ধর্ম

পোশাক পরিধানে প্রিয়নবি যা পছন্দ করতেন

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশ্ব মানবতার জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। তাঁর জীবনাচার জানতে এবং সেভাবে জীবন যাপন করতে মুমিন মুসলমান একান্ত আগ্রহী।

Advertisement

পোশাক পরিধানে প্রিয়নবির কী পছন্দ করতেন কিংবা কী ধরনের কী রংয়ের পোশাক পরিধান করতেন তা জানতেও আগ্রহের কমতি নেই নবি প্রেমিকদের।

হাদিসের আলোকে বুঝা যায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন ধরনের জামা (পোশাক) পরিধান করতেন। কোনটির দৈর্ঘ্য ছিল টাখনু অবধি। কোনটি কিছুটা ছোট, যা হাটুর নিম্নভাগ পর্যন্ত ছিল। আবার কোনটির হাতা ছিল হাতের আঙ্গুলের প্রান্ত পর্যন্ত লম্বা। কোনটির হাতা কিছুটা ছোট, যা কব্জি পর্যন্ত ছিল।

প্রিয়নবি পুরুষদেরকে পোশাক পরিধানে বিশেষ দিকে নির্দেশনা দিয়েছেন। আর তাহলো- পোশাকের নিচের অংশ পায়ের গোড়ালি থেকে ওপরে রাখার আদেশ করেছে এবং পায়ের গোড়ালির নিচে পাজামা, লুঙ্গি, জামা বা যে কোনো পোশাক পরিধান করাকে হারাম ঘোষণা করেছেন।

Advertisement

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব সময় লুঙ্গি ও জামা টাখনুর' উপরে পরিধান করতেন। সাধারণত তিনি পোশাকের নিচের অংশ হাটু ও গোড়ালীর বরাবর বা নিসফে সাক’ পর্যন্ত পরিধান করতেন।

পোশাক পরিধানে প্রিয়নবি সতর্কতা ঘোষণা করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা, আবদুল্লাহ ইবনে উমর ও অন্যান্য সাহাবাগণ কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যাক্তি দাম্ভিকতার সাথে নিজের পোশাক ঝুলিয়ে পরিধান করবে , আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন তার দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না।’ (বুখারি, মুসলিম)

প্রিয়নবি যে সব পোশাক পরিধান করতেন। হাদিসে এ সম্পর্কে রয়েছে সুস্পষ্ট বর্ণনা। হাদিসে এসেছে-

- প্রিয় পোষাক কামিসহজরত উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পোষাক হিসেবে ‘কামিস’ বা জামা সর্বাধিক পছন্দ করতেন।’ (ইবনে মাজাহ)

Advertisement

- বোতাম বিশিষ্ট জামা পরিধানহজরত মুআবিয়া ইবনে কুররা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি মুযায়না গোত্রের একদল লোকের সাথে বায়আত গ্রহণ করার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে উপস্থিত হলাম। এ সময় তার জামার বোতাম খোলা ছিল। আমি তখন (বরকত লাভ করার জন্য) জামার ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মোহরে নবুওয়াত স্পর্শ করলাম।’ (আবু দাউদ ও মুসনাদে আহমদ)

- নকশি কাপড় পরিধানহজরত আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একদিন প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উসামা ইবনে যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর কাধে ভর করে বাইরে বের হলেন। এ সময় তার দেহে পরা ছিল একটি ইয়ামেনী নকশী কাপড়। তারপর তিনি লোকদের নামাজের ইমামতি করেন।’ (মুসনাদে আহমদ)

আরও পড়ুন > প্রিয়নবি কেন সুরমা ব্যবহার করতেন?

- প্রিয়নবির প্রিয় পোশাক হিবারাপোশাকের জন্য বিখ্যাতস্থান ছিল ইয়েমেন। সেখানে ডোরা ও কারুকার্য সম্বলিত সূতি ও কাতান প্রকৃতির নকশি কাপড় ও চাদর হিবারা তৈরি করা হতো। এগুলো কখনো লাল, নীল কিংবা সবুজ ডোরাকাটা হতো।হজরত আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে সর্বাধিক প্রিয় কাপড় হলো (ইয়ামানে তৈরি চাদর) হিবারা।’ (বুখারি, মুসলিম, নাসাঈ, মুসনাদে আহমদ)

- লাল রঙের নকশি চাদরের ব্যবহারহজরত আবু জুহাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লাল নকশি চাদর পরা অবস্থায় দেখেছি। আজও যেন আমি তার উভয় গোড়ালীর ঔজ্জ্বল্য প্রত্যক্ষ করছি।’ (মুসলিম, মুসনাদে আহমদ)

- সেলাইবিহীন লুঙ্গি চাদরের ব্যবহারআরব দেশের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হতো সেলাইবিহীন লুঙ্গি ও চাদর। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও এটি বেশি ব্যবহার করতেন। সেলাইবিহীন লুঙ্গি ও চাদর একই ধরনের একই রংয়ের হলে তাকে ‘হুল্লাহ’ বলা হয়।

হজরত বারা ইবনে আজেব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘লাল হুল্লা' পরিহিত কাউকে আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেয়ে অধিক সুদর্শন দেখিনি। আর তার কেশ (জুম্মা) উভয় কাঁধ স্পর্শ করছিল।’ (বুখারি, নাসাঈ, মুসনাদে আহমদ)

- সবুজ চাদর ব্যবহারহজরত আবু রিমছা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এক সঙ্গে দুটি সবুজ চাদর পরিধান করা অবস্থায় দেখেছি।’ (মুসনাদে আহমদ, নাসাঈ)

- সাদা রঙের কাপড় ব্যবহার পরিধানের নসিহতসাদা কাপড় সর্বোত্তম পোশাক। প্রিয়নবি সাহাবাদেরকে সাদা রঙের কাপড় পরিধান করতে উপদেশ দিয়েছেন।

হজরত সামুরা ইবনে জুনদুব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা সাদা কাপড় পরিধান করো। কারণ, তা সর্বাধিক পবিত্র ও উত্তম। আর তা দিয়েই তোমরা মৃতদের কাফন দাও ‘ (তারগীব ওয়াত তারহিব)

হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা সাদা রঙের কাপড় পরিধান করবে। তোমাদের সবাই যেন সাদা কাপড় পরিধান করে এবং মৃতদেরকে যেন সাদা কাপড় দিয়ে দাফন দেয়। কেননা, সাদা কাপড় তোমাদের সর্বোত্তম পোশাক।’ (নাসাঈ)

- কালো রঙের পশমী চাদর ব্যবহারহজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যুষে (সকালে) বাইরে বের হন। তখন তার দেহে কালো পশমের একটি চাদর শোভা পাচ্ছিল।’ (মুসলিম, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ, বায়হাকি, মুসতাদরেকে হাকেম)

- জুব্বা ব্যবহারহজরত মুগিরা ইবনে শোবা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আট-সাঁট আস্তিন বিশিষ্ট একটি রুমি জুব্বা পরিধান করেন।’ (মুসনাদে আহমদ)

প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পোশাক পরিধানে বিভিন্ন ধরমের বিভিন্ন রঙের পোশাক পরিধান করেছেন। তবে হিবারা, সবুজ রঙের চাদর ও সাদা কাপড় প্রিয়নবির বেশি পছন্দ ছিল।

প্রিয়নবি বিভিন্ন ধরনের কাপড় পরিধান করার কারণ ছিল তৎকালীন সময়ে আরবের কোনো কাপড় তৈরি হতো না। অধিকাংশই আরবের বাইরে থেকে আসত। সিরিয়া, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যবসাযীরা যে পোশাক নিয়ে আসত তাই সাধ্যমতো ক্রয় করে নিতে হতো।

বিভিন্ন হাদিসের আলোকে প্রমাণিত হয় যে, তার মধ্যে সবুজ, সাদা ও মিশ্রিত রং তিনি পছন্দ করতেন। আর প্রিয়নবি ব্যবসয়ীদের কাছ থেকে পোশাক ক্রয় করার পাশাপাশি উপহার হিসেবে যা পেতেন তাই ব্যবহার করতেন।

- প্রিয়নবি নতুন কাপড় পরিধানকালে কাপড়ের নাম উচ্চারণ করে দোয়া পড়তেনহজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নতুন কাপড় পরিধান করতেন তখন কাপড়ের নাম পাগড়ি অথবা কামিস অথবা চাদর ইত্যাদি উচ্চারণ করতেন। তারপর তিনি এ দুআ পড়তেন-اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ كَمَا كَسَوْتَنِيهِ ، أَسْأَلُكَ خَيْرَهُ وَخَيْرَ مَا صُنِعَ لَهُ ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّهِ وَشَرِّ مَا صُنِعَ لَهُউচ্চারণ : আল্লাহুম্ম লাকাল হামদু কামা কাসাওতানিহি, আসআলুকা খায়রাহু ওয়া খায়রা মা সুনিয়া লাহু, ওয়া আউজুবিকা মিন শাররিহি ওয়া শাররিমা সুনিয়া লাহু।’

অর্থ : হে আল্লাহ! তোমারই জন্য যাবতীয় প্রশংসা। যেহেতু তুমিই আমাকে তা পরিধান করিয়েছ। আমি তোমার কাছে এর কল্যাণ প্রার্থনা করছি, আরো কল্যাণ চাচ্ছি যে উদ্দেশে এটা তৈরি করা হয়েছে তার। আর আমি তোমার স্মরণাপন্ন হচ্ছি এর যাবতীয় অনিষ্ট হতে এবং যে উদ্দেশে তৈরি করা হয়েছে তার অনিষ্ট হতে।’ (আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ, ইবনে হিব্বান, নাসাঈ, মুসতাদরেকে হাকেম)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে পোশাক পরিধানে প্রিয়নবির অনুসরণ ও অনুকরণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/পিআর