাম ‘মুশফিক’।

Advertisement

মাঝে পুরো দলের সাথে তারও খারাপ সময় কেটেছে। আগের আট ইনিংসে তারও কোন ফিফটি নেই। সর্বোচ্চ রান ৩১। এই ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে আরও বেশী মনোযোগী হওয়া দরকার। ভাল খেলার তীব্র আকাঙ্খার পাশাপাশি মনোসংযোগ এবং জায়গামত ভাল পারফরম করার অদম্য বাসনাও খুব জরুরী ছিল।

সেই অত্যাবশ্যকীয় কাজগুলো সম্পাদন করতে গেলে আত্মনিবেদনটা হতে হবে একদম নির্ভুল যথার্থ। গতকাল থেকে আজ শেষ বলটি পর্যন্ত সে আত্মনিবেদনটাই ছিল। আগে বহুবার সংকটে, বিপদে ও প্রয়োজনে হাল ধরা মুশফিক এ টেস্টে ভাল করতে ছিলেন শতভাগের বেশী উদ্যমী ও মরিয়া।

যারা মুশফিককে চেনেন, তারা সবাই জানেন- মুশফিকের ব্যাটিং টেকনিক ও টেম্পারমেন্ট দুর্দান্ত হলেও কিছু ঝুঁকিপূর্ণ শট খেলার ‘বাতিক’ আছে তার। টেস্ট, ওয়ানডে কিংবা টি টোয়েন্টি- যে ফরম্যাটই হোক না কেন, ভাল খেলতে খেলতে হুট করে গুড লেন্থ ডেলিভারিকে স্লগ সুইপ করে বসা তার স্বভাব। অনেক ভাল ভাল ইনিংসের অপমৃত্যু ঘটেছে এই শটে।

এর পাশাপাশি স্পিনারদের অযথা সুইপ খেলার প্রবণতাও প্রচুর। সিলেটে প্রথম টেস্টেও এক ইনিংসে সুইপ খেলতে গিয়ে উইকেট দিয়ে এসেছেন। এই সুইপ- স্লগ সুইপকে তার প্রিয় শট বললেও বাড়াবাড়ি হবেনা।

Advertisement

কিন্তু এই ম্যাচে ডাবল সেঞ্চুরি করার পথে সেই প্রিয় শট খেলার লোভ সংবরণ করেছেন মুশফিক। সেই মিড উইকেট আর স্কোয়ার লেগের মাঝখান দিয়ে স্লগ সুইপ আর স্পিনে লং লেগ-ফাইন লেগে সুইপ শট করা থেকে যতটা সম্ভব দুরে ছিলেন। একদম ধৈর্য্যর প্রতিমূর্তি হয়ে উইকেট আকড়ে পড়ে ছিলেন। কেবল আলগা বল হলেই শটস খেলেছেন।

তাও মনগড়া কিংবা প্রিয় শট নয়। যে বলে যা দরকার তাই খেলেছেন। উইকেটে বল ম্যুভ করেছে। পেসাররা বিশেষ করে কাইল জারভিস আর চাতারা দ্রুত গতির সাথে সুইং করিয়েছেন। অফস্টাম্পের আশপাশে বেশীর ভাগ সময় ঠিক ড্রাইভিং জোনের বাইরে বল ফেলে ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিয়েছেন। কিন্তু মুশফিক একবারের জন্যও অধৈর্য্য হননি।

পুরো ইনিংসে তার স্লগ সুইপ মোটে একটি- সেটাও আজ নয়, কাল। প্রথম দিন শতরানের আগে ৮৫ থেকে ৮৯ রানে পৌছানোর সময় স্লগ সুইপ করে একমাত্র বাউন্ডারি হাঁকিয়েছেন।

এই যে দলের প্রয়োজনে নিজের প্রিয় শট খেলা থেকে রিরত থাকা- এটা সামান্য কথা নয়। অনেক বড় কাজ । সেই কাজে ব্রত থেকে মুশফিক প্রমান দিলেন সত্যি ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়’।

তাইতো তার আজকের ইনিংসটি শুধু তিন তিনটি রেকর্ডের কারনেই স্মরণীয় নয়- নিজেকে বদলে ফেলারও এক বড় নিদর্শন হয়ে থাকবে। মুশফিক নিজেও তা মনে করেন। তাইতো আজ খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে অনেক কথার ভীড়ে বলতে ভোলেননি, ‘এই ইনিংসে আমি আমার প্রিয় শটগুলো খেলিনি।’

মুশফিকের মূল্যায়ন, এ ইনিংসে তিনি ঝুঁকি কম নিয়ে ব্যাট করেছেন। যা আগামীতে একটা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে তার নিজের কাছে। তাইতো দিনের খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে মুখে একথা, ‘আমি এই ইনিংসে কোন রকম ঝুঁকি না নিয়েই খেলেছি। এটা আমার কাছে অনেক বড় বিষয় মনে হয়েছে। আমার যেগুলো প্রিয় শট, সেগুলো ছাড়াই যে আমি এত ইজিলি রান করতে পারি, এই বিশ্বাসটা এসেছে নিজের খেলার মধ্যে। পরের বার এমন হলে আমি সেই শটস গুলোতে ফিরতে পারব। এটা এই ইনিংসের বড় অর্জন।’

সত্যিই তাই। মুশফিক দেখালেন, যে শট সবচেয়ে প্রিয়, মনে হলে আর সুযোগ পেলেই যে স্লগ সুইপ থেকে বেশী রান তুলে নেন- সেই শট না খেলে সময় আর অংকের হিসেবে নিজের টেস্ট ক্যারিয়ারের সবচেয়ে লম্বা ও বড় ইনিংস (নয় ঘন্টা ৪৯ মিনিটে ২১৯ রান) খেলা যায়- সেটাই করে দেখালেন মুশফিক।

এটা শুধু তার নিজের জন্য নয়, আগামীতে অন্যদেরও বড় অনুপ্রেরণা। ভাল এবং দীর্ঘ ইনিংস খেলার পথে কার্যকর দাওয়াই। সে অর্থে নিশ্ছিদ্র ইনিংস। মনোযোগ-মনোসংযোগ ছিল পুরোপুরি।

এই মনোযোগ-মনোসংযোগের পিছনের কথা কি? জানতে চাওয়া হলে মুশফিক একটা নাতিদীর্ঘ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যার সারমর্ম হলো গভীর মনোযোগ আর ঝুঁকিপূর্ণ শট কম খেলার পুরস্কার এই ২১৯ রানের ইনিংস।

‘টেস্ট খেলতে গেলে ধৈর্য্য সবচেয়ে বেশী দরকার। আর সেটা যদি হয় মিরপুরে, তাহলে ধৈর্য্য আরও বেশী প্রয়োজন। মিরপুরের উইকেট রহস্যময়, দুর্বোধ্য। এর চরিত্র ও গতি প্রকৃতি বোঝা কঠিন। আপনি যখন মিরপুরের উইকেটে খেলবেন ব্যাটসম্যান হিসেবে কখনও বলতে পারবেন না পরে কি আসছে। তবে এটা আজকে আমার জন্য বাড়তি সুবিধা ছিল। কারণ, অন্যান্য উইকেটে দেখা যায়, আমি অন্যান্য শট খেলতে যেতাম বা ভাবতাম এই বলটা এদিক খেলি। সে তুলনায় আমাকে এই উইকেটে প্রতিটি বলে গভীর মনোযোগ দিতে হয়েছে। কারণ, এখানে নতুন বা পুরাতন যে বলই হোক হঠাৎ করে বাড়তি বাউন্স করেছে বা নিচু হয়ে গেছে। এখানে ব্যাটিং করাটা সহজ ছিল না। আর এই ব্যাপারটা এক দিক থেকে আমাকে সাহায্য করেছে।’

এআরবি/এসএএস/এমএস