বিশেষ প্রতিবেদন

নির্বাচনে বাম জোটের অংশ নেয়া অসম্ভবপ্রায়

সাইফুল হক। সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি। অন্যতম শীর্ষ নেতা বাম গণতান্ত্রিক জোট। বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর ইউনিয়নের সভাপতিরও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

Advertisement

নির্বাচন, সংলাপ, রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। দেশে গণতান্ত্রিক ধারায় স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচন হলে দেশে সিভিল ওয়ার (গৃহযুদ্ধ) হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। সরকারের অবস্থানের পরিবর্তন আহ্বান করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির দাবি জানান। সরকারের নীতির পরিবর্তন হলে বাম গণতান্ত্রিক জোট আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেবে বলেও জানান তিনি। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ : নির্বাচনমুখী রাজনীতি। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সংলাপে বসলেন। মানুষের নির্বাচনী ভাবনা কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?

সাইফুল হক : নির্বাচন নিয়ে মানুষ প্রচণ্ড ভয়ে আছে। আদৌ ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন কিনা অথবা নিজে ভোট দিতে পারবেন কিনা- তা নিয়ে রীতিমতো আশঙ্কা আছে। ভোট দিয়ে তিনি নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারবেন কিনা বা ভোটের পর নিরাপদে বাড়িতে থাকতে পারবেন কিনা- তা নিয়ে আতঙ্ক কাজ করছে।

Advertisement

নির্বাচন এলেই সংখ্যালঘুরা আতঙ্কে থাকেন। অথচ কোনো প্রশ্নেই নির্বাচন কমিশন বা ক্ষমতাসীনরা জনগণকে আস্থায় আনতে পারেননি। আমরা বাম গণতান্ত্রিক জোট এ কারণেই তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছি। কারণ তফসিল ঘোষণার পরও সারাদেশে ধরপাকড়, মামলা, হামলা চলছে। বিরোধীপক্ষের নেতাকর্মীরা বাড়িতে থাকতে পারছেন না।

মানুষ অধিক সচেতন। সবই বুঝতে পারে। নির্বাচন নামের সাঁতার প্রতিযোগিতায় সরকার ফ্রি স্টাইলে সাঁতার কাটছে। আর বিরোধীপক্ষকে হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটার কথা বলছে। এই হলো সরকারের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড।

এই নির্বাচন কমিশন একটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। সেই কমিশন একটি দুর্বল সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু করবে- এটি সরকারের অন্ধ সমর্থক ছাড়া কেউ বিশ্বাস করে না। এ কারণে আমরা নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের আহ্বান জানিয়েছি।

সরকারি দল ছাড়া কেউ ইভিএম পদ্ধতিতে ভরসা পাচ্ছে না। অথচ হাজার কোটি টাকায় কিনে আনা হচ্ছে ইভিএম। পশ্চিমা বিশ্বেও এই পদ্ধতি বাতিল হচ্ছে। মানুষের মধ্যে সন্দেহ তৈরি করছে যে, সরকারের আগাম বিজয়ের ব্যবস্থা তৈরি করছে নির্বাচন কমিশন।

Advertisement

জাগো নিউজ : এই সন্দেহজনক অবস্থায় বাম গণতান্ত্রিক জোট নির্বাচনে অংশের ব্যাপারে কী ভাবছে?

সাইফুল হক : ন্যূনতম গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি না হলে বিরোধীপক্ষের যেকোনো দলের জন্য নির্বাচনে অংশ নেয়া ঝুঁকিপূর্ণ। বাস্তব অর্থে সরকার আমাদের মতো দলগুলোর জন্য নির্বাচনে অংশ নেয়া অসম্ভব করে তুলছে।

সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেই নির্বাচনে অংশ নেবে বাম জোট।

জাগো নিউজ : গত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে কী বলবেন?

সাইফুল হক : একই ঘটনা ইতিহাসে হুবহু দু’বার ঘটে না। এবার সরকার ভিন্ন কৌশলে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ বের করতে চাইছে। জনগণের ভোটের বিপরীতের কৌশলে ভর করতেই সর্বশক্তি প্রয়োগ করছে।

আমি মনে করি, ২০১৪ সাল এবং ২০১৮ সাল এক নয়। এবার মানুষ অনেক সচেতন, অনেক প্রতিবাদী। দু’বেলা খাবার পেটে না যাক, কিন্তু ভোট দিতে না পারার অপমান বাঙালি সহ্য করে না। যদিও সরকারগুলো পরম্পরায় মানুষকে অপমান করেই চলছে।

জাগো নিউজ : মানুষ অধিক প্রতিবাদী বলছেন। তাহলে রাস্তায় নামছে না কেন?

সাইফুল হক : রাষ্ট্র এখন অধিক বর্বর-গণবিরোধী। শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে তৃণমূলের কর্মী পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না। মামলা, হামলা, গ্রেফতার, রিমান্ড দিয়ে চূড়ান্ত ভয়ের আতঙ্ক তৈরি করেছে।

এরপরও যে আন্দোলন হচ্ছে না, তা বলা যাবে না। গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলন, কোটাবিরোধী আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনগুলো ভরসা জিইয়ে রাখছে। সমাজ, রাজনীতিতে যে গভীর ক্ষোভ তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এসব আন্দোলনে। সরকারের দুর্নীতি, দুঃশাসন, দমননীতির বিরুদ্ধেই মানুষ এসব আন্দোলনে সক্রিয় হতে চাইছে।

জাগো নিউজ : কিন্তু এসব আন্দোলনও তো টেকসই হলো না?

সাইফুল হক : এই আন্দোলনগুলো রাজনৈতিকভাবে গড়ে ওঠেনি। এই আন্দোলনের সঙ্গে রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলনগুলোকে যুক্ত করা যায়নি।

জাগো নিউজ : এর দায় কার? ব্যর্থতা আপনাদেরও কিনা?

সাইফুল হক : আমি মনে করি, বাম সংগঠনগুলোরও দায় আছে। আমরা আন্দোলনের আবেগ ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে, কিন্তু আমরা সাংগঠনিক ভিত্তি দিয়ে তা আন্দোলনে রূপ দিতে পারছি না। ছোট ছোট আন্দোলনগুলো এক সুতায় গেঁথে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে বামদের মধ্যে ঘাটতি ছিল।

তবে সমাজের মধ্যে এই ক্ষোভ এখনও পুঞ্জীভূত আছে।

জাগো নিউজ : এই পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকে রাজনীতির কোনো ইঙ্গিত দেয়া যায় কিনা?

সাইফুল হক : দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ হয় আত্মসমর্পণ করে, না হয় ঘুরে দাঁড়ায়। একজন মানুষ ব্যক্তি আত্মসমর্পণের জায়গা থেকে আত্মহত্যাও করতে পারেন। কিন্তু রাষ্ট্রের কোটি কোটি মানুষ অবশ্যই আত্মহনন করবে না।

এই মানুষ তার মুক্তির জন্য, তার আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্য ঘুরে দাঁড়াবেই। আর এটিই ইতিহাসের শিক্ষা, রাজনীতির শিক্ষা। তবে কখন, কীভাবে তা ঘটবে বলা যাবে না। হতে পারে আসন্ন ভোটের দিনেও মানুষের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটবে। অথবা যেকোনো ইস্যু কেন্দ্র করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নামবে। সময় ধরে বলা মুশকিল।

জাগো নিউজ : নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে বলছিলেন…

সাইফুল হক : হ্যাঁ, পুরো নির্বাচন ব্যবস্থা টাকার খেলায় রূপ নিয়েছে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ১৪ লাখ টাকা ব্যয় করার সীমা বেধে দেয়া হয়েছিল অথচ নির্বাচনে একেকজন প্রার্থী শুধু পোস্টারেই খরচ করেছে কয়েক কোটি টাকা। নির্বাচনী ব্যবস্থার পুরো লঙ্ঘন করে ক্ষমতায় যাচ্ছে। দাগি আসামিরাও এখন নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ঢুকে পড়ছে। ব্যবসায়ীদের হাতে রাজনীতি চলে গেছে। এই নির্বাচনী ব্যবস্থায় বামপন্থীরা তো দূরের কথা, শাসক শ্রেণির মধ্যেও যারা অপেক্ষাকৃত ত্যাগী, পরীক্ষিত তারাও টাকার কাছে হেরে যাচ্ছেন। সংসদ হয়ে যাচ্ছে মাফিয়া, ব্যবসায়ী, আসামি, সন্ত্রাসীদের আড্ডাখানা। সাজাপ্রাপ্ত আসামিরাও মন্ত্রিসভায় পাঁচ বছর থাকলেন!

জাগো নিউজ : এই প্রশ্নে জনগণের দায় নিয়ে কী বলবেন?

সাইফুল হক : আমি মনে করি, আমাদের জনগণ অধিক সংবেদনশীল ও সচেতন। তবে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ওপর জনগণের ভরসার ঘাটতি আছে বলে মনে করি।

অতীতে যারা বিরোধী দলে ছিলেন, তারা ক্ষমতায় গিয়ে ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। এ কারণেই জনগণ ভরসা পায় না। নেতৃত্বের ওপর আস্থা নিয়েও ঘাটতি আছে। মানুষ তার পেছনেই জীবন দেবেন, যিনি সবার আগে জীবনের ঝুঁকি নেন।

জাগো নিউজ : এই প্রশ্নে বামপন্থীদেরও ব্যর্থতা আছে?

সাইফুল হক : এই প্রশ্ন আমাদের এখন আত্মসমালোচনার সময় এসেছে। অল্পতেই আলোচনায় থাকা বা জনপ্রিয় হয়ে ওঠার মানসিকতা আমাদের মধ্যেও তীব্র হচ্ছে। দশজন লোক নিয়ে মানববন্ধন বা টকশোতে গিয়ে আলোচনার মধ্যেই আটকে যাচ্ছি।

একসময় এই অঞ্চলে বামপন্থীরাই অধিক ঝুঁকি নিত। এখন তাদের মধ্যেও কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। অর্থাৎ ব্যবসা, সম্মান, পরিবার- সব ঠিক রেখে যতটুকু ঝুঁকি নেয়া যায়, তাই নিচ্ছি।

এই বিষয়গুলো এখন মানুষ বোঝে। রাজনীতি ও সমাজ পরিবর্তন করা হচ্ছে সবচেয়ে বড় প্রকল্প। অর্থাৎ এই বড় প্রকল্পের জন্য সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ দরকার। আত্মোৎসর্গ না থাকলে এই প্রকল্পের অংশীদার হওয়া যায় না।

জাগো নিউজ : উপলব্ধির প্রশ্নে কী বলবেন?

সাইফুল হক : আমি মনে করি, বামপন্থীরা এখন নিজেদের উপলব্ধি ফিরে পাচ্ছে। এই বোধ জাগ্রত হতেই হবে। সংকট থেকে ঝুঁকি নেয়ার প্রবণতা বাড়বে বলে আমার বিশ্বাস। এএসএস/এমএআর/আরআইপি