কৃষি ও প্রকৃতি

গাছে গাছে ঝুলছিল মানুষের লাশ!

‘আমি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। কিছুটা বুঝ-জ্ঞান হয়েছে। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের সেই ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের কথা আমার মনে আছে। ঘূর্ণিঝড়ের পর গাছে গাছে মানুষের লাশ ঝুলছিল। গবাদি পশু মরে আরো বেশি সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল।’ কথাগুলো বললেন ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার বানাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক বজলুর রশিদ।

Advertisement

সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সব পচে দুর্গন্ধ হয়ে যায়। ফলে বেঁচে যাওয়া মানুষের বেঁচে থাকা খুব কষ্টকর হয়ে পড়ে। চারিদিকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। শুরু হয় দুর্ভিক্ষ। ডাবের পানি খেয়ে মানুষ বেঁচে ছিল। বিশুদ্ধ পানি বলতে কিছু ছিল না তখন।’

ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘ভোলা, বরিশাল, বরগুনা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। কারণ ঘূর্ণিঝড়টা ছিলো ওই দিকে। ঘূর্ণিঝড় প্রথম শুরু হয় দক্ষিণ দিকের বাতাস থেকে। এরপর জলোচ্ছ্বাস মানুষের বাড়ি-ঘর সব তছনছ করে দেয়। পশ্চিম দিক থেকে বাতাসের সাথে শুরু হওয়া জলোচ্ছ্বাসের পানি আস্তে আস্তে সরে যায়।’

> আরও পড়ুন- উপকূলের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেন তিনি

Advertisement

কান্নাভেজা কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়টি এতই ভয়ঙ্কর ছিল যে, এর ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে মানুষের বহু দিন সময় লেগেছে। ত্রাণ এসেছে এক সপ্তাহ পরে। মানুষের হাহাকার ছিল অত্যন্ত হৃদয় বিদারক। ১০ লাখের মতো মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। এ সংখ্যা তখনকার জন্য খুব কম ছিল না। ওই সময়ে দেশে মানুষের সংখ্যা ছিল ৭ কোটি।’

মেঘনার কূলে বসে বসে কথা বলছিলেন ৬০ বছরের বৃদ্ধ মো. হানিফ। কথা বলার সময় মনটা খারাপ ছিল তার। স্বজন হারানোর বেদনা আজও তাকে কাঁদায়। কখনো কখনো তিনি আৎকে ওঠেন। হানিফ বলেন, ‘নোয়াখালী সদরের নুরু পাটোয়ারীর হাটে আমার খালাম্মাদের বাড়ি ছিল। ওই ঘূর্ণিঝড়ে স্রোতের তোড়ে খালা-খালু, খালাতো ভাই-বোনসহ মোট ৬-৭ জন ভেসে গেছে। আজ তারা কোথায়, জানি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘তখন এ সমস্ত এলাকা একেবারে চরাঞ্চল ছিল। জলোচ্ছ্বাস হলে টঙের ঘরের চালের উপর মানুষ আশ্রয় নিতো। কিন্তু পানি এত উপরে উঠেছে যে, আশ্রয়টা তখন চিন্তাও করা যায়নি। কোনো রাস্তা-ঘাট, আশ্রয়কেন্দ্র ছিল না তখন। কোন সিগন্যালও পাইনি ঘূর্ণিঝড়ের।’

> আরও পড়ুন- বিপর্যয়ের মুখে উপকূল

Advertisement

লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের চর লরেন্স গ্রামের বাসিন্দা মো. ওলি উল্লাহ (৭০) বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের সারারাত আমরা খুব ভয়ে ছিলাম। সকালে দেখি বাড়ির আশপাশে শুধু লাশ আর লাশ। আমার অনেক পরিচিত মানুষ ওই ঘূর্ণিঝড়ে মারা গেছে। সেসব মানুষের কথা আজও মনে পড়ে। আমরা অনেক কষ্ট করে লাশগুলোকে দাফন করেছি।’

১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়কে ২০১৭ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের আবহাওয়া সংস্থা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় বলে ঘোষণা করেছে। সরকারি হিসেবে ওইদিন প্রাণ হারিয়েছেন ৫ লক্ষাধিক মানুষ। বেসরকারি তথ্যমতে, এ সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। উইকিপিডিয়ায় রেকর্ডকৃত এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়সমূহের মধ্যে এটিই সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়।

সেদিনের নিহত মানুষদের স্মরণ, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাণঘাতী দুর্যোগে সচেতনতা, উপকূলের সমস্যা, সম্ভাবনার কথাসহ উপকূল সুরক্ষার জন্য দিনটিকে ‘উপকূল দিবস’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে দিবসটি পালন করছে ‘উপকূল দিবস বাস্তবায়ন কমিটি’। সংগঠনটির উদ্যোগে গত বছর উপকূলের ৩৪টি স্থানে একযোগে দিবসটি পালন করা হয়। এবার তা পালন করা হবে উপকূলের ৫০টি স্থানে।

> আরও পড়ুন- বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে যা করবেন

সংগঠন সূত্রে জানা যায়, ইতোমধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। তাই আজ ১২ নভেম্বর পালিত হচ্ছে উপকূল দিবস। প্রলয়ঙ্করী এ ঘূর্ণিঝড়ের দিনটিকে ‘উপকূল দিবস’ হিসেবে পালন করা নিয়ে যৌক্তিকতা তুলে ধরেন উপকূল সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ও উপকূলবন্ধু রফিকুল ইসলাম মন্টু।

উপকূল দিবস সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘উপকূলের তথ্য সংগ্রহ করতে এসে মাথায় আসে ‘উপকূল দিবস’। যেদিন একসঙ্গে সবাই উপকূল সুরক্ষার কথা বলবে। ভাবতে থাকি, কোন দিনকে উপকূল দিবস হিসেবে নেওয়া যায়? পরে বেছে নেই ৭০ সালের ১২ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড়ের দিনটিকে। এইদিনে নিহতদের স্মরণ করে উপকূলের সমস্যা-সম্ভাবনার কথা যেন যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারি।’

এসইউ/পিআর